ধার না ভিক্ষা এইসব পরে বিবেচনা করা যাবে। আপাতত আমরা আলোচনাটা অন্যখাতে নিয়ে যাই। তার আগে বলো কিছু খাবে? মনে হচ্ছে সরাসরি অফিস থেকে এসেছ। খিদে লেগেছে নিশ্চয়ই। সিঙারা খাবে?
খাব।
রিলাক্সড হয়ে বসো তো। বিপদ-আপদ থাকবেই। বিপদ-আপদ মাথায় নিয়েই আমাদের বাস করতে হবে। অবশ্যি গরম যা পড়েছে এতে রিলাক্সড হওয়াও কঠিন। বুঝলে দিলু, দেশটা মরুভূমি হতে বেশি বাকি নেই। কিছুদিনের মধ্যেই দেখবে কোরাবানির হাটে উট পাওয়া যাবে।
দিলশাদ স্বস্তি বোধ করছে। নিজের মুখে টাকা চাওয়ার বিড়ম্বনায় যেতে হয় নি। পৃথিবীর সবচে’ গ্লানিকর কাজ হচ্ছে টাকা ধার চাওয়া। যে চায় সেও গ্লানির ভেতরে পড়ে, যার কাছে চাওয়া হয় সেও পড়ে। এই গ্লানি কোনোভাবেই দূর হয় না।
দিলু!
জি।
পার্সোনাল একটা প্রশ্ন তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি। কিছু মনে করো না। জবাব দিতে না চাইলে জবাব দেবার দরকারও নেই। মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করব বলে ভাবি। শেষে আর জিজ্ঞেস করা হয় না।
দিলশাদ শুকনো গলায় বলল, কী জানতে চাচ্ছেন বলুন।
সাজ্জাদের ব্যাপারটা কী বলো তো?
দিলশাদ হালকা গলায় বলল, বলার মতো কোনো ব্যাপার নেই।
তোমার এই দুঃসময় আর সে জঙ্গলে পড়ে আছে। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ফানি লাগছে।
দিলশাদ কিছু বলল না। অফিসের পিওন সিঙাড়া নিয়ে এসেছে। পিরিচে ঢাকা চা। দিলশাদ সিঙাড়া হাতে নিল। ওয়াদুদুর রহমান একটু ঝুঁকে এসে বললেন, তোমার আপার কাছ থেকে শুনলাম তোমার এবং সাজ্জাদের মধ্যে লিগাল সেপারেশন হয়ে গেছে। আমি অবশ্য তার কথায় কোনো গুরুত্ব দেই নি। তোমার আপার স্বভাবই হলো অকারণে কথা বলা। যেখানে সমস্যা নেই সেখানে সমস্যা দেখা। ইদানীং তার ধারণা, আই অ্যাম ইন লাভ উইথ অ্যানাদার উওম্যান। সেই উওম্যানের সঙ্গে আমি বিছানা শেয়ার করছি। তোমার আপা এ ভেরি স্ট্রেঞ্জ ক্যারেক্টার।
দিলশাদ বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপা আমার ব্যাপারে ঠিকই বলেছে।
ঠিক বলেছে? বলো কী?
দিলশাদ লক্ষ করল ওয়াদুদুর রহমানের চোখ চক চক করছে। আনন্দের কোনো ঘটনা শোনার সময় মানুষের চোখ চক চক করে। এটা কি আনন্দের কোনো ঘটনা?
দিলশাদ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, আপা একটু বেশি বেশি বলেছে। সেপারেশন তো বটেই। ও থাকে এক জায়গায়, আমি থাকি আরেক জায়গায়। তার মানে কিন্তু ডিভোর্স না। তবে অনেক দিন থেকেই আমাদের সমস্যা হচ্ছে। আমরা মানিয়ে নিতে পারছি না। ঘৃণা পুষে একসঙ্গে বাস করছি। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে বাড়ি মাথায় তুলছি। লিগাল সেপারেশন হলে দুজনের জন্যেই ভালো। সব ভালো তো আর সবসময় হয় না। এখন যা হয়েছে তা হচ্ছে। মন্দের ভালো। দুলাভাই, এখন উঠি।
তোমার আপার কথা শুনে রাগ কর নি তো!
রাগ করব কেন? রাগ করার মতো কিছু তো বলেন নি।
আরো কিছুক্ষণ বসো। শালী-দুলাভাই গল্প তো কিছুই হলো না। নির্জন অফিস ঘর। শালী-দুলাভাই। এর মজাই অন্যরকম। হা হা হা। শোন দিলু, এক ঘণ্টার মধ্যেই আমার গাড়ি চলে আসবে। গাড়ি এলে আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব। এই এক ঘণ্টা ইন্টারেস্টিং সব জোকস বলব।
দুলাভাই, আরেক দিন এসে আপনার জোকস শুনব। রসিকতা শোনার মতো মানসিক অবস্থা আমার না। তারপরেও শুনব। আজ আমাকে ছুটি দিন।
এখন কি বাসায় যাবে?
না। কলাবাগানে বাবার কাছে যাব। আপনার সাহায্য যেমন চাইলাম, বাবার কাছেও সাহায্য চাইব।
উনাকে তো তুমি আজ পাবে না। আজ বুধবার না? বুধবারে উনি তাঁর পীর সাহেবের কাছে যান। সারারাত মারফতি সব ব্যাপার হয়। বৃহস্পতিবারে তিনি ফিরে এসে ঝিম ধরে থাকেন। হা হা হা। সরি, শ্বশুরকে নিয়ে হাসাহাসি করছি! ঠিক হচ্ছে না। তাছাড়া ঐ পীর ব্যাটার কিছু ক্ষমতা আছে বলেও মনে হয়। এট লিস্ট থট রিডিং-ফিডিং জানে। ঐ দিন কী হয়েছে শোন। আমি আব্বার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে গেলাম তার কাছে। কাছে গিয়ে বসতেই উনি আমাকে বললেন, বাবা, আপনার চামড়ার ব্যবসা কেমন হচ্ছে? আমি বলতে গেলে হতভম্ব।
আপনার কি চামড়ার ব্যবসা আছে?
আগে ছিল না, এখন শুরু করেছি। সেমি ফিনিশড লেদার এক্সপোর্ট করছি। পীর সাহেবের তো সেটা জানার কথা না, তাই না?
বাবার মতো আপনিও তাহলে উনার ভক্ত হয়েছেন?
কিছুটা তো হয়েছিই। আমি আবার অল্পতেই ভক্ত হয়ে যাই। তোমার প্রতি আমার ভক্তি যে কী পরিমাণে তা জানলে সর্বনাশ হয়ে যেত। এমন কোনো সপ্তাহ যায় না যে সপ্তাহে আমি তোমাকে স্বপ্নে না দেখি। কিছু কিছু স্বপ্ন আবার এক্স রেটেড। হা হা হা।
দুলাভাই, আমি যাই।
যাচ্ছ যাও। শুধু একটা কথা বলে দিয়ে যাও। এই বয়সেও বডি এরকম ফিট কী করে রাখ? তোমাকে দেখলে মনেই হয় না তোমার বয়স আঠার-উনিশের বেশি। তোমার আপাকে আমি প্রায়ই তোমার উদাহরণ দেই। লাভ হয় না কিছুই। কপকপ করে সারাদিন খায় আর থলথলা মোটা হয়। মোটা মেয়েমানুষ নিয়ে বিছানায় শোয়া যায়? বিদেশ হলে এতদিনে ডিভোর্স হয়ে যেত।
দিলশাদ কিছু বলল না। উঠে দাঁড়াল। দুলাভাইয়ের সব কথা সে ঠিকমতো শুনেও নি। আজকাল কী যেন হয়েছে, মন দিয়ে সে বেশিক্ষণ অন্যের কথা শুনতে পারে না।
ওয়াদুদুর রহমান খালি গায়েই শালীকে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
.
দিলশাদ তার দুলাভাইয়ের অফিসে যখন গিয়েছিল তখন ঝলমলে রোদ ছিল। অফিস থেকে সে বের হয়েই দেখল আকাশ মেঘলা। বৈশাখ মাসের মেঘলা আকাশ ভালো না। হঠাৎ বাতাস দিতে শুরু করবে। দেখতে দেখতে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে। নাতাশা ঝড় ভয় পায় না, বজ্রপাত ভয় পায়। বজ্রপাতের শব্দে আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ে। ছোটবেলায় আকাশ অন্ধকার হলেই দুহাতে কান চাপা দিয়ে বসে থাকত। মেয়েকে একা রেখে এরকম দিনে কোথাও যাওয়া ঠিক না। দুলাভাইয়ের কথা অনুযায়ী বাবাকে বাসায় পাওয়াও যাবে না। বাবার বাড়িতে যাবার পরিকল্পনা বাতিল করে দিলশাদ নিজের বাসায় ফিরে যাওয়া ঠিক করে রিকশা নিল। রিকশায় চলতে শুরু করা মাত্র বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা বাতাস। দিলশাদ মত বদলাল, বাবার বাড়িতে যাওয়া ঠিক করল। সে নিশ্চিত বাবাকে পাওয়া যাবে না। তার পরেও সে রিকশাওয়ালাকে বলল, কলাবাগানের দিকে যেতে। তার হঠাৎ করেই মার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। সে মনে মনে ঠিক করল, যদি বাবা বাসায় না থাকেন, শুধু মা একা বাসায় থাকেন, তাহলে সে মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদবে।