.
ফজরের আজান পড়ছে। ঢাকা শহরে শত শত মসজিদ। আগামী দশ মিনিট ধরে আজান হতে থাকবে। কাছ থেকে, দূর থেকে ঘুম ভাঙানোর জন্যে মোয়াজ্জিন অতি মধুর গলায় আহ্বান জানাবেন–
“আসসালাতু খাইরুম মিনাননাউম।”
‘ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম।”
দিলশাদের নানিজান তাকে বলেছিলেন, ঘুম ভাঙানোর জন্যে আজান দেওয়া হলেও, যারা দুষ্ট লোক, আজানের শব্দে তাদের ঘুম গাঢ় হয়। ফজরের আজান হচ্ছে তাদের কাছে ঘুমপাড়ানি গানের মতো। দিলশাদের মনে হচ্ছে সে একজন দুই মহিলা। আজানের শব্দে ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে পাটিতে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটি জীবকোষ ঘুমিয়ে পড়ছে। গভীর অবসাদের ঘুম। যেন এই ঘুম কোনোদিন ভাঙবে না।
মতিঝিলের বারোতলা দালান
মতিঝিলের বারোতলা দালানের নতলায় ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের অফিস রহমান ট্রেডিং কোম্পানি। দুকামরার অফিস। দুকামরার একটায় কর্মচারীরা বসে, অন্যটা দুভাগ করা হয়েছে। সেই দুভাগের একভাগে ওয়াদুদ সাহেবের অফিস ঘর, অন্যটা তাঁর খাস কামরা। খাস কামরা সুন্দর করে সাজানো। বিরাট একটা জানালা। জানালার দিকে পেছন ফিরে ওয়াদুদ সাহেব বসেন। কারণ জানালা দিয়ে তাকালে তার মাথা ঘোরে। তার উচ্চতা-ভীতি আছে। তিনি বসেন নিচু রিভলভিং চেয়ারে। মানুষটা বেটে বলে চেয়ারে বসলে তাঁকে প্রায় দেখাই যায় না। তার সামনে প্রকাণ্ড টেবিল। টেবিলটাই ঘরের অনেক জায়গা নিয়ে নিয়েছে।
ওয়াদুদুর রহমান সাহেব তার খাস কামরায় খালিগায়ে বসেছিলেন। মানুষটা অতিরিক্ত রকমের ফরসা। বয়সের কারণে শরীরে থলথলে ভাব চলে এসেছে। তার কাঁধে ভেজা একটা টাওয়েল। টেবিলের সামনে এক কাপ কফি। মুখ বিকৃত করে তিনি কফিতে চুমুক দিচ্ছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে কফিটা তিনি ওষুধের মতো খাচ্ছেন। দিলশাদকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি হাসিমুখে তাকালেন। দিলশাদ বলল, ব্যাপার কী?
ওয়াদুদুর রহমান বললেন, কোন ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছ? নেংটো হয়ে বসে আছি কেন? ঘরের এসি নষ্ট। ঠিক করার জন্যে মিস্ত্রি এনেছিলাম। গাধাটা কিছুই জানে না। কী সব খুটখাট করেছে। এখন পুরো নতলায় কারেন্ট অফ। গরমে সিদ্ধ হচ্ছি। চলে যেতাম। তুমি আসবে বলেছ, কাজেই বসে আছি। প্রতীক্ষা করছি। সুন্দরী শ্যালিকা গোপনে দেখা করতে চাচ্ছে– এই সুযোগ হারাবার মতো বোকা আমি না। এখন বলো তোমার কী খবর?
ভালো।
জগতের কুৎসিততম কফি খেতে চাইলে খাওয়াতে পারি। খাবে?
দিলশাদ বসতে বসতে বলল, জি-না।
ওয়াদুদুর রহমান বললেন, এত দূরে বসো না তো দিলু। আমার পাশে এসে বসো। যেন ইচ্ছা করলেই আমি তোমার হাত ধরতে পারি। সুন্দরী শালীদের হাত ধরায় পাপ হয় না। হা হা হা। আচ্ছা, তোমার অনুমান শক্তি কেমন তার একটা
পরীক্ষা হয়ে যাক। বলো তো অফিসের বড় সাহেবদের খাস কামরার টেবিলটা খাটের মতো প্রকাণ্ড হয় কেন? দেখি তোমার অনুমান।
দিলশাদ বিব্রত গলায় বলল, দুলাভাই, আমার অনুমান ভালো না।
তোমাকে একটু হিন্টস দিচ্ছি। সেইসব বড় সাহেবদের অফিসেই প্রকাণ্ড টেবিল থাকে যাদের সুন্দরী স্টেনো থাকে। এখন পারবে, না আরো হিন্টস লাগবে? হা হা হা।
দিলশাদ অস্বস্তি বোধ করছে। সে অস্বস্তি কাটাবার জন্যে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ওয়াদুদুর রহমান হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, দুএক দিনের ভেতর তোমার বাসায় যাব বলে ঠিক করে রেখেছি। এমন সব ঝামেলায় জড়িয়েছি, যেতে পারছি না। আসল খবরই জিজ্ঞেস করা হয় নি। নাতাশা কেমন আছে? ওর খবর কী?
আগের মতোই।
স্টেবল কি-না সেটা বলো।
বুঝতে পারছি না।
তোমার তো বুঝতে পারার কথাও না। ডাক্তার কী বলছে?
ডাক্তার সাহেব বলছেন– স্টেবল। উনি আমেরিকার এক হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করেছেন। ওকে নিয়ে গেলেই অপারেশন হবে।
নিচ্ছ কবে?
সামনের মাসের দু তারিখে যাব। হাতে এখনো এক মাসের মতো আছে।
টাকা পয়সার ব্যবস্থা কী করেছ?
দিলশাদ সহজ গলায় বলল, জোগাড় করার জন্যে এখন পথে নেমেছি। প্রথমেই আপনার কাছে এসেছি।
আমার কাছে আসার দরকার ছিল না। আমি নিজেই তোমার কাছে যেতাম। তোমাকে তিন লাখ টাকা যাতে দিতে পারি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। ব্যবসা যারা করে তাদের কাছে ক্যাশ টাকা থাকে না। সাধারণ মানুষ এটা বুঝতে পারে না। খুব বড় বড় ব্যবসায়ীও দেখবে বিপদের সময় বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা বের করতে পারছে না। যাই হোক, তোমার টাকা কী পরিমাণ লাগবে?
অপারেশন আর হাসপাতাল খরচ লাগবে কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজার ডলারের মতো।
তার মানে প্রায় এগার লাখ টাকা লাগবে। তোমাকে আরো আটের জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
হ্যাঁ।
পারবে?
পারব।
ভেরি গুড। তুমি আটের ব্যবস্থা কর। আমারটা আমি ডলার করে তুমি প্লেনে উঠার আগে আগে তোমার হাতে দিয়ে দিব। কিংবা এমন ব্যবস্থা করব যেন আমেরিকায় তুমি ডলার পেয়ে যাও।
থ্যাংক য়্যু দুলাভাই।
থ্যাংকস দেয়ার কিছু নেই। নাতাশা শুধু তোমার মেয়ে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সে আমাদেরও মেয়ে। ওর খবর শোনার পর সারারাত আমি ঘুমুতে পারি নি। তোমার আপা চিৎকার করে কেঁদেছে।
দিলশাদ বলল, দুলাভাই, আপনার টাকাটা আমি ফেরত দেব। দেরি হবে, কিন্তু ফেরত দেব। আমি আপনার কাছ থেকে ভিক্ষা হিসাবে নিচ্ছি না। ধার হিসেবে নিচ্ছি।