সাজ্জাদ অস্বস্তির সঙ্গে বলেছে, বিক্রি করি নি। বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছি। তোমাকে রশিদ দেখাতে পারব।
দেখাও, রশিদ দেখাও।
সাজ্জাদ রশিদ খোঁজা শুরু করল। এই স্যুটকেস খুঁজে, ঐ স্যুটকেস খুঁজে। বইয়ের পাতার ফাঁকে দেখে। রশিদ খোজার আশ্চর্য অভিনয়।
দিলু, তুমি বিশ্বাস করছ না। রশিদ সত্যি আছে। তোমার চোখে যেন না পড়ে সে-জন্যে গোপনে কোনো জায়গায় রেখে নিজেই ভুলে গেছি। তিন মাসের মধ্যে তোমার সব গয়না আমি এনে দিব। আজ থেকে ঠিক তিন মাস।
অনেক তিন মাস পার হয়েছে, গয়না আসে নি। আর কোনোদিন এই প্রসঙ্গ নিয়ে দিলশাদ কথা বলে নি। তার রুচি হয় নি।
নাতাশা তার বাবার এই দিকগুলি জানে না। দিলশাদ জানতে দেয় নি। মেয়েটা তার বাবাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। বাবার এইসব দুর্বলতা জানার পরেও সে নিশ্চয়ই তার বাবাকে ভালোবাসবে কিন্তু মেয়েটার ভালোবাসার অপমান হবে। মা হয়ে দিলশাদ তা করতে দিতে পারে না।
দিলশাদ খুব ভালো করে জানে, নাতাশা তার বাবা-মা’র ভেতরের প্রচণ্ড দূরত্বের জন্যে তাকেই দায়ী করে। কারণ তাকেই সাজ্জাদের সঙ্গে রূঢ় কঠিন আচরণগুলি করতে হয়। নাতাশা শুধু তিক্ততাটাই দেখে তিক্ততার উৎস সম্পর্কে জানে না। যেমন- নাতাশা কোনোদিনই জানবে না তার মেজোখালা এক সন্ধ্যাবেলা এসে ফিসফিস করে দিলশাদকে কী বলে গেল।
সে শুধু দেখেছে, তার মা পাথরের মতো হয়ে গেছে। রাতে কিছু খায় নি। এবং সারারাত এক ফোঁটা ঘুমায় নি। তোরবেলা নাতাশা বলেছিল, তোমার কী হয়েছে মা? তোমাকে এমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে কেন?
দিলশাদ বলেছে- মারে, আমার শরীরটা খারাপ।
নাতাশা বলেছে–তোমার শরীর খারাপ না মা। তোমার মন খারাপ। শরীর খারাপ হলে চেহারা একভাবে খারাপ হয়। মন খারাপ হলে অন্যভাবে খারাপ হয়। বলল তো কী হয়েছে?
দিলশাদ চুপ করে থেকেছে। সেদিন সে অফিসেও যায় নি, তার বারান্দায় চুপচাপ বসেছিল। নটার দিকে সাজ্জাদ ব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘসতে ঘসতে বারান্দায় এসে বলল, কী ব্যাপার, অফিস যাও নি?
দিলশাদ বলেছে–না।
শরীর খারাপ করেছে? জ্বর-জারি? দেখি টেম্পারেচারটা দেখি।
দিলশাদ কঠিন গলায় বলেছে, গায়ে হাত দেবে না।
এর জবাবে সাজ্জাদ কী একটা রসিকতা যেন করেছিল। কী রসিকতা করেছিল দিলশাদের মনে নেই। তার শুধু মনে আছে সে ভেতরে ভেতরে থরথর করে কাঁপছিল। তার মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল– তুমি মেজোআপার বাসায় গত বৃহস্পতিবার গিয়ে কী করেছ?
সে নিজেকে সামলেছে। কথাগুলি বলা কষ্টের, না বলা আরো কষ্টের।
দিলশাদের মেজোআপা দিলরুবা অবশ্যি খুব সহজভাবেই কথাগুলি বলেছে। সন্ধ্যাবেলা এসেছে। চা খেয়েছে। গল্পটল্প করে উঠে চলে যাবার সময় হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলেছে দিল, তোকে একটা কথা বলি। রাগ করিস না।
দিলশাদ বলল, এমন কী কথা বলবে যে রাগ করব?
হাসব্যান্ডের ব্যাপারে মেয়েরা খুব সেনসেটিভ হয়– এইজন্যেই বলছি।
দিলশাদ শংকিত চোখে তাকাল। দিলরুবা বলল, সাজ্জাদ তোর মেজো দুলাভাইয়ের কাছে বেশ কয়েকবার এসেছে। তার কিছু টাকা দরকার এইজন্যে। এটা তুই বোধহয় জানিস।
না, আমি জানি না।
যাই হোক, ও বিশ হাজার টাকা চাচ্ছে। তোর দুলাভাই দিতে পারছে না। তার ব্যবসার অবস্থা ভালো না। সে স্পষ্ট না করে দিয়েছে। তারপরেও বার বার এসে, এমন চাপাচাপি–খুব অস্বস্তিকর অবস্থা।
আমাকে বলল নি কেন?
আমি ভাবতাম তুই জানিস।
না, আমি জানতাম না।
যাই হোক, সমস্যায় পড়লে আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা ধার চাওয়া কোনো অন্যায় না।
এরচে অন্যায় কিছু কি সে করেছে?
দিলরুবা হাসিমুখে বলল, তুই চোখ-মুখ যেভাবে শক্ত করে ফেলেছিস, তোকে বলতেই তো ভয় লাগছে। যাই হোক, শোন, সাজ্জাদ গত বৃহস্পতিবার গিয়েছে আমাদের বাসায়। আমরা কেউ বাসায় ছিলাম না। ও রাত নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। আমার কাজের বুয়া তাকে চা দিয়েছে। ফ্রিজে গাজরের হালুয়া ছিল। হালুয়া দিয়েছে। ও খেয়েদেয়ে চলে এসেছে। তারপর থেকে বসার ঘরে সাইড টেবিলে রাখা কৃস্টালের ঘড়িটা নেই। এবোনাইটের উপর কৃস্টালের যে ঘড়ি। মৎস্যকন্যার মূর্তির মতো।
তুমি বলতে চাচ্ছ ঘড়িটা সে চুরি করেছে?
আমার কাজের মেয়েটা বলছিল সে হালুয়া নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে সাজ্জাদের। হাতে ঘড়ি। সে খুব মন দিয়ে ঘড়ি দেখছে।
দিলশাদ আবার বলল, তুমি বলতে চাচ্ছ সে তোমার ঘড়ি চুরি করেছে?
এই তো তুই রেগে যাচ্ছিস। হয়তো ঠাট্টা করে নিয়েছে। হয়তো মনের ভুলে পকেটে রেখে দিয়েছে। এইরকম ভুল তো মানুষ সবসময় করে। করে না? তবে ঘড়িটা তোর দুলাভাইয়ের খুব শখের। সেবার আমেরিকায় গিয়ে ‘মেসিস’ স্টোর থেকে কিনেছে। ট্যাক্স নিয়ে দাম পড়েছে দুশ চল্লিশ ডলার। দামটা কোনো ব্যাপার না– শখের জিনিস তো। টাকা দিয়ে তো আর শখের জিনিসের দাম হয় না।
হড়বড় করে দিলরুবা আরো অনেক কথা বলেছে কিছুই দিলশাদের কানে যায় নি। সে পলকহীন চোখে তাকিয়েছিল, একবার শুধু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়েছিল- আপা, চুপ কর। প্লিজ চুপ কর। তাও বলে নি।
সাজ্জাদ যেদিন বলল, সে বান্দরবন যাবে সেদিন আন্তরিকভাবেই দিলশাদ খুশি হয়েছিল। চলে যাক। চোখের আড়ালে চলে যাক। চলে যাবার দিন সে সাজ্জাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। খারাপ ব্যবহারটা নাতাশার চোখে পড়েছে। খারাপ ব্যবহারের পেছনের কারণটা সে জানে না। কোনোদিন জানবে না। সবকিছু সবাইকে জানতে নেই।