দিলশাদ বলল, এটা বদলে সুতির পাঞ্জাবি নিয়ে আসি?
না। আমার জন্যে এবং তোমার মার জন্যে কিছুই আনবে না। উপহার পেলেই উপহার দিতে হয়। আমার কিছু দেবার সামর্থ্য যখন নেই তখন নেবার উপায়ও নেই। তোমরা কষ্ট পাও বা রাগ কর আমার কিছুই করার নেই।
দিলশাদের ধারণা তার বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মাথা খারাপের বীজ আগেই ছিল। যেদিন রিটায়ার করলেন সেদিনই বীজ থেকে চারা বের হলো। যত দিন যাচ্ছে ততই চারা ডালপালা প্রসারিত করে বাড়ছে। সারাজীবন ঘোর নাস্তিক হাদিউজ্জামান সাহেব এখন এক পীর সাহেবের কাছে যাতায়াত শুরু করেছেন। যুবক বয়েসী পীর। চুল-দাড়ি সবই কালো। তাকেই তিনি পরম শ্রদ্ধাভরে বাবা ডাকছেন। দেখা হলেই কদমবুসি করছেন। কঠিন কদমবুসি। পা থেকে ধুলা নিয়ে সত্যি সত্যি কপালে ঘষেন। পীর সাহেব তাঁকে দশলক্ষ একবার সূরা কাফ পড়তে বলেছেন। পড়া শেষ হলেই তিনি তাকে নিয়ে চিল্লায় যাবেন। সেখানে তার জন্যে খাস দিলে দোয়া করা হবে। যার পরপরই বাতেনি জগৎ হাদিউজ্জামান সাহেবের কাছে ধরা দেবে।
বাতেনি জগৎ ধরার জন্যে হাদিউজ্জামান সাহেব এখন সূরা কাফ পড়ে যাচ্ছেন। চার লক্ষ বারের মতো পড়া শেষ হয়েছে। সূরা পাঠের জন্য একটা ঘর আলাদা করা হয়েছে। সেই ঘরে কোনো আসবাব নেই। তিনি নিজের হাতে মেঝে ধোয়ামোছা করেন। অন্য কারো সেই ঘরে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। মাগরেবের নামাজের পর তিনি তাঁর এই ঘরে মোমবাতি জ্বেলে দেন। মোমবাতির আলোয় সূরাপাঠ চলতে থাকে। এশার নামাজের ওয়াক্ত না হওয়া পর্যন্ত সূরাপাঠ থামে না। রাতে যখন ঘর থেকে বের হন তখন ঘামে তার সারা শরীর ভেজা থাকে। চোখ হয় টকটকে লাল। তিনি নাকি সূরাপাঠের সময় বিচিত্র সব শব্দ শুনতে পান। কারা নাকি তার কানে পেছন দিক থেকে ফুঁ দেয়।
এ দেশের স্ত্রীরা যতই স্বাধীনচেতা হোক, তারা স্বামীর অনুকরণ ও অনুসরণ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারেন না। দিলশাদের মা মনোয়ারা বেগমও তার ব্যতিক্রম নন। তিনিও এখন নিয়মিত স্বামীর সঙ্গে পীর সাহেবের কাছে যান। পীর সাহেবকে ভক্তিভরে কদমবুসি করেন। তিনিও মাগরেবের পর তসবি হাতে বসেন এশার নামাজের আগে সেই তসবি তার হাত থেকে নামে না। ইদানীং তিনিও বলছেন তসবি পাঠের সময় কারা যেন তার চারপাশে ফিসফাস করে। তিনি অপূর্ব সুগন্ধ পান। কাঁঠালিচাপা ফুলের গন্ধের মতো গন্ধ। সেই গন্ধে তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে। দিলশাদের ধারণা তার মা’র এই কথাগুলো বানানো। তিনি স্বামীকে খুশি করার জন্যেই মিথ্যা গল্প বানিয়েছেন।
মনোয়ারা বেগম তার মেয়েকে বলে দিয়েছেন এক লাখ টাকার ব্যবস্থা তিনি যেভাবেই হোক করে দেবেন। এই ব্যাপারে দিলশাদ যেন নিশ্চিন্ত থাকে। দিলশাদ নিশ্চিন্ত নেই। কারণ টাকাপয়সা মনোয়ারার নিয়ন্ত্রণে নেই। হাদিউজ্জামান সাহেব বর্তমানে বাতেনি জগতের সন্ধানে ব্যস্ত থাকলেও ইহলৌকিক ব্যাপারগুলিও কঠিন নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। একপোয়া মুড়ি আনার জন্যে দশটা টাকাও মনোয়ারা বেগমকে স্বামীর কাছ থেকে নিতে হয়।
দিলশাদ ঠিক করেছে সে তার বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে। এই কথোপকথনে সে মাকেও সঙ্গে রাখবে না। স্ত্রীর সমর্থনসূচক যে-কোনো কথায় হাদিউজ্জামান সাহেব বিরক্ত হন। এই মুহূর্তে বাবার বিরক্তি তার কাম্য নয়।
টাকার জন্যে সাজ্জাদের দিক থেকে যে-সব আত্মীয়স্বজন আছে তাদের কাছে কি সে যাবে? যাবার কোনো মানে হয় না। সাজ্জাদের বড়ভাই থাকেন জয়দেবপুরে। রাইস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সিনিয়ার সাইন্টিফিক অফিসার। তাকে তার নিজের সংসার দেখতে হয় এবং বিধবা ছোটবোনের সংসার দেখতে হয়। দ্রলোকের স্ত্রী আর্থাইটিসে প্রায় পঙ্গু। ভয়াবহ টানাটানিতে সংসার চলে। তারপরেও ব্যবসার জন্যে তিনি সাজ্জাদকে একসময় দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। প্রভিডেন্ট ফান্ডে তার কিছু ছিল না। টাকাটা দিয়েছিলেন ধার করে। সেই টাকা ফেরত দেয়া হয় নি।
নাতাশার খবর জানলে তিনি নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, তবে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না। খুব লজ্জার মধ্যে পড়বেন। কী দরকার তাকে লজ্জা দিয়ে।
সাজ্জাদের এক মামা থাকেন পুরনো ঢাকায়। দ্রলোকের প্রচুর টাকা। কাপড়ের ব্যবসা করেন। দিলশাদের বিয়েতে একশ টাকার প্রাইজবন্ড দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে কিছুই পাওয়া যাবে না। তবু দিলশাদ একবার যাবে। ভয়ঙ্কর কৃপণ মানুষও মাঝে মাঝে খুব দয়ালু হয়ে যায়। চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কিছু নেই।
দিলশাদের নিজের সঞ্চয় সামান্যই। বিয়ের সময়ে পাওয়া বেশ কিছু গয়না ছিল। তার বাবা দিয়েছিলেন। মা নিজের গয়না তিন ভাগ করে তিন মেয়েকে দিয়েছিলেন। তার পরিমাণও কম ছিল না। সেইসব গয়নার কিছুই নেই। একদিন কী কারণে স্টিলের আলমারির লকার খুলে দেখে লকারে রাখা বিসকিটের টিন খালি। বিসকিটের টিনে সব গয়না ছিল। দিলশাদ শুধু উপন্যাসেই পড়েছে স্বামী নেশার পয়সার জন্যে স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে দেয়। স্ত্রী গয়নার শোকে কাঁদতে কাঁদতে বিছানা নেয়। উপন্যাসের মতোই তার জীবনে গয়না বিক্রির ব্যাপার ঘটেছে, শুধু সে কাঁদতে কাঁদতে বিছানা নেয় নি। শান্ত গলায় বলেছে- কাজটা করলে কীভাবে? একদিনে নিশ্চয়ই সব গয়না বিক্রি কর নি আস্তে আস্তে করেছ, তাই না? না-কি একদিনেই বিক্রি করেছ?