রেলিং দেয়া ছোট্ট বারান্দা। নামেই বারান্দা। আলো-বাতাস নেই। আকাশ দেখা যায় না। বারান্দার সামনে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং উঠছে– বারোতলা দালান। দৈত্যের মতো এই দালান দিলশাদের ছোট্ট বারান্দা ঢেকে ফেলেছে। রাতের বেলা বারান্দায় এলে সামনের অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটাকে জেলের পাঁচিলের মতো লাগে।
বারান্দায় একটা গদি বসানো বেতের চেয়ার আছে। মেঝের পুরোটা ওয়াল টু ওয়াল কার্পেটের মতো করে শীতল পাটিতে ঢাকা। ছাদের কার্নিশ থেকে ঝুলন্ত টবে অর্কিড। দিলশাদের খুব শখের গাছ। নীল রঙের ফুল যখন ফুটে দিলশাদের অদ্ভুত লাগে।
দিলশাদ বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসল না। মেঝের শীতল পাটিতে বাচ্চাদের মতো পা ছড়িয়ে বসল। কাল বৃহস্পতিবার হাফ অফিস। কাল সারাদিনে কী করবে ভেবে নেয়া যাক। অফিসের পর সে বাসায় না এসে সরাসরি চলে যাবে বড় দুলাভাই ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের অফিসে। ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের নিজের অফিস বলেই তিনি ছুটির দিনেও অফিসে থাকেন। তারপরেও টেলিফোন করে যাবে। নাতাশাকে বাইরে পাঠানোর টাকা এক্ষুনি জোগাড় করতে হবে। হাতে সময় নেই। বড় দুলাভাইয়ের কাছে সরাসরি চাওয়াই ভালো। আপার কাছে চেয়ে কিছু হবে না। দুলাভাইয়ের সংসারে আপার অবস্থা জাপানি পুতুলের মতো। তাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে দেয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু না।
ওয়াদুদুর রহমান সাহেবকে দিলশাদ সহ্যই করতে পারে না। তার আচার আচরণ দিলশাদের কাছে অতীতে অরুচিকর মনে হয়েছে, এখনো হয়। বড় আপার বিয়ের পর তিনি এক রাতে তাঁর দুই শালী এবং স্ত্রীকে রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেলেন। যাবার আগে ঘোষণা দিলেন আমার দুই শালী থাকবে আমার দুই পাশে এবং আমি আমার দুহাত শালীদের কোলে ফেলে রাখব। এইটুকু সুযোগ না পেলে সুন্দরী শালী থাকার মানে কী? হা হা হা।
তিনি যে সিনেমাহলে ঢুকে সত্যি সত্যি শালীদের কোলে হাত রাখবেন দিলশাদ তা কল্পনাও করে নি। সে হতভম্ব হয়ে গেল এবং চাপা গলায় বলল, দুলাভাই, হাত সরিয়ে নিন। ওয়াদুদুর রহমান বললেন, পাগল হয়েছ? দিলশাদ বলল, দুলাভাই, আমি কিন্তু উঠে চলে যাব। ওয়াদুদুর রহমান হাত সরিয়ে নিলেন।
বাসায় ফিরে দিলশাদের বড় আপা দিলশাদের সঙ্গে খুব রাগরাগি করল। থমথমে গলায় বলল, তুই এরকম করলি কেন? তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে? দুলাভাইরা শালীদের সাথে ঠাট্টা-মশকরা করে না? তুই বিশ্রী ব্যবহার করলি! বেচারা মনে কষ্ট পেয়েছে। কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।
দিলশাদ বলল, গম্ভীর হয়ে থাকলেও কিছু করার নেই আপা। এই জাতীয় ঠাট্টা আমার পছন্দ না।
কোলে হাত রাখলে কী হয়?
কিছুই হয় না, কিন্তু আমার ভালো লাগে না।
আসলে তুই বেশি পেকে গেছিস। এত পাকা ভালো না।
পেকে যখন গেছি তখন তো আর করার কিছু নেই। পেকে যাওয়া ফল কাঁচা করার কোনো পদ্ধতি নেই।
এখন চা নিয়ে তোর দুলাভাইয়ের কাছে যা, তার রাগ ভাঙা। বেচারা যা মন খারাপ করেছে আমারই কান্না পাচ্ছে।
দিলশাদ চা নিয়ে গেল। দেখল, দুলাভাই মোটেই মন খারাপ করে নেই। দিলশাদের মেজোআপা দিলরুবার সঙ্গে মোটা দাগের রসিকতা করে যাচ্ছেন। নিজের রসিকতায় নিজেই হাসছেন। দিলশাদের বড় আপা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল এবং হাসিমুখে বলল, এই শোন, দিলুদের ঐ গল্পটা বলো তো, মোটা শাশুড়ি আর চিকন বৌয়ের গল্প। একটু অবসিন কিন্তু দারুণ ফানি। ওরা শুনলে মজা পাবে। প্লিজ। একটু রেখে-ঢেকে বলল।
ওয়াদুদুর রহমান তৎক্ষণাৎ মোটা শাশুড়ি আর চিকন বৌয়ের গল্প শুরু করলেন। রেখে-ঢেকে বলার পরেও গল্পের শেষটা শুনে দিলশাদের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবার উপক্রম হলো। তার বড় আপা হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে হেঁচকি উঠিয়ে ফেলল। দিলশাদ ভেবে পেল না তার আপা কী করে এমন আপত্তিকর একটা গল্প তাদের বলতে বলল। বোকা বলেই বোধহয় বলল। স্বামীকে খুশি করার জন্যে বোকা স্ত্রীরা হাস্যকর সব জিনিস করে।
ওয়াদুদুর রহমান কি দিলশাদকে লাখ দুই টাকা দেবেন না? সম্ভবত দেবেন। তাঁর হাতে টাকা আছে। তবে দ্রলোক যেহেতু ব্যবসায়ী সেহেতু টাকা ফেরত আসবে কি-না এই চিন্তাটা তাঁর মাথায় থাকবে। দিলশাদের প্রথম কাজ হচ্ছে ভদ্রলোকের মাথা থেকে এই দুঃশ্চিন্তা দূর করা। কীভাবে দিলশাদ তা করবে তা ঠিক করা আছে। সে অনেক ভেবে-টেবে ঠিক করেছে।
দিলশাদের বাবার হাতেও কিছু টাকা আছে। তার বাবা রিটায়ার্ড ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হাদিউজ্জামান সাহেব তার গ্র্যাচুইটি, সারেন্ডার করে দেওয়া পেনশনের টাকা ব্যাংকে জমা করে রেখেছেন। টাকার পরিমাণ ঠিক কত তা দিলশাদ জানে না। তবে তার অনুমান তিন-চার লাখ টাকা হবে। তাঁর কলাবাগানের দুতলা বাড়ির একতলায় তিনি থাকেন। দুতলাটা ভাড়া দেন। ভাড়ার টাকায় খুব হিসেব করে সংসার চালান।
হাদিউজ্জামান সাহেব প্রায়ই বলেন, আমার তো আর ছেলে নেই যে, বুড়ো বয়সে ছেলের সংসারে থাকব। মেয়েদের সংসার হলো পরের সংসার, সেখানে আমাদের জায়গা হবে না। আমাদের ব্যবস্থা আমাদেরই দেখতে হবে। আমি কাউকে কিছু দেব না। অন্যদেরও আমাকে কিছু দিতে হবে না।
গত রোজার ঈদে দিলশাদ তার বাবার জন্যে মটকার একটা পাঞ্জাবি এবং মা’র জন্যে টাঙ্গাইলের সুতির শাড়ি নিয়ে গেল। হাদিউজ্জামান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, মা, পাঞ্জাবি এনেছ অত্যন্ত খুশি হয়েছি। কিন্তু আমি তো মা তোমার এই পাঞ্জাবি রাখতে পারব না। ইসলাম ধর্মে পুরুষদের রেশমি পোশাক পরা নিষেধ।