- বইয়ের নামঃ এপিটাফ
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
খুব ভালো ঘুম
শেফার স্মৃতির উদ্দেশে
কালান্তক ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল মেয়েটির ছোট্ট শরীরে। সে সেই ব্যাধিকে অগ্রাহ্য করল। মৃত্যুকে গ্রহণ করল অসীম সাহসিকতায়। কে জানে মেয়েটির সাহস দেখে হয়তো মৃত্যুও লজ্জা পেয়েছিল।
.
“অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
০১.
কাল রাতে আমার খুব ভালো ঘুম হয়েছে। ঘুমের মধ্যে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখি নি। শুধু সারাক্ষণই কেমন যেন শীত শীত করছিল, একটা হিম হাওয়া শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমাঝেই অস্পষ্টভাবে মনে হচ্ছিল কেউ যদি গায়ে একটা পাতলা চাঁদর টেনে দিত। আবার মনে হচ্ছিল, গায়ে চাঁদর না থাকাই ভালো। চাঁদর থাকা মানেই হিম হিম ভাব নষ্ট হয়ে যাওয়া।
সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখি গায়ে চাঁদর আছে। গলা পর্যন্ত টেনে দেয়া পাতলা সুতির চাঁদর। ঘুমুতে যাবার সময় আমার বিছানায় কোনো চাঁদর ছিল না। এই কাজটা নিশ্চয়ই মা করেছেন। মার ঘর আর আমার ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। আগে দরজা বন্ধ থাকত কিংবা ভেজানো থাকত। এখন খোলা থাকে। একমাস আগেও দরজায় সাদার উপর সবুজ প্রিন্টের একটা পর্দা ঝুলত। এখন সেই পর্দাও মা সরিয়ে ফেলেছেন। এটা করা হয়েছে যাতে তার খাটে শুয়ে মা আমাকে দেখতে পারেন। মাঝেমাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি মা একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এটা আমার অপছন্দ, খুব বেশিরকম অপছন্দ। কেন মা গভীর রাতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন? আমার বয়স এখন তের। এই বয়সের মেয়েরা তাদের অপছন্দের কথা কঠিন গলায় বলতে পারে। আমিও পারি, কিন্তু বলি না। আমার বলতে ইচ্ছা করে না।
আমি মেয়েটা আসলে কেমন তা আমার মা জানেন না। আমার বাবাও জানেন না। আমি সারাক্ষণ ভান করি, কেউ তা ধরতে পারে না। মাঝে মাঝে আমি নিজেও ধরতে পারি না। নিজের ভানগুলি আমার নিজের কাছেই একসময় সত্যি বলে মনে হয়। তখন নিজেরই খুব আশ্চর্য লাগে।
ভোরবেলা মা আমার ঘরে ঢুকে প্রথম যে বাক্যটি বলেন তা হচ্ছে– কী রে নাতাশা, আজ শরীরটা কেমন? আমি মুখ টিপে হাসি, যে হাসির অর্থ শরীর খুব ভালো। এবং আমি মার মুখ থেকে দিনের শুরুর প্রথম বাক্যটি শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়েছি। আসলে পুরোটাই ভান। আমার শরীর মোটেই ভালো না। এবং আমি দিনের প্রথম বাক্যটি শুনে রাগ করেছি কারণ নাতাশা আমার নাম না। আমার খুব সুন্দর একটা নাম আছে– টিয়া। আমার জন্ম হয় নেত্রকোনার নান্দাইলে, আমার দাদার বাড়িতে। হিসেব মতো আমার জন্য আরো মাসখানিক পরে হওয়ার কথা। বাবা মাকে নিয়ে অসুস্থ দাদাজানকে দেখতে নান্দাইল গিয়েছিলেন। যেদিন পৌঁছলেন সেদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ মা’র প্রসবব্যথা উঠে গেল। বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ভয়াবহ ধরনের গণ্ডগ্রামে কোথায় পাওয়া যাবে ডাক্তার, কোথায় কী? খুঁজে পেতে দাই আনার আগেই আমি পৃথিবীতে চলে এলাম। আমার জন্মের পর পর দাদাজানের কাঁঠাল গাছ থেকে ঝাকে ঝাকে টিয়া পাখি আকাশে উড়ে গিয়েছিল। আমার বাবা বারান্দায় খুব মন খারাপ করে বসেছিলেন। টিয়া পাখির ঝাক দেখে তার মনে খুব আনন্দ হলো। তার কিছুক্ষণ পরেই বাবাকে আমার জনের খবর দেয়া হলো। বাবা বললেন, আমার মেয়ের নাম হলো টিয়া।
টিয়া নামটা কাবোরই পছন্দ না, কারণ পাখির নামে নাম রাখলে পাখির মতো। স্বভাব হয়। ঘরে নাকি মন টেকে না। কিন্তু নামটা আমার খুব পছন্দ। মা আমার এত পছন্দের নাম ধরে না ডেকে নাতাশা ডাকেন। আমার রাগ লাগে, তারপরেও আমি মুখ টিপে হাসি। আনন্দের ভান করি। মা সেই ভান ধরতে পারেন না। তিনিও হাসেন। আমার মতোই মুখ টিপে হাসেন।
মুখ টিপে হাসলে মাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে। অবশ্যি না হাসলেও তাকে সুন্দর লাগে। তিনি যখন রাগ করে থাকেন তখনো সুন্দর লাগে। তখনো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। যারা সুন্দর তারা সবসময় সুন্দর, হাসিতেও সুন্দর কান্নাতেও সুন্দর। আমার চেহারা মোটামুটি। এখন অবশ্যি খুব খারাপ হয়েছে। আমি যখন হাসি তখন আমাকে খুব সম্ভব অতি কুৎসিত লাগে। হাতের কাছে একটা আয়না থাকলে একবার দেখতাম। হাতের কাছে কোনো আয়না নেই। মা’র কঠিন নির্দেশে আমার ঘর থেকে সব আয়না সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ আমি এখন প্রায় একটা পোকার মতো হয়ে গেছি। মানুষের মতো হাত-পাওয়ালা একটা পোকাকে সুন্দর জামা-কাপড় পরিয়ে শুইয়ে রাখলে যেমন দেখায়, আমাকেও নিশ্চয়ই সেরকম দেখায়। আমি সেটা বুঝতে পারি মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে। যারা প্রথমবারের মতো আমাকে দেখে তাদের চোখে একটা ধাক্কা লাগে। সেখানে একটা ঘৃণার ভাব ফুটে ওঠে। সেই ঘৃণার জন্যে তারা লজ্জিত হয়। লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের চোখে একটা অসহায় ভাব জাগে। আমি বুঝতে পারি। দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সেই অনেক কিছুর একটা হচ্ছে চোখের ভাষা বুঝতে পারা।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই একটা কুৎসিত পোকা দেখতে কারো ভালো লাগার কথা না। আমার মা’রও নিশ্চয়ই ভালো লাগে না। আমি জানি, ভালো না লাগলেও আমার মাকে এই দৃশ্য আরো কিছুদিন দেখতে হবে। কত দিন তা কি মা’র জানা আছে? মনে হয় না। তবে ডাক্তার সাহেব নিশ্চয়ই জানেন। জানলেও তারা মাকে জানাবেন না। কোনো ডাক্তারের পক্ষেই কোনো মাকে বলা সম্ভব না আপনার মেয়ের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে এসেছে। সে আর মাত্র এতদিন বাঁচবে।