“ওটা কিসের শব্দ?”
আম্মা হেসে ফেলে বললেন, “কী লজ্জার কথা! বাঙালির ছেলে শেয়ালের ডাক চেনে না!”
“এটা শেয়ালের ডাক?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু শেয়াল নাকি হুক্কা হুয়া হুক্কা বলে ডাকে? এটা তো সম্পূর্ণ অন্যরকম। মনে হয় কেউ কাঁদছে।”
“এটাই শেয়ালের ডাক। আগে তো শহরের মাঝখানে ছিলি, শেয়ালের ডাক শুনিসনি। এখন পিছনে টিলা জঙ্গল নদী এসব আগে তা-ই শুনছিস। যা ঘুমা গিয়ে।”
বুবুন আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে একটু দূরে থেকে আবার শেয়ালেরা ডেকে উঠল। প্রথমে একটা ডেকে ওঠে তারপর একসাথে অনেকগুলো। আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার শেয়ালের ডাক শুনলেই বুকের ভিতরে কীরকম জানি করতে থাকে। একই সাথে এরকম ভয় আর একরকম খালি-খালি মন-খারাপ-করা ভাব। কেন এটা হয়?
বুকের মাঝে খালি-খালি এক ধরনের ভাব নিয়ে বুবুন একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন বিকেলে সবাই একত্র হয়েছে, জানালার কাঁচ ভাঙার ঘটনার পর থেকে কয়েকদিন হল ক্রিকেট খেলা আপাতত বন্ধ। কী খেলা যেতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখন বুবুন হঠাৎ করে বলল, “কাল রাত্রে তোমরা শেয়ালের ডাক শুনেছিলে?”
গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “কেন? কী হয়েছিল শেয়ালের ডাকে?”
“কিছু হয়নি। কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
“শুনলে কীরকম লাগে না? ভয়-ভয় খালি-খালি–”
পিয়াল চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তুমি আগে কখনো শেয়ালের ডাক শোননি?”
“না। কীভাবে শুনব? বইয়ে পড়েছিলাম হুক্কা হুয়া–”
সুমি হি হি করে হেসে বলল, “তুই কি মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছিস নাকি? পরে শুনব কোনদিন মশাও দেখিসনি।”
এখানে সবাই সবাইকে তুই তুই করে বলে, বুবুন নুতন এসেছে বলে এখনও তুমি তুমি করে বলছে। সুমি অবশ্যি তুই শুরু করে দিয়েছে। সুমির কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল, বুবুন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আমাকে নিয়ে হাসছ কেন? খোঁজ নিয়ে দেখো ঢাকা শহরে কয়জন শেয়ালের ডাক শুনেছে!”
পিয়াল বলল, “তার মানে তুমি শেয়াল দেখওনি!”
“না। কিন্তু টেলিভিশনে দেখেছি। অনেকটা কুকুরের মতো।”
গাব্বু বলল, “লজ্জার ব্যাপার। একটা মানুষ কোনোদিন শেয়াল দেখেনি।”
সুমি বলল, “চল শেয়াল দেখিয়ে আনি।”
বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে দেখাবে?”
গাব্বু বলল, “শেয়ালদের কলেজ আছে, সেখানে গেলেই দেখবে সবাই বই খাতা নিয়ে পড়াশোনা করছে। হি হি হি–” গাব্বু নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।
পিয়াল বলল, “বেশির ভাগ সময় পড়াশোনা না করে পলিটিক্স করে। শ্লোগান দিতে থাকে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া–” এটা শুনে গাবুর মনে হল আরও বেশি আনন্দ হল, হাসতে হাসতে সে এবারে প্রায় মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
বুবুন বলল, “যাও! ঠিক করে বলল-না–”
সুমি বলল, “ঐ টিলায় শেয়ালের গর্ত আছে। গর্তের মুখে আগুন দিয়ে ধোঁয়া দিলেই শেয়াল বের হয়ে আসবে।
“সত্যি?”
“সত্যি না তো মিথ্যা?”
“আগে কখনো বের করেছ?”
“এখনও বের করিনি, চল, আজকে বের করব।”
“ধোয়া কেমন করে দিতে হয়?”
“খবরের কাগজ পেঁচিয়ে আগুন ধরালেই ধোঁয়া হবে। আবার কঠিন কী?”
গাব্বু বলল, “সবচেয়ে ভালো হয় যদি একটা টেম্পো ধরাধরি করে টিলার উপরে নিয়ে যাই। টেম্পোর পিছনে দিয়ে কীরকম কালো ধোঁয়া বের হয় দেখেছিস?”
গাব্বু আবার নিজের রসিকতায় নিজেই হি হি করে হাসতে শুরু করল। সুমি চোখ পাকিয়ে বলল, “গা! তুই দিনে দিনে দেখি সিনেমার জোকার হয়ে যাচ্ছিস!”
কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল এই ছোট দলটি টিলার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ধোঁয়া দিয়ে শেয়ালের গর্ত থেকে শেয়াল বের করা হবে শুনে আরও কিছু বাচ্চাকাচ্চা দলে যোগ দিয়েছে। সুমি অন্য মেয়েদের ডাকাডাকি করছিল, কিন্তু তাদের কেউ আসতে সাহস পেল না। বকুল সুমিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে থামানোর চেষ্টা করছিল কিছু-কিছু কাজ মেয়েদের করতে হয় না সেটা নিয়েও একটা লেকচার দিয়েছিল, কিন্তু কোনো লাভ হল না।
টিলার নিচে একটা ডোবামতো জায়গা আছে, সেটাকে পাশ কাটিয়ে তারা উপরে উঠে গেল। জায়গাটা বেশ নির্জন, কিন্তু একেবারে উপরে উঠে দেখতে পেল সেখানে একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটার চেহারায় একটা ইঁদুর-দুর ভাব, কালচে গায়ের রং, ছুঁচালো মুখ, সরু গোঁফের রেখা। মানুষটা তাদের দিকে খুব সন্দেহের চোখে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। সুমির পিছনে পিছনে অন্য সবাই হেঁটে হেঁটে টিলার অন্যপাশে হাজির হল। খানিকটা জায়গা বেশ খাড়া, পাথর মাটিতে মেশানো, ছোট ছোট ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা। সেখানে ছোটবড় অনেকগুলো গর্ত। সুমি থেমে বলল, “এই যে শেয়ালের গর্ত।”
বুবুন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন করে জান?”
“একদিন শেয়ালকে ধাওয়া করেছিলাম, তখন দেখেছি এখানে এসে ঢুকেছে।”
গাব্বু বলল, “হতে পারে চা-নাশতা খাওয়ার জন্যে ঢুকেছে, কিন্তু থাকে অন্য জায়গায়।”
সুমি ধমক দিয়ে বলল, “খালি বাজে কথা বলিস না।”
খবরের কাগজ পেঁচিয়ে দলা পাকানো হল, ম্যাচ বের করে সেখানে আগুন দেয়া হল, একটু আগুন এবং অনেকখানি ধোয়া হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হল উলটোটা, অনেকখানি আগুন এবং একটুখানি ধোয়া। সেই ধোঁয়া শেয়ালের গর্তে ঢোকার কথা কিন্তু ধোঁয়া ভিতরে না ঢুকে গর্তের মুখে পাক খেতে থাকল। বুবুন মাথা নেড়ে বলল, “ধোঁয়া তো ঢুকছে না!”