বুবুন বোকার মতো মাথা নাড়ল। সুমি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আজকে ছেলের টিম আর মেয়ের টিম খেলা হচ্ছে।”
“কোথায় গেছে সবাই?”
“চাড়া ভেঙ্গে লুকিয়ে আছে। সাত-চাড়া খেলার নিয়ম জানেন তো? প্রথমে চাড়া ভেঙে—”
“তা হলে জানালার কাঁচ ভাঙল কেমন করে?”
“মনে হয় মডেল স্কুলের ছেলেরা ভেঙেছে।”
পিয়ালের আব্বা অবাক হয়ে বললেন, “মডেল স্কুলের ছেলেরা?”
“জি চাচা। ডিবেটে আমাদের স্কুলের টিমের কাছে হেরে গিয়েছিল তো তাই আমাদের উপর খুব রাগ। আমাদের দেখলেই ঢিল মারে।” সুমি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে-থাকা একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না রে বকুল?”
বকুল নামের মেয়েটি ফ্যাকাশে হয়ে ঢোক গিলে মাথা নাড়ল। পিয়ালের আব্বা সুমির কথা বিশ্বাস করলেন কি না বোঝা গেল না। নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণের মাঝেই গুটিগুটি পায়ে ছেলের দল এসে হাজির হল–তারা কাছাকাছি কোথায় লুকিয়ে থেকে সুমির সাথে পিয়ালের আব্বার কথাবার্তা শুনেছে। পিয়াল দুর্বল গলায় বলল, “সুমি!”
“কী হল?”
“আমি তোকে আচার কিনে-খাওয়াব। খোদার কসম।”
সুমি মুখ ভেংচে বলল, “আমি তোর আচার খাওয়ার জন্য মারা যাচ্ছি!”
“সত্যি সুমি। তুই বাঁচিয়েছিস আমাকে–এখনও বিপদ পুরোপুরি যায়নি কিন্তু যদি সত্যি কথাটা বলে ফেলতি একেবারে অবস্থা কেরোসিন হয়ে যেত।”
গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “একেবারে কেরাসিন!”
“আব্বা মেরে একেবারে ভর্তা করে ফেলতেন।”
গাব্বু বলল, “লাশ পড়ে যেত।”
সুমি মুখ শক্ত করে বলল, “দ্যাখ পিয়াল, অন্য কেউ হলে আমি কখনো এত বড় মিথ্যা কথাটা বলতাম না। কখনো না। শুধু তো আব্বা বলে”
বুকুল নামের মেয়েটি এগিয়ে বলল, “সত্যি কথাটাই বলা উচিত ছিল। মনে আছে আমাদের সাথে কীরকম ব্যবহার করেছিস?”
আরেকটি মেয়ে বলল, “মনে আছে?”
সুমি হাত নেড়ে বলল, “ছেড়ে দে! এরা তো বড় হয়ে পুরুষমানুষ হবে তাই এখন থেকে প্র্যাকটিস করছে।”
পিয়াল বলল, “আর কখনো করব না, খোদার কসম।”
বুবুন বলল, “এখানে এরকম দাঁড়িয়ে না থেকে আসলে আমাদের সবাই মিলে এখন সাত-চাড়া খেলা উচিত।”
গাব্বু মাথা নাড়ল, “ঠিকই বলেছে বুবুন। নইলে সন্দেহ করতে পারে।”
“হ্যাঁ। চল খেলা শুরু করে দিই।”
সুমি দাঁত বের করে হেসে বলল, “চল। কে জানে তোরা হয়তো একদিন সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে পারবি!”
পিয়াল অপরাধীর মতো সুমির দিকে তাকাল, কিছু বলল না।
সাত-চাড়া খেলা নিয়ে ছেলেদের একটা তাচ্ছিল্যের ভাব থাকলেও দেখতে দেখতে খেলা খুব জমে উঠল। একেবারে সন্ধ্যে না হওয়া পর্যন্ত তারা খেলে গেল। খেলাশেষে সবাই নিজেদের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। পিয়াল বিপদ হতে পারে বলে ক্রিকেট ব্যাটটা বুবুনকে রাখতে দিয়েছে, বুবুন ব্যাটটা ঘাড়ে করে হাঁটছে সাথে গাঙ্কু আর সুমি। গাব্বু বলল, “সাত-চাড়া খেলাটা আসলে খারাপ না।”
বুবুন বলল, “আসলে সবাই মিলে খেললে সব খেলাই মজার।”
সুমি বলল, “দিনরাত ক্রিকেট খেলে তোরা যে কী মজা পাস।”
গাব্বু বলল, “খেলিসনি তো, তাই জানিস না।”
বুবুন হঠাৎ ঘুরে তাকিয়ে বলল, “পিয়ালের আব্বা যদি জানতে পারেন ক্রিকেট বল দিয়ে জানালার কাঁচ ভেঙেছে তা হলে সত্যি সত্যি পিয়ালকে মারবেন?”
সুমি বলল, “জানে শেষ করে দেবেন।”
বুবুন বলল, “সত্যি? ইচ্ছে করে তো ভাঙেনি।”
“তাতে কী হয়েছে?”
গাব্বু দার্শনিকের মতো বলল, “আসলে আব্বা জিনিসটা হচ্ছে একটা কপালের ব্যাপার। যেমন মনে করো সুমির কপালটা একেবারে ফাস্ট ক্লাস। সুমি যদি একটা মার্ডার করে আসে সুমির আব্বা বলবেন, ভেরি গুড সুমি। কী সুন্দর করে মার্ডার করেছে দেখেছ! আর কেউ এত সুন্দর করে মার্ডার করতে পারবে?”
গাব্বুর কথা বলার ভঙ্গি শুনে সুমি আর বুবুন দুজনেই হেসে ফেলল। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
গাব্বু বলল, “সত্যি না তো মিথ্যা? সুমি যে এইরকম বেড়েছে তার কারণটা কী? আমাদের ছেলেদের যেসব জিনিস করা নিষেধ সুমি সেগুলো পর্যন্ত করতে পারে ওর আব্বা কিছু বলেন না। উলটো উৎসাহ দেন। একেবারে ফার্স্ট ক্লাস আব্বা!”
“তোমার আব্বা?”
“আমার আব্বা মাঝামাঝি। পিয়ালের আব্বা হচ্ছে ডেঞ্জারাস। ওর কপালটা খারাপ। এখন মনে করো জানালার কাঁচ ভেঙেছে, সুমি চেষ্টা করছে ওকে বাঁচানোর, কিন্তু তবু মনে হয় মার কিছু খাবে। যদি জানালার কাঁচ না ভাঙত তবু মার খেত–”
“কেন?”
“যদি ভেঙে যেত সেজন্যে। পিয়ালের আব্বা সবসময় অ্যাডভান্স কিছু পিটিয়ে রাখেন।”
সুমি মাথা নাড়ল, বলল, “আসলেই পিয়ালটার কপাল খারাপ।”
বাসায় ফিরে যেতে যেতে বুবুনের মাথায় একটা প্রশ্ন এল, যদি সুমির কপাল ভালো, গাবুর কপাল মাঝামাঝি এবং পিয়ালের কপাল খারাপ হয়ে থাকে তা হলে তার কপাল কি? কপার কি কখনো নাই’ হতে পারে?
রাত্রিবেলা বুবুন নিজের ঘরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। অনেক মানুষই আছে যারা শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে যায়, বুবুন ওরকম না,শোয়ার সময় হলেই ঘুরেফিরে তার মাথায় রাজ্যের যত চিন্তা এসে জড়ো হয়। আজকেও শুরু হচ্ছিল কিন্তু সে জোর করে সব ঠেলে সরিয়ে দিল। চেষ্টা করে সে যখন প্রায় ঘুমিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে কে যেন তাদের বাসার খুব কাছে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল, সাথে সাথে আরও অনেকে। বুবুন ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে বসল, তারপর তড়াক করে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে একেবারে আম্মার কাছে। আম্মা নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে কী-একটা বই পড়ছিলেন, বুবুনকে দৌড়ে আসতে দেখে বললেন, “কী হল, বুবুন?”