আম্মা খপ করে বুবুনের কান ধরার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। সে ছিটকে সরে গিয়ে বলল, “আমার মনে হয় আমার যদি একটা বাবা হয় তা হলে আমার ভালোই লাগবে।”
আম্মা বিছানা থেকে উঠে বুবুনকে ধরার চেষ্টা করলেন, বুবুন আগে থেকে তৈরি ছিল বলে এবারেও ধরতে পারলে না।
রাতে ঘুমানোর সময় আম্মার চোখে একটু পরে পরে পানি এসে যাচ্ছিল, ঠিক কী কারণে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।
০৩. শেয়ালের গর্ত
৩. শেয়ালের গর্ত
বিকেলবেলা খেলতে বের হয়ে বুবুন দেখল গাব্ব, পিয়াল এবং অন্য ছেলেরা ক্রিকেট ব্যাট এবং বল নিয়ে খেলার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। বুবুন মনে-মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–সে এই খেলাটাতে কিছুতেই সুবিধে করতে পারে না। ছেলেরা যখন বাঁশের কঞ্চি দিয়ে স্ট্যাম্প তৈরি করে মাটিতে গাঁথছে তখন সুমি এসে বলল, “এই, তোমরা এখন ক্রিকেট খেলবে?”
পিয়াল মুখ ভেংচে বলল, “না আমরা বুড়ি চি খেলব!”
“ফাজলেমি করবি না বলছি, মুখ ভেঙে দেব।
পিয়াল কোনো কথা বলল না, সুমি মনে হয় ভুল করে মেয়ে হয়ে জন্মেছে, তার ছেলে হওয়ার কথা ছিল, তাকে সবাই অল্পবিস্তর ভয় পায়। সুমি বলল, “আমরা এখানে আগে খেলতে এসেছি, আমরা খেলব। তোরা অন্য জায়গায় যা।”
সুমির কথা শুনে পিয়াল মনে হল একটু অবাক হয়ে গেল, বলল, “তোরা খেলবি? মানে মেয়েরা?”
“হ্যাঁ। তোরা যদি চাস আমাদের সাথে খেলতে পারিস।”
“কী খেলবি তোরা?”
“সাত-চাড়া।”
“সাত-চাড়া?” গাব্বু এবং পিয়াল একসাথে হেসে উঠল।”হাসছিস যে বড়? খেলিসনি কখনো সাত-চাড়া?”
“খেলব না কেন? কিন্তু সাত-চাড়া কি একটা খেলা হল? কোথায় ক্রিকেট আর কোথায় সাত-চাড়া!”
“খেলা তো খেলাই। যেটা খেলতে মজা লাগে সেটাই খেলা।”
“তোকে বলেছে!” পিয়াল মুখ শক্ত করে বলল, “কোনোদিন শুনেছিস সাত চাড়া টুর্নামেন্ট হচ্ছে? শুনেছিস ওয়ার্ল্ড কাপ হচ্ছে সাত-চাড়া খেলায়?”
গাব্বু হিহি করে হাসতে হাসতে বলল, “সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ! হি হি হি!”
পিয়াল বলল, “বুকের পাটা থাকে তো আয় ক্রিকেট খেলতে। টেনিস বল না, একেবারে খাঁটি ক্রিকেট বল!”
সুমি কোমরে হাত দিয়ে বলল, “কী ভাবছিস? আমি পারব না?”
সুমির সাথে আরও কয়েকজন মেয়ে ছিল, তাদের একজন বলল, “থাক বাবা দরকার নেই। চল যাই আমরা আমাদের খেলা খেলি।”
সুমি চোখে আগুন ঢেলে বলল, “আমরা মাঠে আগে এসেছি আমরা খেলব।”
মেয়েটা নরম গলায় বলল, “থাক সুমি। ছেড়ে দে। ঝগড়া করে কী লাভ? আয়, আমরা ওইপাশে চলে যাই।”
“ফাজলেমি নাকি? কক্ষনো না।”
“আয়, আয়। ছেলেদের সাথে ঝগড়া করে কী লাভ! আমাদের তো বেশি জায়গাও লাগবে না!”
সুমি আরও কী-একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অন্য মেয়েরা তাকে টেনে সরিয়ে নিল। গাব্বু হা হা করে হেসে বলল”সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ! সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ!”
পিয়াল চেঁচিয়ে বলল, “সাত-চাড়া চ্যাম্পিওন সুমি!”
বুবুন একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “কেন তোমরা ওকে জ্বালাচ্ছ? ও তো ঠিকই বলেছে। ওরা আগে এসেছে ওদেরই তো খেলার কথা!”
“ধুর! মেয়েরা আবার কী খেলবে?”
“একসাথে সাত-চাড়া খেললেই হত। আমার তো ভালোই লাগে সাত-চাড়া খেলতে।”
“ভলো লাগে”
“ধুর!” গাব্বু হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে দল ভাগাভাগি শুরু করে দিল।
কিছুক্ষণের মাঝেই খেলা শুরু হয়ে গেল। পিয়াল ব্যাট করতে নেমেছে, গাব্বু উইকেট কিপার। ফরসামতন হালকা-পাতলা একটা ছেলে ছুটে এসে বল করল। পিয়াল বড় হয়ে দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, শরীর ঘুরিয়ে মারতেই বল উড়ে গেল আকাশে, সবাই অবাক হয়ে দেখল ঘুরতে ঘুরতে নেমে এসে লাগল জানালার কাঁচে। শক্ত জানালার কাঁচ–ক্রিকেট বল পর্যন্ত ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। আতঙ্কে আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি মাত্র বুক থেকে বের করেছে ঠিক তখন কথা নেই বার্তা নেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল জানালার কাঁচ।
পিয়াল রক্তশূন্য মুখে বলল, “সর্বনাশ!”
গাব্বু বলল, “পালা।”
কথা শেষ হবার আগেই ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে সবাই উধাও হয়ে গেল। দৌড়ে পালাতে বুবুনের কেমন জানি লজ্জা করছিল, কিন্তু যখন অন্য সবাই পালিয়ে গেছে তখন একা দাঁড়িয়ে থাকা মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বুবুন ঠিক যখন দৌড় দেবে তখন ভাঙা জানালা দিয়ে পাহাড়ের মতো একজন মানুষের মাথা উঁকি দিল, মানুষটির পিয়ালের মতো বোচা নাক এবং উঁচু কপাল, দেখেই বোঝা যায় তার বাবা। বুবুন আর দৌড়ানোর সাহস পেল না, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
মানুষটি ভাঙা জানালা দিয়ে মাথা বের করে একটা হুংকার দিয়ে বলল, “কে কাঁচ ভেঙেছে?”
মেয়েদের সবাই কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল, এই মানুষটাকে শুধু পিয়াল নয়, মনে হয় সবাই ভয় পায়। মানুষটা চোখ পাকিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আরও জোরে হুংহার দিয়ে বলল, “কে ভেঙেছে?”
সুমি সাত-চাড়া খেলার টেনিস বল হাতে নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমরা দেখি নাই চাচা।”
“দেখ নাই মানে? তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছ না?”
“না চাচা, আমরা তো খেলছিলাম?”
“পিয়াল হারামজাদা কই? নিশ্চয়ই পিয়াল–ক্রিকেট বল দিয়ে—”
সুমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না চাচা, আজকে কেউ ক্রিকেট খেলছে না। সবাই মিলে সাত-চাড়া খেলছি।” সুমি বুবুনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তা-ই বুবুন?”