জাহিদ চাচার কথা শুনে আম্মা হাসতে লাগলেন বুবুন অবিশ্যি ঠিক বুঝতে পারল না কোর্ট ম্যারেজ করার সাথে গুলি করে মেরে ফেলার সম্পর্কটা কী। খেতে খেতে বুবুন একসময় জিজ্ঞেস করল, “চাচা, এখানে দেখার মতো কিছু আছে?”
জাহিদ চাচা মাথা নাড়লেন, নাই। কিছু নাই। এই পোড়া জায়গায় বিখ্যাত বলতে রয়েছে খবিরউদ্দিন।
আম্মা হেসে ফেললেন, বুবুন জিজ্ঞেস করল, ”খবিরউদ্দিন কে?”
জাহিদ চাচা অনেকটা বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে বললেন, “উনিশ শো একাত্তর সালের রাজাকার কমান্ডার, জামাতে ইসলামীর লিডার এনজিও বিরোধী, নারীশিক্ষা বিরোধী, ধর্মব্যবসায়ী রগকাটা নেতা–”
আম্মা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, “এত বড় বিখ্যাত জিনিস আমরা দেখতে যাব না?”
“আপনাকে দেখতে যেতে হবে না ডক্টর রওশান। খবিরউদ্দিন যখন খবর পাবে আপনি মেয়েদের স্কুলের প্রোগ্রাম নিয়ে এসেছেন তখন সে নিজেই তার দলবল লাঠিসোটা নিয়ে আপনাকে দেখতে আসবে।”
“ভেরি গুড! তা হলে তো দেখা হবেই।”
“হ্যাঁ। আর এখানকার দ্বিতীয় বিখ্যাত জিনিস হচ্ছে মোষের দই।”
বুবুন অবাক হয়ে বলল, “মোষের দই! মোষকে কেমন করে দই বানায়?”
“মোষকে তো সোজাসুজি দই বানানো যায় না–এত বড় একটা প্রাণী, শিং টিং থাকে তাকে ঘটানোও ঠিক নয়। তাই প্রথমে নেয়া হয় মোষের দুধ। সেটা থেকে হয় দই।”
বুবুন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আমি কি তাই বলছি নাকি?”
জাহিদ চাচা বুবুনের চুলগুলো একটু এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, “আমি জানি বুবুন–তোমার সাথে একটু ঠাট্টা করছি। এই মোষের দুধ অত্যন্ত বিখ্যাত, অনেক দূর থেকে মানুষেরা মোষের দই নিতে আসে। জিনিসটাতে বোটকা একধরনের গন্ধ, একই সাথে সেটা টক মিষ্টি এং ঝাল। বিক্রি হয় বড় মালশা করে। এক চামচ মুখে দিয়ে মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে এরকম ঘটনা শোনা যায়।”
আম্মা টেবিলের উপর প্যাকেটটা দেখিয়ে বললেন, “আপনার ঐ প্যাকেটে তাই আছে?”
“আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপনাদের জন্যে এক মালশা বিখ্যাত মোষের দই নিয়ে এসেছি। যদি সাহস থাকে খাবার পর এক চামচ করে খেয়ে দেখবেন!”
বুবুন নাক কুঁচকে বলল, “আমার এত সাহস নাই বাবা, আমি খাচ্ছি না।”
“এই এলাকার এত বিখ্যাত একটা জিনিস না খেলে কেমন করে হবে? তা ছাড়া তুমি যখন স্কুলে যাবে তখন তো খেতেই হবে।”
বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“শুনেছি তোমাদের স্কুলে নাকি টিফিন দেওয়া হয় মোষের দই।”
“মোষের দই? স্কুলের টিফিন?”
“হ্যাঁ–”
”কেন?”
“চরিত্রের দৃঢ়তা বাড়ানোর জন্যে। স্কুলের নিয়ম-কানুন তো খুব কড়া।”
“কড়া?”
“হ্যাঁ, ড্রিল টিচার হচ্ছে একজন সুবেদার। দুপুরবেলা পাকা একঘণ্টা পিটি,তারপর পাঁচ কিলোমিটার দৌড়।”
“পাঁ-পাঁচ কিলোমিটার?”
“হুম। প্রিন্সিপালও খুব কড়া মানুষ। ডিসিপ্লিন রাখার জন্য গত বছর থেকে বেত মারার নিয়ম করেছেন।”
“বেত?” বুবুন প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।
“হুঁ। বেত মারা শুরু করার পর পড়াশোনার মান বেড়ে গেছে। গত বছর এস. এস. সি.-তে দুইজন স্ট্যান্ড করেছে।
“তাই বলে বেত?”
“ছাত্রেরা পছন্দ না করলেও গার্জিয়ানরা খুব পছন্দ করছে। আজকাল হোমওয়ার্ক আর মিস হয় না। হোমওয়ার্ক না পারলে বেত, পড়া না পারলে বেত আর দুষ্টুমি করলে তো কথাই নেই–রীতিমতো চাবুক। গত সপ্তাহে একটা ছেলেকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল।”
“হা-হাসপাতাল?”
“বেশি কিছু হয়নি। শুধু পাঁজরের একটা হাড় ভেঙে গিয়েছিল।”
বুবুন ফ্যাকাশে মুখে আম্মার দিকে তাকাল, দেখল আম্মা মুখ টিপে হাসছেন এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল জাহিদ চাচা ঠাট্টা করছেন। তাকে এমনভাবে বোকা বানিয়েছেন জাহিদ চাচা-বুবুন হঠাৎ খুব লজ্জা পেয়ে গেল। জাহিদ চাচা হা হা করে হাসতে হাসতে বুবুনের মাথায় হাত বুলিয়ে তার চুলগুলি এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, “ইয়ংম্যান, তোমার কোনো ভয় নেই। এই স্কুলের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসরা অসম্ভব প্রগ্রেসিভ। কেউ কবি, কেউ দার্শনিক, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রফেসর, অর্ধেকের বেশি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা। খুব ভালো স্কুল তোমার। ছোট থাকতে আমি যদি এরকম ভালো একটা স্কুলে পড়তে পারতাম তা হলে আমি হয়তো তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট হতাম।”
আম্মা বললেন, “আপনি যদি আমাকে ব্রিলিয়ান্ট বলেন তা হলে স্বীকার করতেই হবে আপনি মানুষটা বেশি বুদ্ধিমান না।”
জাহিদ চাচা বললেন, “আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি আসলেই একটু গাধা টাইপের।”
বুবুন আড়চোখে তাকাল, জাহিদ চাচা মোটেই গাধা টাইপের না, ইনি সাংঘাতিক মানুষ। ইশ! তার যদি জাহিদ চাচার মতো একটা বাবা থাকত!
রাতে ঘুমানোর সময় বুবুন আম্মার কাছে এসে দাঁড়াল। আম্মা নাকের ডগায় একটা চশমা লাগিয়ে কী একটা পড়ছিলেন, বুবুনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে? কিছু বলবি?”
“হ্যাঁ”
“কী?”
“জাহিদ চাচার কি বিয়ে হয়েছে”
“না। কেন?”
“তুমি আগে বলো যে রেগে যাবে না কিংবা খপ করে আমার কান ধরে ফেলবে না।”
“কী বলছিস না শোনা পর্যন্ত আমি কোনো প্রতিজ্ঞা করছি না। আমাকে তুই এত বোকা পাসনি।”
“ঠিক আছে বলছি।” বুবুন একটা মুখ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বড় খালা, নানু তারা সবাই তোমাকে আবার—”
“আমাকে আবার?”
“বিয়ে করতে বলছে। তুমি করতে চাইলে করো আম্মা–আমি কিছু মনে করব না।”