“কেমন করে হল আম্মা?”
“জানি না।” আম্মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট একটা মানুষ ছিল। তোর জন্মের কিছুদিন পর থেকে মাঝে মাঝে বলত মাথায় ব্যথা করে। ভোতা একরকমের ব্যথা। ডাক্তারের কাছে যেতে চাইত না, অনেক ঠেলেঠুলে পাঠানো হল। ডাক্তার দেখেটেখে কিছু পেল না, বলল ক্যাট স্ক্যান করতে হবে। করতে চায় না–একরকম জোর করে পাঠানো হল। সেখানে ছোট একটা টিউমারের মতো দেখা গেল, কিন্তু সেটা কী সমস্যা ঠিক করে বলতে পারে না। বলল, বিদেশে নিয়ে যান।”
আম্মা একটু থামলেন, মনে হল এই অল্প কয়টা কথা বলেই কীরকম জানি ক্লান্ত হয়ে গেছেন। পেটের ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, “বিদেশে নেব, তার পয়সা কই? দুজনে মিলে চাকরি করে কোনোমতে সংসার চালাই। আর তোর আব্বার কীকরম একটা গো, বিদেশে যাবে না। বলে মরতে হলে। দেশের মাটিতে মরব।“
“ধার কর্জ করে কিছু টাকা জোগাড় করেছি। এর মাঝে দেখতে দেখতে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ হঠাৎ ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে, তখন ধরে রাখা যায় না। বাসা থেকে বের হয়ে যায়। কোথায় যায়, কী করে বুঝতে পারি না। একসময় দেখা গেল মানুষজনকে চিনতে পারছে না। বেশির ভাগ সময় ছটফট করছে–শুধু তোকে দেখলে শান্ত হয়ে যেত। তুই তখন ছোট ন্যাদা-ন্যাদা বাচ্চা। তোর আব্বার কাছে যাবার জন্যে খুব ব্যস্ত ছিলি। কিন্তু ডাক্তারেরা ভয় দেখাল, বলল, কাছে নেবেন না। হঠাৎ করে কিছু-একটা হয়ে যেতে পারে। আমিও নিই না–“
আম্মা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলেন। বুবুন এর আগে আম্মাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি, তার এত কষ্ট হতে লাগল যে সেটি আর বলার মতো নয়। আম্মাকে শান্ত করার জন্যে তাকে ধরে কিছু-একটা বলতে গিয়ে নিজেই ভেউভেউ করে কাঁদতে শুরু করল। আম্মা তখন নিজের চোখ মুছে বুবুনকে আদর করে বললেন, “কাঁদে না বোকা ছেলে!”
বুবুন কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমিও তো কাঁদছ!”
আম্মা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললেন, “হ্যাঁ। কিরকম বোকার মতো কেঁদে ফেললাম, দেখলি? হঠাৎ করে তোর আব্বার কথা মনে হয়ে” আম্মা আবার আকুল হয়ে কেঁদে উঠলেন।
ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। বুবুন আর তার আম্মা একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। আম্মা ন্যাপকিন দিয়ে চোখ মুছে বললেন, “দরজাটা খুলে দে। মনে হয় জাহিদ সাহেব এসেছেন।”
বুবুন দরজা খুলে দিল, সত্যিই তাই–জাহিদ চাচা। হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বুবুনকে দেখে হেসে বললেন, “কী খবর বুবুন?”
বুবুন জোর করে হাসিহাসি মুখ করে বলল, “ভালো।”
জাহিদ চাচা ভিতরে ঢুকে থতমত খেয়ে গেলেন, আম্মা তখনও মুখে আঁচলচাপা দিয়ে টেবিলে বসে আছেন, সামনে টেবিলে খোলা টিফিন-ক্যারিয়ার দৃশ্যটা মোটেও স্বাভাবিক না। জাহিদ চাচা চোখে একটা প্রশ্ন নিয়ে বুবুনের দিকে তাকালেন, বুবুন কি বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। জাহিদ চাচা হাতের প্যাকেটটা টেবিলের উপর রেখে অপরাধীর মতো বললেন, “আমার একটা বহুদিনের স্বভাব–সব জায়গায় আমি ভুল সময়ে হাজির হই।”
আম্মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মুখ তুলে বললেন, “আপনার দোষ কী? আপনি কেমন করে জানবেন আজ আমাদের ফ্যামিলির কান্নাকাটি করার সময়!”
“কান্নাকাটি?”
আম্মা সহজ গলায় বললেন, “বুবুন তার আব্বার কথা শুনতে চাইল। বলতে গিয়ে হঠাৎ এত ইমোশনাল হয়ে গেলাম–”
জাহিদ চাচার মুখে দুঃখের একটা ছাপ পড়ল, নরম গলায় বললেন, “আমি বুঝতে পারছি ডক্টর রওশান। একজন যে কতটুকু কষ্ট পেতে পারে, তার মাঝেও যে কতটুকু শক্ত থাকা যায় সেটা আপনাকে দিয়ে বোঝা যায়।”
আম্মা কিছু বললেন না। জাহিদ চাচা বললেন, “আমি দেখতে এসেছিলাম সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না–কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন ভুল সময়ে এসে গেছি! এখন যাই, পরে একসময় আসব।”
“এসেই যখন গিয়েছেন, বসুন।”
জাহিদ চাচা অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, “না ডক্টর রওশান, আমি এখন যাই। কোনো কোনো সময়ে মানুষের একা থাকার ইচ্ছে করে, তখন আপেশাপে অন্য কেউ থাকলে খুব যন্ত্রণা হয়। আপনারা কথা বলেন। ইট ইজ ইম্পর্ট্যান্ট। আমি পরে আসব।”
আম্মা বললেন, “ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আপনি বসুন।”
“আপনারা এখনও খাওয়া শুরু করেননি।”
“শুরু করে দেব। আপনিও আমাদের সাথে খেয়ে নিন। আপনি যত খাবার পাঠিয়েছেন সেটা দিয়ে তো প্রায় এক পল্টন খেয়ে নিতে পারবে।
জাহিদ চাচা লাফিয়ে উঠে বললেন, “না-না, সে কী করে হয়!”
জাহিদ চাচা সত্যিই চলে যেতে চাইছিলেন কিন্তু আম্মা কিছুতেই রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত খাবার টেবিলে তাকে বসতে হল। আম্মা প্লেটে খাবার তুলে দিলেন, খেতে খেতে জাহিদ চাচা বললেন, “বুঝলেন ডক্টর রওশান, আমি সবসময় সব জায়গায় উলটাপালটা সময়ে যাই। একবার অনেকদিন পর এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখি তারা স্বামী-স্ত্রী ফাটাফাটি ঝগড়া করে বসে আছে। বন্ধুর বউ কামড় দিয়ে বন্ধুর কানের লতির আধ ইঞ্চির মতো ছিঁড়ে ফেলেছে। রক্তারক্তি অবস্থা–আমি না পারি থাকতে না পারি যেতে!”
জাহিদ চাচার কথা শুনে আম্মা হাসতে হাসতে বিষম খেলেন। জাহিদ চাচা বললেন, “আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না? আরেকবার শোনেন কী হয়েছে। এক বাসায় গিয়ে দেখি বাসার বড় মেয়ে প্রাইভেট টিউটারকে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে ফেলেছে। ভদ্রলোক একটা দোনলা বন্দুক নিয়ে লাফাচ্ছেন–মেয়ে, মেয়ে-জামাই যাকেই দেখবেন তাকেই খুন করে ফেলবেন!”