বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী করেছে পিয়াল?”
“গত সপ্তাহে রান্নাঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এর আগের সপ্তাহে বাথরুমের পাইপ ফেটে পানি দিয়ে ভাসাভাসি। একবার ইলেকট্রিক শক দিয়ে তার আব্বাকে প্রায় মেরে ফেলেছিল।”
“সাপের ঘটনাটা বল–”
”হ্যাঁ। সাপ পুষতে গিয়ে—”
পিয়াল নামের ছেলেটা চোখ পাকিয়ে বলল, “এমনভাবে বলছিস যেন সব দোষ আমার!”
“তা হলে দোষ কার?”
“যে-কোনো গবেষণা করলে তার মাঝে একটা ইয়ে থাকে। যেটা জানিস না সেটা নিয়ে রেগে গিয়ে পিয়াল কথা শেষ করতে পারল না।
সুমি চোখ টিপে বলল, “পিয়াল হচ্ছে আমাদের সায়েন্টিস্ট। বদরাগি সায়েন্টিস্ট!”
“ইনডাকশান কয়েল দিয়ে এমন একটা ইলেকট্রনিক শক দেব একদিন তখন মজাটা টের পাবি।”
বুবুন জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাছে ইনডাকশান কয়েল আছে? গাড়ির কয়েল?”
“না। গাড়ির না।” পিয়াল চকচকে চোখে বলল, “তোমার আছে?”
“হ্যাঁ। চারটা ব্যাটারি দিলে একেবারে ছয় ইঞ্চির একটা স্পার্ক হয়!”
“ছয় ইঞ্চি? যাহ!”
“সত্যি! যখন টেলিভিশনে প্যানপ্যানানি বাংলা নাটক হত আমি স্পার্ক দিয়ে সবার নাটক দেখা বন্ধ করে দিতাম। কেউ বুঝতে পারত না। শেষে একদিন আম্মা ধরে ফেলেছিল। তারপর–”
“তারপর কী? রাম ধোলাই?”
“নাহ্, ঠিক রাম ধোলাই না–তবে যা একটা পালিশ দিলেন!”
সুমি বলল, “তোমার আম্মা তোমাকে পালিশ দিলেন? হতেই পারে না–”
বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেন হতেই পারে না?”
“তোমরা যখন এসেছ আমি দেখেছি, তোমার আম্মা দেখতে একেবারে সিনেমার নায়িকাঁদের মতো। যারা দেখতে এত সুন্দর তারা পালিশ দিতে পারে না।”
বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “খালি চেহারাটাই!”
“মানে?”
“মানে খালি চেহারাটাই ভালো। আম্মার কথাবার্তা হাবভাব একেবারে বাস কন্ডাক্টারদের মতো। দুধছাড়া চায়ের মতন কড়া মেজাজ।”
“সত্যি?”
“সত্যি না তো মিথ্যা? এই যে দ্যাখো আমার বাম কানটা ডান থেকে একটু লম্বা-আম্মা টেনে টেনে এটা লম্বা করে ফেলেছেন!”
বুবুনের কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল। বুবুন নিজেও হাসতে লাগল। নতুন জায়গায় এসে আশেপাশে ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচয় করা নিয়ে ভিতরে ভিতরে দুশ্চিন্তা ছিল। মনে হচ্ছে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বিশেষ করে পিয়ালের সাথে জমবে ভালো। দুজনে মিলে মনে হয় একটা রকেট তৈরি করা যেতে পারে। আশেপাশে ফাঁকা জায়গা আছে–রকেট উপরে না উঠে যদি পাশে যায় তা হলেও বড় সমস্যা নেই। নতুন জায়গায় এসে এই প্রথম বুবুনের বেশ ভালোই লাগতে থাকে।
০২. খবিরউদ্দিন ও মোষের দই
২. খবিরউদ্দিন ও মোষের দই
খাবার টেবিলে আম্মা টিফিন-ক্যারিয়ার থেকে খাবার বের করতে করতে বললেন, “পরিচয় হল সবার সাথে?”
“হয়েছে। একটা মেয়ে তার নাম হচ্ছে সুমি। সেই মেয়েটা–” বুবুন হঠাৎ থেমে গেল। বাঁশের ডগায় খবরের কাগজ বেঁধে আগুন ধরানোর কথাটা বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না।
“কী হয়েছে মেয়েটার?”
“নাহ্! কিছু না।” বুবুন প্লেটে ভাত নিতে নিতে বলল, “একটা ছেলে আছে। তার নাম পিয়াল। পিয়াল করেছে কি-বুবুন আবার থেমে গেল, পিয়াল যে তাদের বাসা প্রায় পুড়িয়ে দিয়েছিল কিংবা ইলেকট্রিক শক দিয়ে বাবাকে প্রায় মেরে ফেলেছিল সেটাও হয়তো বলা ঠিক হবে না।
“কী হয়েছে পিয়ালের?”
“নাহ্। কিছু হয় নি।”
আম্মা আড়চোখে বুবুনকে একবার দেখলেন, কিছু বললেন না। বুবুন ভাতের সাথে বিদঘুঁটে রকমের একটা সবজি মাখাতে মাখাতে বলল, “একটা ছেলে আছে, বেশি বড় না, ছোটখাটো সাইজ–তার নাম হচ্ছে গাব্ব–হি হি হি—”
“খুব যে হাসছিস? তোর নিজের নামটা কী?”
বুবুন মুখ শক্ত করে বলল, “সত্যিই আম্মা তোমরা আমার নাম বুবুন কেমন করে রাখলে?”
“আমি রাখিনি।”
“তা হলে কে রেখেছে?”
‘তোর আব্বা।” বুবুন লক্ষ করল খুব সাবধানে আম্মা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।
“আব্বা?”
“হুম।”
আম্মা কোনো কথা না বলে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। বুবুন পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বলল, “আব্বার কি মাথা খারাপ ছিল?”
আম্মা কিছুক্ষণ বুবুনের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ছিল।”
আম্মার গলায় ঠাট্টার কোনো চিহ্ন নেই–বুবুন কেমন জানি চমকে ওঠে। ভালো করে আম্মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী বললে আম্মা?”
“কথা না বলে এখন ভাত খা।”
“কিন্তু আম্মা–”
“কী?”
“আব্বার কথা কী বললে?”
“কিছু না–”
“বলো-না–”
আম্মা সোজা হয়ে বসে সোজাসুজি তাকালেন বুবুনের দিকে, তারপর কেমন যেন কঠিন গলায় বললেন, “ঠিক আছে বলব। তুই এখন বড় হয়েছিস, এখন হয়তো শুনতে পারবি। আসলেই শেষের দিকে তোর আব্বার মাখা-খারাপ হয়ে গিয়েছিল।”
“কেন?”
“ঠিক জানি না। মাথায় একটা টিউমারমতো হয়েছিল, ঠিক ডায়াগনসিস করার আগেই উধাও হয়ে গেল।”
“কোথায় আম্মা? কেমন করে?”
আম্মা কোনো কথা না বলে খানিকক্ষণ প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করলেন, তারপর মুখ তুলে বললেন, “সারারাত মাথার ব্যথায় ছটফট করল। ভোররাতে উঠে বসল, চোখ দুটি লাল, চুল এলোমোলো। আমার দিকে কীরকম অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, তুমি কে? আমি বললাম, মাসুদ তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? মাসুদ বলল, না। আমি তখন কাছে গেলাম, পায়ের শিকল ধরে–”
“পায়ের শিকল?”
আম্মা ন্যাপকিন দিয়ে সাবধানে চোখের কোনো মুছলেন, বললেন, “হ্যাঁ, একটা পা শিকল দিয়ে জানালার শিকের সাথে বাঁধা ছিল। মাঝে মাঝে ভায়োলেন্ট হয়ে ঘর থেকে চলে যেত, তাই।”