আব্বা পাথরের মতো শক্ত মুখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বন্দুকটা দাও।”
মানুষটা এক মুহূর্তে দ্বিধা করে আব্বার হাতে বন্দুকটা তুলে দিল। আব্বা সেটা হাতে নিয়ে হঠাৎ বুবুন আর সুমির দিকে ছুঁড়ে দিলেন। তারা প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা শূন্যে ধরে ফেলল। বুবুন আর সুমি কখনো বন্দুক ধরেনি, হাতে নিতেই তাদের বুকের মাঝে কেমন যেন করে ওঠে!
আব্বা আলগোছে বন্দুকটা ধরে রেখে বললেন, “সবাই লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়। সেভেন্টিওয়ানের রতনপুর ব্রিজে এক ডজন রাজাকার এইভাবে ধরেছিলাম আমরা। কেউ পালানোর চেষ্টা করো না! তোমরা জান আমার হাত থেকে কোনো রাজাকার কখনো পালাতে পারে নাই।”
মানুষগুলো ইতস্তত করে একজন একজন করে মেঝেতে শুয়ে পড়তে থাকে। খবিরউদ্দিন ফ্যাকাশে মুখে আব্বার দিকে তাকিয়েছিল, আব্বা বন্দুকের বাঁট দিয়ে তার মাথায় টোকা দিতেই সে ধড়মড় করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
সুমি দাঁড়িয়ে বলল চাচা, “ওদেরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলি?”
আব্বা হেসে ফেলে বললেন, “চাইলে বাঁধতে পার মা। কিন্তু ওরা পালাবে।”
“কেন পালাবে না চাচা?”
“কারণ ওদের পালানোর সাহস নেই। ওরা হচ্ছে পথ-কুকুর! পথ কুকুরের সামনে যখন কেউ সাহস করে দাঁড়ায় তখন ওদের সব সাহস উবে যায়।”
বুবুন বলল, “সুমি, বেঁধে ফ্যালো তবু। আমি বন্দুকটা ধরে রেখেছি, পালানোর চেষ্টা করলেই গুলি।”
আব্বা এসে বুবুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আজকের দিনের জন্যে ঠিক আছে কিন্তু বাবা আর কখানো যেন তোর বন্দুক ছুঁতে না হয়। কখানো যেন ছুঁতে না হয়। কখনো কখনো কখনো যেন ছুঁতে না হয়।”
বাইরে হঠাৎ কয়েকটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল। আব্বা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই, নিচু গলায় বললেন, “পুলিশ এসেছে বুবুন।”
“সত্যি? কেমন করে এল! আমরা তো ট্রান্সমিটারের সিগনাল দিতেই পারলাম না।”
‘ট্রান্সমিটার?”
“হ্যাঁ–” বুবুন ট্রান্সমিটারের গল্প শেষ করার আগে সিঁড়িতে ভারী বুটের শব্দ শোনা গেল, দড়াম করে দরজা খুলে হঠাৎ, সেখানে অসংখ্য পুলিশ।
পুলিশের ভিড় ঠেলে জাহিদ চাচা শঙ্কিত মুখে এগিয়ে এলেন, তার পিছনে পাংশু মুখে আম্মা। বুবুন আম্মার কাছে ছুটে যাচ্ছিল, সুমি খপ করে তার হাত ধরে ফেলল, “চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক গাধা! দেখি চাচা-চাচি কী করে!”
আম্মা প্রথমে বুবুনের দিকে তারপর আব্বার দিকে তাকালেন। আব্বার দিকে তাকিয়েই হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলেন, বিস্ফারিত চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বললেন, “মাসুদ!”
আব্বা এক পা এগিয়ে এসে আম্মাকে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বললেন, “রওশান! তুমি ভালো ছিলে রওশান?”
আম্মা হঠাৎ দুই হাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলেন। আব্বার বোতাম-ঘেঁড়া শার্ট ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন, “এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? কোথায় ছিলে আমাকে ছেড়ে?”
জাহিদ চাচা বুবুনের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বললেন, “ইয়ংম্যান! আমি বলেছি না তোমাকে, আমি সবসময় ভুল জায়গায় চলে যাই!”
বুবুন বলল, “চাচা, এইটা ভুল জায়গা না।”
জাহিদ চাচা বললেন, “ঠিক বলেছ! এটা ঠিক জায়গা, এটা ঠিক সময়। একেবারে হান্ড্রেট পার্সেন্ট ঠিক সময়।”
ঠিক এই সময় বুবুন আর সুমি দেখতে পেল, ভিড় ঠেলে গাব্বু আর পিয়াল আসছে। বুবুন আর সুমিকে দেখে তারা ছুটে এল। পিয়াল হেসে বলল, “পুলিশ নিয়ে এসেছি কি না?”
বুবুন অবাক হয়ে বলল, “তুই? তুই পুলিশ এনেছিস?”
“হ্যাঁ। আমি আর গাব্ব। যেই রেডিওতে শুনলাম কট কট–”
“রেডিওতে শুনলি?” বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে শুনলি আমি তো সিগনাল দিতেই পারলাম না। তার আগেই–”
সুমি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে বলল, “এ বেয়াদব মানুষটা মনে হয় ভুল করে অন করে ফেলেছিল।
“তাই হবে নিশ্চয়ই!” বুবুনও হাসতে শুরু করে।
হাসি জিনিসটা সংক্রামক, কিছুক্ষণের মাঝে চারজনই হাসতে শুরু করল। তাদের হাসি দেখে আম্মাও চোখ মুছে হঠাৎ একটুখানি হেসে ফেললেন।
আম্মা যখন হাসেন তখন তাকে যে কী সুন্দর দেখায়!
১৩. শেষ কথা
এলাকার মেয়েদের স্কুলগুলো ঠিক যেভাবে তৈরি হওয়ার কথা ছিল সেভাবে তৈরি হচ্ছে। আম্মা সারাদিন কাজ করেন আর রাতে নাকের উপর চশমা লাগিয়ে বসে বসে রিপোর্ট লিখেন। এই রিপোর্টগুলো অন্য এলাকায় ব্যবহার করা হবে। একাত্তরের জামাতি রাজাকারদের দিয়ে কী সমস্যা হতে পারে, তাদের কী কী জিনিস নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়, এইসবও নাকি রিপোর্টে লেখা হয়। তাদের ঠিকমতো শাস্তি কীভাবে দেওয়া যায়, জেল থেকে বের হবার পর তাদের নিয়ে কী করতে হবে এইসবও নাকি রিপোর্টে লেখা আছে। আম্মা যখন রিপোর্ট লেখেন তখন আব্বা টেবিলের অন্যপাশে গালে হাত দিয়ে বসে বসে আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বুবুন কাছে এলে তাকে টেনে এনে কানের মাঝে ফিসফিস করে বলেন, “দেখ, দেখ তোর আম্মাকে দেখ!”
“কী দেখব?”
“তোর আম্মাকে কেমন বদমেজাকি মাস্টারনির মতো দেখায় না?”
বুবুন ফিসফিস করে বলে, “আম্মা তো আসলেই বদমেজাজি মাস্টারনি–তাকে আর কীরকম লাগবে?”
আম্মা চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বলেন, “কী বললি? কী বললি বুবুন? কান ছিঁড়ে একেবারে ভ্যান গ বানিয়ে দেব।”
পাড়ার ছেলেমেয়েরা বিকেলবেলা হৈ-হুঁল্লোড় করে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, সাতচাড়া, কিং কুইন খেলে। তার সাথে নতুন একটা খেলা যোগ হয়েছে, যেখানে খবিরউদ্দিনের আস্তানায় আব্বার সেই ঘটনাটি তারা নিজেরা অভিনয় করে দেখায়।