সুমি হঠাৎ চিতাবাঘের মতো মানুষটার উপরে লাফিয়ে পড়ল, মানুষটার হাঁটুতে সে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মারতেই, “মাগো” বলে মানুষটা বুবুনকে ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ে।
খবিরউদ্দিনকে ঘিরে থাকা অন্য মানুষগুলো শাহবাজ আলির কাছে ছুটে আসে, সে দুইজনের কাছে বন্দুক ছিল তারা বন্দুক দুটি বুবুন আর সুমির দিকে তাক করল, মুখ দেখে মনে হল বুঝি সত্যি সত্যি গুলি করে দেবে।
আব্বা হঠাৎ আবার উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে কিছু-একটা বলছেন, কী বলছেন ঠিক বোঝা গেল না। খবিরউদ্দিন আব্বার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “তুমি দাঁড়িয়েছ কেন? বসো।”
আব্বা বসলেন না, “দাঁড়িয়েই রইলেন। সবগুলো মানুষের দিকে একবার তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “যখনি–”
“কী?” খবিরউদ্দিন ধমক দিয়ে বলল, “কী বলছ?”
“যখনি–”
“যখনি কী?”
“যখনি দাঁড়াবে তুমি–”
খবিরউদ্দিন চোখ বড় বড় করে আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল, বোঝার চেষ্টা করল আব্বা কী বলছেন। আব্বা আবার বললেন, কবিতা আবৃত্তির সুরে, তাঁর সুন্দর গলা সারা ঘরে হঠাৎ গম গম করে উঠল,
“যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে
পথ কুকুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবি মিশে।”
বুবুন চমকে উঠে আব্বার দিকে তাকাল, এ কোন আব্বা? ছেলেমানুষি ভঙ্গি জবুথবু হয়ে বসে থাকা, কিছুই তো নেই তার মাঝে! কী সুন্দর বুক উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, চেহারায় কী আশ্চর্য পৌরুষ, চোখেমুখে কী ভয়ংকর আত্মবিশ্বাস। বুবুন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না।
খবিরউদ্দিন গদিওয়ালা চেয়ার থেকে ছটফট করে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বলল, “কী? কী বলছ তুমি?”
“রবি ঠাকুরের কবিতা। একশো বছর আগে লিখে গিয়েছিলেন।” আব্বা হাত তুলে আঙুল দিয়ে তাদের দেখিয়ে বললেন, “তোমাদের কথা লিখেছেন। তোমরা হচ্ছ পথ-কুকুর! তোমাদের সামনে আমরা যখন দাঁড়াই তখন তোমরা সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে!”
বুবুন হতচকিত হয়ে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল। সুমি বুবুনের হাত ধরে বলল, “চাচা ভালো হয়ে গেছেন! কী দারুণ দেখছিস?”
খবিরউদ্দিন চিৎকার করে বলল, “ধর এই লোকটাকে। বেঁধে ফেল।”
আব্বার মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, খবিরউদ্দিন যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে এরকম ভঙ্গি করে বললেন, “আমাকে ধরবে? তোমরা?”
খবিরউদ্দিন আবার চিৎকার করে উঠল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন বেকুবের দল?”
বন্দুক-হাতের মানুষ দুইজন এবারে আব্বার দিকে বন্দুক তাক করল, একজন মোটা গলায় বলল, “খামোশ। গুলি করে দেব।”
আব্বা এবারে সত্যি সত্যি হেসে ফেললেন। তারপর চোখ মটকে বললেন, “গুলি করবে? তুমি? এই চামচিৎকার দল আমাকে গুলি করবে?”
মানুষগুলো হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আব্বা বললেন, “তুমি জান আমি যখন মুক্তিযুদ্ধে গেছি আমার বয়স তখন মোলো।” আব্বা তাঁর হাত দুটি উপরে তুলে বললেন”এই হাতে আমি মেশিনগানে গুলি করেছি, পাকিস্তানিদের বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়েছি। শুধু তোমাদের মতো চামচিকা রাজাকাররা না, তোমাদের বাবা পাকিস্তানি মিলিটারিরাও আমাকে মারতে পারেনি। কেন পারেনি জান?”
মানুষগুলো জানতে চাইছে কি না বোঝা গেল না, আব্বা সেটা লক্ষ্যও করলেন না, বললেন, “পারেনি তার কারণ আল্লাহ্ আমার দিকে ছিলেন! আল্লাহ্ মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ছিলেন। আল্লাহ্ যদি তোমাদের দিকে থাকতেন তা হলে সেভেন্টিওয়ানে তোমরা জিততে। তোমরা জেতনি। তোমরা কোনোদিন জিতবে না–“
খবিরউদ্দিন দাঁড়িয়ে গেল, কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন শুওরের বাচ্চা? থামা একে।”
বন্দুক-হাতের মানুষটা বন্দুক তুলে এবারে চিৎকার করে বলল, “চুপ কর গাদ্দার। গুলি করে দেব।”
আব্বার চোখ হঠাৎ ধ্বক করে জ্বলে উঠল। টান দিয়ে শার্টের বোতাম ছিঁড়ে আব্বা তার বুকটা বের করে ফেললেন, যে-মানুষটা বন্দুক ধরে রেখেছিল তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “করো গুলি।”
মানুষটা নিষ্ঠুর চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে ট্রিগারে হাত দিল। আব্বা আরও এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “দেখি তোমার কত বড় সাহস! করো দেখি গুলি!” আব্বা চিৎকার করে বললেন, “করো দেখি!”
বুবুন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল, মানুষটির নিষ্ঠুর মুখ বিচিত্র একধরনের জিঘাংসায়ে কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে। আব্বার মুখে এতটুকু ভয় নেই। ভয়ংকর এক আত্মবিশ্বাস নিয়ে আব্বা আরও এক পা এগিয়ে গেলেন। বুবুন দেখতে পেল মানুষটা ট্রিগার টেনে ধরছে, সত্যিই কি গুলি করে দেবে মানুষটা? আতঙ্কে বুবুনের হৃৎস্পন্দন থেমে আসতে চায়। তাকিয়ে থাকতে পারে না সে, আর্তচিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঠিক তখন প্রচণ্ড একটা গুলির শব্দে সমস্ত ঘর কেঁপে উঠল। বুবুন দুই হাতে মুখ ঢেকে রক্ত-শীতল-করা স্বরে চিৎকার করে উঠল। মানুষটা কি মেরে ফেলেছে আব্বাকে? তার দুঃসাহসী আব্বাকে?”
হঠাৎ করে কে যেন তার কাঁধ স্পর্শ করল, বুবুন শুনল সুমি ডাকছে তাকে, “বুবুন, তাকিয়ে দ্যাখ।”
বুবুন ভয়ে ভয়ে তাকাল, দেখল তার আব্বা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। এক হাতে বন্দুক অন্য হাতে মানুষটার শার্টের কলার ধরে রেখেছেন। আব্বা তার কলার ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ময়লা আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। আরো দুজন মানুষে নিয়ে সে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল। আব্বা তখন ঘুরে তাকালেন বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নম্বর মানুষটা দিকে। আব্বা আলগোছে বন্দুকটা ধরে রেখেছেন, কী সহজেই-না সেটা হাতবদল করলেন, কেউ বলে দেয়নি কিন্তু কার বুঝতে এতটুকু দেরি হল না দুই যুগ আগে যেভাবে তাঁর হাতে অস্ত্র গর্জন করেছিল দরকার হলে ঠিক সেভাবে আবার তাঁর হাতে বন্দুক গর্জন করে উঠবে।