হেঁটে হেঁটে কাছে এল মানুষটা। মুখে দাড়ি মাথায় টুপি। গায়ে লম্বা আচকান, হাতে একটা লাঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে মানুষটা কাছে এসে দাঁড়াল। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু বুবুন জানে এই মানুষটা খবিরউদ্দিন। মানুষটা খসখসে গলায় বলল, “ধর এইগুলোরে। ভিতরে নে।”
দুজন মানুষ এসে খপ করে বুবুন আর সুমিকে ধরল, সুমি এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করতেই তার মাথায় টুপি খুলে লম্বা চুল বের হয়ে আসে।
সুমিকে ধরে-রাখা মানুষটা চোখ বড় বড় করে বলল, “নাউজুবিল্লাহ্! এইটা দেখি মাইয়া!”
খবিরউদ্দিন দাঁতে দাঁত ঘঁষে বলল, “মাইয়া আর পোলা আমি বুঝি না, ভিতরে নে আগে।”
প্রথমে আব্বা তার পিছনে সুমি এবং সবার পিছনে বুবুনকে ধরে লোকগুলো ভিতরে রওনা দেয়।
বুবুন মাথা ঘুরিয়ে লোকগুলোকে দেখল। এটা কি সত্যিই ঘটছে নাকি এটা একটা দুঃস্বপ্ন?
১২. পথ-কুক্কুর
আব্বা একটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আছেন। বুবুন আর সুমি আব্বার পিছনে ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খবির উদ্দিনের জন্য একটা গদিওয়ালা চেয়ার আনা হয়েছে, সেখানে সে দুই পা ছড়িয়ে কুৎসিত ভঙ্গিতে বসে আছে। তাকে ঘিরে আটজন মানুষ। মানুষগুলোর একেকজনের চেহারা একেক রকম কিন্তু তবু কোথায় জানি একটা মিল রয়েছে। নিষ্ঠুরতার মনে হয় নিজস্ব একটা রূপ আছে।
ইঁদুরের মতো চেহারার মানুষটা এইমাত্র ঠিক কী ঘটেছে তার একটা বর্ণনা দিল, তাদেরকে যে কীভাবে বোকা বানানো হয়েছে সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করে লাভ হল না, তার গল্প থেকেই সেটা প্রকাশ হয়ে গেল। সবকিছু শুনে খবিরউদ্দিন মুখ শক্ত করে বলল, “কিন্তু এই পোলা আর মাইয়া এইখানে আসল কেমন করে?”
মানুষটা মাথা চুলকে বলল, “তা তো জানি না!”
খবিরউদ্দিন খেঁকিয়ে উঠে বলল, “সেটা না জানলে চলবে কেমন করে? সাথে যদি আরও কিছু পোলা-মাইয়া এসে থাকে? তারা যদি এখন পুলিশকে খবর দেয়?”
ইঁদুরের মতো মানুষটা হলুদ দাঁত বের করে হিহি করে হেসে ফেলল, “হুজুর যে কী বলেন! পুলিশকে বললেই কি আসবে? আমরা তা হলে মাসে মাসে তাদেরকে এত টাকা দেই কেন?”
“খামোশ!” খবিরউদ্দিন বিকট ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলবি না।”
রোমশ ভুরুর মানুষটা বলল, “হুজুর যদি অনুমতি দেন তা হলে এদের পেটের মাঝে থেকে কথা বের করে ফেলি।”
খুব মজার একটা রসিকতা শুনেছে এরকম ভান করে খবিরউদ্দিন হা হা করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, “সেটা খারাপ হয় না! নে, বার কর। রক্ত ফক্ত দেখতে হবে না তো?”
“জে না। শাহবাজ আলির ছুরি চাকু লাগে না।”
ইঁদুরের মতো মানুষটা চোখ ছোট ছোট করে বলল, “শাহবাজ আলির কাজ এক নম্বর। মনে নাই নির্মূল কমিটির ছেলেটার হাত কবজির কাছে কীরকম আলগা করে ফেলল?”
শাহবাজ আলি নামের মানুষটা দাড়ির মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে কাটতে কাটতে এগিয়ে এল। লাল চোখ একবার বুবুনের দিকে তাকাল, তারপর সুমির দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলল, “এই শুওরের বাচ্চা হারামখোরেরা। তোরা নিজের থেকে বলবি নাকি এক চড় মেরে চোয়াল ভেঙে সব কয়টা দাঁত আলগা বরে ফেলব?”
বুবুনের মাথায় হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। সে তীব্র দৃষ্টিতে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের সাথে কথা বলতে চাইলে ভদ্রভাবে কথা বলবেন।”
ঘরের মাঝে হঠাৎ একটা আশ্চর্য ধরনের শীতলতা নেমে আসে। শাহবাজ আলির মুখটা ভয়ংকর হয়ে উঠল, সে হিস হিস করে বলল, “যদি না বলি তা হলে কী করবি শুওরের বাচ্চারা?”
বুবুন কী-একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সুমি বলল, “লাথি মেরে দাঁত ভেঙে দেব। কাছে আসো, তোমার দাড়ি যদি আমি টেনে না ছিঁড়ি–”
শাহবাজ আলি মনে হয় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, যে এরকম অবস্থায় একটা বাচ্চা তাকে এরকম কথা বলতে পারে! প্রচণ্ড রাগে কী করবে বুঝতে পারছিল না, মনে হল লাফিয়ে পড়ে তাদের টুটি চেপে ধরবে, ঠিক তখন খবিরউদ্দিন হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। তারপর মাথা ঘুরিয়ে বুবুন আর সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই পোলা আর মাইয়া, তোদের বাপ-মা আদব লেহাজ শেখায় নাই তোদের? মুরুব্বির সাথে কথা বলতে জানিস না?”
বুবুন আর সুমি কোনো কথা বলল না। খবিরউদ্দিন আবার বলল, “এত তেজ কোথা থেকে আসছে? বেশি তেজ যে স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো না সেটা জানিস না?”
আব্বা হঠাৎ কী-একটা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখ দেখে মনে হল কিছু-একটা নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে। খবিরউদ্দিন হঠাৎ কেমন যে, ভয় পেয়ে গেল, বলল, এই লোকটারে বেঁধে রাখিস নাই কেন?”
ইঁদুরের মতো দেখতে মানুষটা বলল, “হুজুর, এই মানুষটার বুদ্ধিশুদ্ধি কুত্তা বিলাইয়ের সমান। এরে বেঁধে রাখার কোনো দরকার নাই। এই দেখেন হুজুর—” মানুষটা এগিয়ে এসে আব্বাকে ধমক দিয়ে বলল, “তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো।”
আব্বা সাথে সাথে বসে গেলেন। ইঁদুরের মতো মানুষটা বলল, “দেখলেন হুজুর? এই লোকের মেরুদণ্ড নাই। পাগল-ছাগল মানুষ।”
শাহবাজ আলি তার পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে এক পা এগিয়ে এসে খবিরউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “হুজুর যদি অনুমতি দেন।”
খবিরউদ্দিন হাত নেড়ে অনুমতি দেবার ভান করল। সাথে সাথে শাহবাজ আলি একটা মোষের মতো ছুটে এসে বুবুনের চুল ধরে নিজের কাছে টেনে আনে। তারপর বুবুনের ডান হাতটা ধরে সেটাকে পেঁচিয়ে ধরতেই তার সারা শরীর ঘুরে হাতটা পিছনে চলে এল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বুবুন চিৎকার করে ওঠে, মনে হয় তার হাতটা বুঝি এক্ষুনি ভেঙে খুলে আসবে।