ইঁদুরের মতো দেখতে মানুষটি বলল, “কে? কে কাঁচ ভেঙেছে?”
“বেকুব ছেলেটা হবে নিশ্চয়ই।”
“দেখে আয় তো!”
“যাই।” বলে একজন মানুষ তাদেরকে যে-ঘরে আটকে রেখেছিল সেদিকে এগিয়ে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েই সে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “ঘরে কেউ নেই।”
ইঁদুরের মতো মানুষটা খেঁকিয়ে উঠে বলল, “কেউ নেই মানে? দরজায় তালা মারা আছে না?”
মানুষটা দরজার দিকে ভালো করে তাকাল, তালাটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল, বুবুন আর সুমি ভয় পাচ্ছিল যে দরজার কড়াটা বুঝি খুলে আসবে, কিন্তু কপাল ভাল, সেটা খুলল না। মানুষটা এবারে হতভম্বের মতো বলল, “দরজায় তালা মারা আছে, কিন্তু ভিতরে মানুষ নাই।”
“কী বলছিস ছাগলের মতো?” এবারে অন্য তিনজনও দরজার সামনে দাঁড়াল, ভিতরে উঁকি দিল এবং কাউকে না দেখে খুব অবাক হয়ে গেল।
ইঁদুরের মতো মানুষটা বলল, “তালাটা খুল দেখি!”
রোমশ ভুরুর মানুষটা পকেট থেকে চাবি বের করে তালাটা খুলে ভিতরে ঢুকল, তার পিছনে অন্যরাও।
সুমি বুবুনকে খোঁচা দিয়ে বলল, “এখন চল। তুই দরজাটা চেপে রাখবি আর আমি ছিটকানি লাগাব।”
বুবুন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, “ঠিক আছে।” যদি ওরা ঠিকমতো ছিটকানি লাগাতে না পারে তা হলে কী হবে বুবুন এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে আর ভাবতে চায় না।
বুবুন আর সুমি শুনতে পেল ঘরের ভিতর থেকে একজন বলছে, “এখানে পানি ফেলেছে কে?”
“জানি না। কিন্তু বের হল কোনদিক দিয়ে?”
“তাজ্জবের ব্যাপার! কুফুরী কালাম জানে নাকি?”
মানুষগুলো হেঁটে জানালার কাছে গিয়েছে, এই ফাঁকে বুবুন আর সুমি পা টিপে টিপে দরজা দড়াম করে বন্ধ করে দিল, বন্ধ করার আগের মুহূর্তে ইঁদুরের মতো চেহারার মানুষটা বুবুনকে দেখে ফেলে ছুটে আসতে গিয়ে মেঝেতে ঢেলে রাখা-সাবান পানিতে ভয়ংকর শব্দ করে পিছলে পড়ে। বুবুন প্রাণপণে দরজা চেপে রাখল এবং সুমি দ্রুত ছিটকানিটা তুলে দিল। ভিতরে আবার প্রচণ্ড একটা শব্দ হল, আরও কেউ নিশ্চয়ই আছাড় খেয়ে পড়েছে। সুমি আর বুবুন হাত তুলে একজন আরেকজনকে থাবা দিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। বুবুন বলল, “দেরি করে কাজ নেই, পালাও।”
“হ্যাঁ চল।”
আব্বাকে নিয়ে তারা যখন বারান্দা ধরে ছুটতে শুরু করেছে তখন শুনল দরজার দমাদম লাথি পড়ছে। শক্ত দরজায় শক্ত ছিটকানি কিন্তু চারজন মানুষের লাথি কতক্ষণ আটকাতে পারবে কে জানে!”
বাসার বাইরে বের হয়ে সুমি তার ব্যাগ থেকে তালা বের করে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। এখন দরজা ভেঙে বের হয়ে এলেও ক্ষতি নেই। এখান থেকে বের হবার জন্যে এবারে বাকি রয়েছে গেট। সাথে যদি আব্বা না থাকতেন তা হলে বুবুন আর সুমি দেয়াল টপকে পার হয়ে যেত, কিন্তু আব্বাকে নিয়ে তো আর সেটা করা যাবে না, গেট দিয়েই বের হতে হবে। গেটে যে-মানুষটা রয়েছে সে বাসার ভিতরে কী হয়েছে না হচ্ছে সেসব কিছু জানে বলে মনে হয় না।
সুমি আব্বাকে বলল, “চাচা, আপনি গেটের দিকে যান। গেট খোলা না থাকলে দারোয়ানকে বলবেন গেট খুলে দিতে।”
আব্বা কথাটা শুনলেন কি না কিংবা শুনলেও ঠিক বুঝতে পেরেছেন কি না বোঝা গেল না, কিন্তু মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেলেন। সুমি বুবুনকে নিয়ে অন্ধকারে লুকিয়ে গেল। বুবুন জিজ্ঞেন করল, “কী করবি এখন?”
সুমি ব্যাগ খুলে একটা চাকু বের করে বলল, “দারোয়ান যখন চাচার সাথে কথা বলবে তখন পিছন থেকে দারোয়ানের উপর লাফিয়ে পড়তে হবে, ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে গলায় চাকুটা ধরতে হবে। হিন্দি সিনেমাতে যেরকম করে”
“যদি ফেলতে না পারি?”
“ফেলতে হবে। আমরা পিছনে থাকব, দারোয়ান বুঝতেও পারবে না আমরা ছোট না বড়, ভয় পেয়ে শুয়ে থাকবে।”
বুবুন ঢোক গিলে বলল, “ঠিক আছে।”
“এত ভয় পাওয়ার কী আছে? গাব্বু আর পিয়াল গেটের ওইপাশে আছে না? ডাক দিলেই গেট টপকে চলে আসবে।
“তা ঠিক।”
আব্বা ততক্ষণে গেটের পাশে চলে এসেছেন। আব্বাকে দেখে শুকনোমতন একজন লোক বের হয়ে এল, সে বেশ অবাক হয়ে আব্বাকে দেখছে ঠিক তখন বুবুন আর সুমি পিছন থেকে মানুষটার উপরে লাফিয়ে পড়ল। এ-ধরনের একটা ব্যাপারের জন্যে মানুষটা একটুও প্রস্তুত ছিল না, ভয় পেয়ে ডাক ছেড়ে একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল। বুবুন চাকুটা গলার কাছে ধরে রেখে গলার স্বর যথা সম্ভব মোটা করে বলল, “খবরদার, নড়াচাড়া করলে কিন্তু জবাই করে ফেলব।”
সুমি হুংকার দিয়ে বলল, “গেটের চাবি কই?” মানুষটা চিচি করে বলল, “গেটে তালা দেওয়া নাই।”
বুবুন ব্যাগ থেকে দড়ি বের করে মানুষটার হাত বাঁধতে বাঁধতে বলল, “আব্বা গেট খুলে বাইরে চলে যাও।”
“বাইরে?”
“হ্যাঁ। দেখো সেখানে গাব্বু আর পিয়াল আছে।”
“ও।” আব্বা বেশ কষ্ট করে গেট খুললেন। দারোয়ানকে ততক্ষণে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সুমি বুবুনের দিকে দাঁত বের করে হেসে বলল, “অপারেশান সাকসেসফুল।”
“চলো পালাই।”
আব্বা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গেটের কাছে গাব্বু আর পিয়ালের দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল, তাদেরকে দেখা গেল না। বুবুন আব্বার হাত ধরে বলল, “আব্বা চলো যাই।”
আব্বা আস্তে আস্তে বললেন, “একটা গাড়ি আসছে।”
বুবুন চমকে উঠে সামনে তাকাল, সত্যি সত্যি একটা গাড়ি ছুটে আসছে এদিকে। সুমি আর বুবুন কী করবে বুঝতে পারছিল না, আব্বাকে নিয়ে লুকিয়ে পড়ার আগেই এদিকে তীব্র হেডলাইট পড়ল তাদের উপর। গাড়ি প্রচণ্ড বেগে কাছে ছুটে এসে হঠাৎ টায়ার পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে ব্রেক করল। কিছু বোঝার আগেই গাড়ির চারটা দরজা খুলে চারজন মানুষ লাফিয়ে নামল। হেডলাইটের তীব্র আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে আছে বলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু মানুষগুলোর হাতে বন্দুক। মানুষগুলো বন্দুক তাক করে আছে তাদের দিকে। গাড়ির পিছনের সিট থেকে আরও একজন মানুষ নামছে, ভালো করে দেখা যাচ্ছে না মানুষটাকে।