বুবুন কিছু বলল না, আব্বা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোর কি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল?”
“না আব্বা। তোমাকে ধরার জন্য মিথ্যা কথা বলেছে।”
আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “এরা মনে হয় খুব খারাপ মানুষ।”
এত দুঃখেও বুবুনের হাসি পেয়ে গেল, আব্বা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন যে এরা খুব খারাপ মানুষ! এরা সেই মানুষ যারা একাত্তর সালে রাজাকার আলবদর হয়ে পাকিস্তানিদের সাথে মানুষ খুন করেছে, যখন বুঝতে পেরেছে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে তখন দেশের সব ভালো ভালো প্রফেসর, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারকে খুন করেছে। এতদিন পরে আবার সেই একই জিনিস করতে চাইছে?
আব্বা ঘরের মাঝে খানিকক্ষণ পায়চারি করে ঘরের এক কোণায় চেয়ারে চুপ করে বসে রইলেন, তাকে কেমন জানি দুঃখী দেখাতে লাগল, মনে হতে লাগল কিছু-একটা বুঝতে পারছেন না।
বুবুন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল বাইরে কী হচ্ছে। সুমি এখনও বাইরে আছে সেটাই একমাত্র ভরসা। রোমশ ভুরুর মানুষটা দূরে কোথাও গিয়ে চিৎকার করে কারও সাথে কথা বলছে, মনে হয় টেলিফোনে কাউকে বুবুনের খবর দিচ্ছে। আরও কিছু মানুষ বাইরে হাঁটাহাঁটি করছে বলে মনে হল। বুবুন খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরের দিকে হেঁটে আসছিল হঠাৎ সুমির চাপা গলায় ডাক শুনতে পারল, “বুবুন! শুনে যা!”
বুবুন ছুটে গেল, “সুমি! এখানে এসেছিস তুই–ধরা পড়ে যাবি তো!”
সুমি কোনো কথা না বলে দ্রুত তার ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে হ্যাঁকস’টা বের করে বুবুনের হাতে দিল। ফিসফিস করে বলল, “নে, এইটা রাখ।”
“কী করব?”
“জানালার শিক নাহয় দরজার কড়া কিছু-একটা কেটে ফেল বের হওয়ার জন্যে।” সুমি হঠাৎ দূরে কোথাও তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কেউ আসছে, আমি গেলাম।”
সুমি গুঁড়ি মেরে সরে গেল, বুবুন হাতের হ্যাঁকস’টা ঘরের কোণায় একটা টেবিলের নিচে লুকিয়ে ফেলল। একটা মানুষ হেঁটে হেঁটে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দিল। বুবুন মানুষটাকে চিনতে পারল, ইঁদুরের মতো দেখতে সেই মানুষটা। দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে মানুষটা তার ময়লা হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, “পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে। ভেবেছিলাম খালি বড়টারে ধরব এখন দেখি ছোটটাও চলে এসেছে।”
বুবুন বিষদৃষ্টিতে মানুষটার দিতে তাকাল, কিছু বলল না। ইঁদুরের মতো মানুষটা আরও কিছুক্ষণ দরজার ফাঁক দিয়ে তাদের লক্ষ্য করে চলে গেল। মানুষটা সরে যেতেই বুবুন দরজার কাছে এসে কড়া দুটি লক্ষ করল। দুটি কড়া একত্র করে বাইরে বড় একটা তালা ঝুলছে। হ্যাঁকস দিয়ে বাইরের সেই তারটি কাটা খুব সহজ হবে না। কিন্তু কড়ার যে-অংশটা দরজা দিয়ে ভিতরে এসে একটা বল্টু দিয়ে দিয়ে লাগানো রয়েছে সেটা মনে হয় খুব সহজেই কেটে ফেলা যাবে। তখন কড়াটা ঠেলে বের করলেই ঘর থেকে বের হয়ে আসা যাবে। যদি আশেপাশে কেউ না থাকে তা হলে দরজা খুলে বের হয়ে যাওয়াও কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।
বুবুন কাজে লেগে গেল, হ্যাঁক’সটা দিয়ে কাটতে একধরনের শব্দ হয়। শব্দটা ঝিঁঝিপোকার কর্কশ ডাকের মতে, বাইরের ঝিঁঝিপোকার শব্দের সাথে সেটা বেশ মিলে গিয়েছে। বুবুন কী করছে আব্বা তীক্ষ্ণচোখে সেটা দেখতে লাগলেন কিন্তু সেটা নিয়ে ভালোমন্দ কিছুই বললেন না।
পাঁচ মিনিটের মাঝেই কড়াটার একটা অংশ খুলে এল, ইচ্ছে করলেই এখন বুবুন তার আব্বাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে পারে কিন্তু সে বের হল না। বুবুন কড়াটা ঠিক জায়গায় লাগিয়ে রাখল, বাইরে থেকে কেউ যেন বুঝতে না পারে যে এটা আসলে খুলে নেওয়া হয়েছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই সুমিকে আবার দেখা গেল। সে গুঁড়ি মেরে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বুবুন সাথে সাথে কড়াটা ঠেলে বের করে দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল। সুমি চারিদিকে তীক্ষ্ণচোখে তাকাতে তাকাতে ফিসফিস করে বলল, “দরজা খুলে ফেলেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“চল বের হয়ে আয় এখন। চাচাকে নিয়ে আয়।”
আব্বা কেমন জানি বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছেন না। বুবুন ফিসফিস করে বলল, “আব্বা, কোনো শব্দ করো না। আস্তে আস্তে বের হয়ে আসো।
আব্বা বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লেন। সুমি তার ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে ভিতর থেকে কী যেন মেঝেতে ঢেলে দিল। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “এটা কী?”
“সাবান পানি। পিছলে করার জন্যে।”
“পিছলে করে কী লাভ?”
“দেখবি একটু পরেই।”
সুমি দরজাটা বন্ধ করে আবার কাটা কড়াটা ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দিল, বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে দরজায় তালা লাগানো রয়েছে।
কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি তারা বাসার কোণায় সেই অন্ধকার অংশে গিয়ে লুকিয়ে গেল। আব্বা কেমন যেন শান্ত হয়ে গেছেন, মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। দুজনে মিলে প্রায় হাত ধরে টেনে তাঁকে সরিয়ে নিতে হল। অন্ধকারে লুকিয়ে গিয়ে বুবুন ফিসফিস করে বলল, “এখন কী করবে?”
“মানুষগুলিকে এই ঘরে আটকে ফেলতে হবে। তারপর পালাব।”
“কেমন করে আটকাবে?”
“যখন এই ঘরে ঢুকবে তখন বাইরে থেকে ছিটকানি লাগিয়ে দেব।”যদি না ঢোকে?”
“একশোবার ঢুকবে। এই দ্যাখ!” সুমি তার ব্যাগ থেকে একটা বড় ঢেলা বের করে হঠাৎ একটা জানালার দিকে ছুঁড়ে দিল, ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে পড়ল প্রচণ্ড শব্দে সাথে সাথে ঘর থেকে কয়েকজন মানুষ বের হয়ে এল। রোমশ ভুরুর মানুষটি, অন্যটি ইঁদুরের মতো চেহারার মানুষ, বাকি দুজনকে তারা আগে দেখেনি।