“যদি পড়ে যাই?”
“পড়ব কেন! যদি ভয় পাস তা হলে উপর থেকে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিই, সেই দড়ি বেয়ে নেমে যাব।”
“সেইটাই ভালো, তা হলে আবার দরকার পড়লে দড়ি বেয়ে উঠে যাব।”
দুজনে মিলে লম্বা খানিকটা দড়ি নিয়ে ছাদে পানির ট্যাংকের পাইপের সাথে বেঁধে নিচে ঝুলিয়ে দিল। দুই প্রস্থ দড়ির মাঝে মাঝে গিঁট বেঁধে দেওয়া আছে, তার মাঝে পা দিয়ে বুবুন আর সুমি বেশ সহজেই নিচে নেমে এল। বারান্দা দিয়ে হেঁটে দুজন বাসার এক অন্ধকার কোণায় লুকিয়ে পড়ল। বুবুনের বুক ধ্বক ধ্বক করে শব্দ করছে, সে ফিসফিস করে বলল, “এখন আব্বাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
“হ্যাঁ।”
“দুজনই একসাথে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি এখানে পাহারা দাও, আমি যাই।”
“ঠিক আছে। চাচাকে কীভাবে খুঁজে বের করবি?”
“আব্বা যদি থাকেন তা হলে নিশ্চয়ই কোনো ঘরে দরজা বন্ধ করে না হয় তালা মেরে রেখেছে।”
“তাই যেসব ঘর বাইরে থেকে বন্ধ থাকবে না হয় তালা মারা থাকবে সেখানে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করব কেউ আছে কি না।”
“ঠিক আছে। খুব সাবধান কিন্তু!”
“আমার ব্যাগটা রেখে গেলাম। এর মাঝে সব দরকারি জিনিসপত্র।”
“ঠিক আছে।”
বুবুন একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে অন্ধকার কোণা থেকে খুব সাবধানে বের হল। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে সে হাঁটতে থাকে। কোনো ঘর বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো থাকলে সে আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিয়ে চাপা গলায় আব্বাকে ডেকে দেখল। দরজা খোলা থাকলে বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ভিতরে কারও নড়াচড়ার বা নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যায় কি না। কোনো ঘরে তালা দেওয়া থাকলে সাবধানে দরজা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। বাসার একেবারে শেষ মাথায় একটা ঘরে বাতি জ্বলছে, ঘরের দরজায় তালা লাগানো, বুবুন দরজা ফাঁক করে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতেই ভিতর থেকে আব্বার গলার আওয়াজ শুনতে পেল, “কে?”
বুবুন উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে দরজায় মুখ লাগিয়ে চাপা গলায় বলল, “আব্বা আমি বুবুন।”
আব্বা ভিতর থেকে বললেন, “বুবুন, তুই এসেছিস? দরজাটা খোল, বাইরে থেকে কেন জানি বন্ধ করে রেখেছে।”
বুবুন আবার দরজায় মুখ লাগিয়ে চাপা গলায় বলল, “আব্বা, তুমি কোনো কথা বলো না, শুনতে পেলে বিপদ হয়ে যাবে।”
“ঠিক আছে বলব না।” আব্বা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “তোর কোনো বিপদ হয়নি তো?”
“না আব্বা হয়নি।” উত্তেজনায় বুবুনের সবকিছু গোলমাল হয়ে যেতে থাকে। শব্দ শুনে যদি কেউ চলে আসে? কিন্তু অন্যকিছু করার আগে তাকে তার ট্রান্সমিটারটা অন করতে হবে। সবচেয়ে প্রথমে গাঙ্কু আর পিয়ালকে খবর পাঠাতে হবে যে আব্বা এখানে আছে। তারপর শুধু অপেক্ষা করা।
বুবুন পকেট থেকে ট্রান্সমিটারটা বের করে সুইচটা অন করতে যাচ্ছিল হঠাৎ তার ঘাড়ের মাঝে বাঘের মতো থাবা দিয়ে কে যেন জাপটে পড়ল, হুংকার দিয়ে বলল, “তুই কে? ভিতরে কীভাবে ঢুকেছিস?”
বুবুন ভয়ানক চমকে উঠল, মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে রোমশ ভুরু কুচকুচে কালো দাড়ি আর লালচোখের একজন মানুষ। বুবুনের হাত থেকে ট্রান্সমিটারটা ছিনিয়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল, “এটা কী?”
বুবুন কোনো কথা না বলে প্রাণপণে চেষ্টা করল মানুষটার হাত থেকে ট্রান্সমিটারটা নিয়ে নিতে কিন্তু পারল না। মানুষটা বুবুনের চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে বলল, “তুই ভিতরে ঢুকেছিস কেমন করে?”
বুবুন কোনো কথা বলল না, যদি কোনোভাবে সুইচটা শুধু অন করে দিতে পারত তা হলেই গাব্বু আর পিয়ালের খবর চলে যেত। কিন্তু সেটা করতে পারল না। দুঃখে হতাশায় তার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল, মানুষটা হয়তো তাকে সত্যি সত্যি মেরেই ফেলবে–বুবুন আর কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছিল না। রোমশ ভুরু আর কুচকুচে কালো দাড়ির মানুষটা বুবুনের হাত ধরে কীভাবে জানি মোচড় দিতেই সেটা বাঁকা হয়ে পিছনের দিকে চলে গেল প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল বুবুন। আব্বা দরজা ধাক্কা দিয়ে বললেন, “কী হয়েছে বুবুন?”
বুবুন কোনো কথা বলতে পারল না, মানুষটা দাঁতে দাঁত ঘষে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “বল, ভিতরে ঢুকেছিস কেমন করে?”
কিছু-একটা বলতে হবে এখন, সত্যি কথা বললে সুমিও ধরা পড়ে যাবে, সত্যি কথা বলা যাবে না কিছুতেই। বুবুন কোনোমতে বলল, “একটা জানালা খোলা ছিল।”
“কোন জানালা?”
বুবুন অনিশ্চিতের মতো বলল, “ঐ তো ঐদিকে।”
মানুষটা কী যেন ভাবল এক সেকেন্ড তারপর পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে তালা খুলে বুবুনকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। বুবুন তাল হারিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিল, কোনোমতে উঠে বসে আব্বাকে দেখতে পেল। আব্বা খুব অবাক হয়ে বুবুনের দিকে তাকিয়ে আছেন, কাছে এসে তাকে ধরে তুলে তার শরীরের ধুলো ঝাড়তে লাগলেন, আব্বাকে দেখে মনে হতে লাগল এখন শরীর থেকে ধুলো ঝাড়াই সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার। আব্বা ধুলো ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথা পেয়েছিস বুবুন?”
বুবুন হাতে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে, এখনও কাঁধে এবং কনুইয়ে টনটন করছে। কিন্তু আব্বাকে সেটা বলে কী লাভ? মাথা নেড়ে বলল, “না আব্বা।”
আব্বা খুব চিন্তিত মুখে বললেন, “এরা কারা বুবুন? আমাকে বলল তোর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমাকে তাই নিতে এসেছে। আমি তাদের সাথে গেলাম আর তখন এই ঘরে এনে আটকে ফেলেছে। কিছু খেতেও দিচ্ছে না।”