“এতকিছু করতে হবে না। তুমি আমাকে সেই বাসাটা চিনিয়ে দাও, তা হলেই হবে।”
“কী করবে তুমি?”
“দেখব ভিতরে আব্বা আছেন কি না। পিয়ালের ট্রান্সমিটারটা নিয়ে যাব, যদি থাকেন সিগনাল দেব, আর তুমি বাসায় এসে খবর দেবে।”
গাব্বু বলল, “পিয়ালকেও নিতে হবে।”
“ওর আব্বা–”
“এরকম সময়ে আব্বাদের ভয় করলে হবে না। পিয়ালকে খবর দিলেই চলে আসবেই।”
গাব্বুর কথা সত্যি, পিয়ালকে বলামাত্র সে বাসার পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে এল। পিঠে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছে–তার ভিতরে টর্চলাইট, নাইলনের দড়ি, চাকু এরকম আরও নানাকরম জিনিস রয়েছে। বুবুনকে দেখে বলল, বুবুন, তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমরা চাচাকে ঠিক উদ্ধার করে ফেলব।”
সত্যি সত্যি কিছু করতে পারবে কি না কেউ জানে না কিন্তু পিয়ালের কথা শুনে হঠাৎ বুবুনের চোখে পানি এসে গেল।
গাব্বু বলল, “আমাদের খুব তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে। বাসায় যখন খোজাখুঁজি শুরু হবে তখন ধারেকাছে থাকলে বিপদ হয়ে যাবে।”
পিয়াল বলল, “আয় শেষবার দেখে নিই সবকিছু নেয়া হয়েছে কি না।”
গাব্বু বলল, “এইখানে দাঁড়িয়ে থাকিস না, হঠাৎ করে কেউ দেখে ফেলবে। আয় আরও সামনে যাই।”
ওরা তিনজন বুবুনদের বাসা পার হয়ে সুমিদের বাসায় কাছে চলে গেল। বাসায় সামনে পেয়ারা গাছটার নিচে বসে অন্ধকারে জিনিসপত্র হাতড়ে হাতড়ে দেখে আবার সবকিছু ব্যাগে ভরে রওনা দিয়ে দেয়–অনেকটা দূর যেতে হবে, পকেটে পয়সা থাকলে রিকশা করে যাওয়া যেত।
তারা তিনজন মাত্র কয়েক পা গিয়েছে হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, প্রচণ্ড আতঙ্কে ওরা প্রায় চিৎকার দিয়ে দিচ্ছিল, হঠাৎ করে দেখতে পেল মানুষটা সুমি!
গাব্বু বলল, “ও, তুই? ওহ্! কী ভয়টা পেয়েছিলাম!”
সুমি হেসে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস তোরা চোরের মতো? জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি গাছের নিচে বসে গুজগুজ করছিস, তখন বুঝতে পারলাম কিছু-একটা ব্যাপার আছে।”
পিয়াল গম্ভীর গলায় বলল, “আসলেই ব্যাপার আছে।”
পিয়ালের গলায় স্বর শুনে সুমি ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “কী ব্যাপার?”
“চাচাকে খবিরউদ্দিনের লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে।”
সুমি চাপা গলায় চিৎকার করে বলল, “কী বললি?”
“হ্যাঁ। আমরা তাই যাচ্ছি।”
“কী করবি তোরা?”
গাব্বু গম্ভীর গলায় বলল, “চাচাকে উদ্ধার করব।”
সুমি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “দাঁড়া, আমিও যাব।” গাব্বু চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই? তুই কেমন করে যাবি?”
“কেন, কী হয়েছে?”
“এই রাত্রে! একটা মেয়েমানুষ–”
”আমাকে মেয়েমানুষ বলবি তো ঘুসি মেরে নাক ভিতরে ঢুকিয়ে দেব।”
“মেয়েমানুষকে মেয়ে বলতে পারব না?”
পিয়াল বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ! ছেলে মেয়ে এইসব এখন রাখ দেখি।”
সুমি বলল, “তোরা দুই মিনিট দাঁড়া, আমি আসছি।”
“উঁহু। রাত্রিবেলা তোকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।”
“ঠিক আছে। আমাকে ছাড়া যাওয়ার চেষ্টা করে দেখ আমি কী করি।”
“কী করবি?”
”এক্ষুনি চিৎকার করে আমি সবাইকে বলে দেব।”
বুবুন বলল, “তুমি সত্যিই যেতে চাও?”
সুমি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমি যদি না যাই হলে তোমাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে।”
“কেন?”
“তোমাদের দলের মাঝে একজন থাকা দরকার যার মাথায় খানিকটা ঘিলু আছে, গায়ে জোর আছে আর বুকে সাহস আছে। তা ছাড়া
“তা ছাড়া কী?”
এরকম ব্যাপারে মানুষ যত বেশি থাকে তত ভালো। তোরা দাঁড়া আমি আসছি।”
বুবুন, গাব্বু আর পিয়াল দাঁড়িয়ে রইল, সত্যি কথা বলতে কি সুমি আসছে বলে হঠাৎ করে তাদের ভিতরে জোর খানিকটা বেড়ে গিয়েছে। সুমিকে খোদা নিশ্চয়ই ছেলে তৈরি করতে গিয়ে ভুল করে মেয়ে তৈরি করে ফেলেছে।
সুমি আসতে অবিশ্যি একটু দেরি করল, জিনসের প্যান্টের সাথে ঢলঢলে একটা টি-শার্ট পরে এসেছে, মাথায় বেসবল ক্যাপ, তার ভিতরে চুল ঢুকিয়ে রেখেছে, হঠাৎ দেখলে ছেলে মনে হয়। পিঠে একটা ব্যাগ-সেখানে নানা জিনিসপত্র।
.
শহরের শেষ মাথায় নির্জন এলাকাটায় পোঁছে বুবুন, গাবু, পিয়াল আর সুমি রিকশা থেকে নেমে পড়ল। বাকি জায়গাটা সাবধানে হেঁটে হেঁটে তারা অন্ধকার বাসাটার সামনে এসে হাজির হল। বাইরে থেকে মনে হয় ভিতরে কেউ নেই। চারিদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। খুব ভালো করে তাকালে অবিশ্যি দেখা যায় একটি দুটি ঘরে জানালার ফাঁক দিয়ে খুব অল্প আলো বের হয়ে আসছে। ওরা সাবধানে গেটটা কাটিয়ে দেয়ালের পাশে একটা গাছের নিচে এসে হাজির হল।
বুবুন ফিসফিস করে বলল, “পিয়াল, তোমার ট্রান্সমিটারটা আমাকে দাও। তোমরা বাইরে থেকে রেডিওটাতে কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করো। আমি যদি আব্বাকে পেয়ে যাই তা হলেই সিগনাল পাঠাব, সাথে সাথে বাসায় গিয়ে খবর দেবে।”
সুমি ফিসফিস করেই যেটুকু জোরে বলা যায় সেভাবে বলল, “তুই কেন ভিতরে যাচ্ছিস?”
“তা হলে কে যাবে? আমার আব্বা–”
“তোর আব্বা হয়েছে তো কী হয়েছে! দুইজন যাবে ভিতরে। দুইজন থাকবে বাইরে।”
গাব্বু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আমি আর বুবুন ভিতরে।”
‘উঁহু।” পিয়াল মাথা নাড়ল, “আমি আর বুবুন। আমি এই ট্রান্সমিটার তৈরি করেছি, আমি নিয়ে যাব ভিতরে।”
সুমি অধৈর্য হয়ে বলল, “এখন ঝগড়া করার সময় নাই, কে যাবে সেটা ঠিক হবে লটারি করে।”
“লটারি?”