মনে হল আম্মা কথাটা ঠিক বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যাগে ভরে নেব?”
“হ্যাঁ। আপনাকে আর বুবুনকে নিয়ে যাই। আজ রাতেই।”
“ওরা যেটা চাইছে?”
জাহিদ চাচা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, বললেন, হ্যাঁ। মানুষের সাথে মানুষ যুদ্ধ করতে পারে। জানোয়ারের সাথে কেউ যুদ্ধ করে না।”
“জানোয়ার?”
“হ্যাঁ। একাত্তরে ওরা আমার স্যারদের ধরে ধরে মেরেছে। ওরা মানুষ নয় ডক্টর রওশান। আপনাকে আমরা ঢাকায় রেখে আসব, মাসুদ সাহেবকে ছাড়িয়ে আনব, তারপর আমি দেখব ওই জানোয়ারের দলের কত বড় সাহস। কিন্তু এখন কোনোরকম ঝুঁকি নেব না। একটুও না। আপনি রেডি হয়ে নেন।”
‘কিন্তু ওরা তো আজ রাত পর্যন্ত সময় দিয়েছে।”
“তা দিয়েছে।” জাহিদ চাচা এক মুহূর্তে কী যেন চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে। আপনারা আজ রাতে রেডি থাকেন, কাল খুব ভোরে নিয়ে যাব।”
“আমি রেডি আছি।” আম্মা ফিসফিস করে বললেন, “আমার নতুন করে রেডি হতে হবে না।”
বুবুন ইতস্তত করে বলল, ‘জাহিদ চাচা!”
“কী, বুবুন?”
“আমার মনে হয় আব্বাকে কোথায় ধরে নিয়েছে আমরা জানি।”
জাহিদ চাচা এবং আম্মা ভয়ানকভাবে চমকে উঠলেন।”কী বললে?” জাহিদ চাচা দুই পা এগিয়ে এসে বললেন, “কী বললে তুমি?”
“আমাকে যারা ধরতে চেষ্টা করেছিল–আমার বন্ধুরা তাদের আস্তানা দেখে এসেছে।”
“তাদের আস্তানা?” জাহিদ চাচা আশাভঙ্গের একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তাদের আস্তানা তো অনেক। কোনটা দেখেছে?”
“আমি জানি না, জিজ্ঞেস করে আসব?”
“না না। জানাজানি করা যাবে না। আমরা একেবারে কোনো রিস্ক নেব না। কাল ভোরে তোমরা ঢাকা যাবে, তোমার আব্বাকে ছাড়িয়ে আনা হবে তারপর।”
“কিন্তু পুলিশ নিয়ে যদি সেই জায়গায় যান?”
“এখন পুলিশকে বলা ঠিক হবে না। একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর হলেই শুধু বলা যায়–কিন্তু শুধু সন্দেহ হলে হবে না।” জাহিদ চাচা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “হবে না। তুমি জান না এরা কী ভয়ানক মানুষ। যদি গিয়ে দেখা যায় তোমরা ভুল করেছ, তোমার আব্বা সেখানে নেই? সর্বনাশ হয়ে যাবে!”
আব্বার ঘরে গিয়ে বুবুনের চোখে একেবারে পানি এসে গেল, তার একেবারে ছেলেমানুষের আব্বাটি এখন না জানি কী ভয় পাচ্ছেন–তাকে না জানি কীভাবে অত্যাচার করছে। তাকে কীভাবে রেখেছে, কী খেতে দিয়েছে কে জানে! বুবুন ঘরের মাঝখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে আর হঠাৎ করে ধর্মের নামে যারা এত বড় অন্যায় কাজ করতে পারে তাদের উপর রাগে, ঘৃণায় তার প্রায় বমি এসে যেতে চায়। কী ভয়ানক খারাপ মানুষ এরা অথচ তারা যেটা চাইছে সেটাই হবে? আম্মা চলে যাবার পর আনন্দে তারা নিশ্চয়ই নাচানাচি করবে, মেয়েদের স্কুলগুলি জ্বালিয়ে দেবে আর আবার যদি কেউ এসে কিছু করতে চায় তার বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে নেবে। এটা কেমন করে হয়?
বুবুন ঘরের মাঝখানে থেকে হেঁটে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল, যদি কোনোভাবে খবিরউদ্দিনের আস্তানায় গিয়ে দেখা যেত আব্বাকে সেখানেই আটকে রেখেছে তা হলেই তো পুলিশ নিয়ে আসা যাবে। জাহিদ চাচা বলেছেন, হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর হতে হবে–সেটাই কি করা যায় না? খবিরউদ্দিনের আস্তানায় গিয়ে হাজির হওয়া যায় না?
বুবুন হঠাৎ চমকে উঠল, পিয়ালের সেই ট্রান্সমিটার দিয়ে ভেতর থেকে বাইরে খবর পাঠানো যায় না? একটামাত্র খবর দরকার, আব্বা সেখানে আছেন কি নেই। সেটা বের করা কি এতই কঠিন? সে একা পারবে না, তার সাথে আরও একজনকে নিতে হবে, পিয়াল কিংবা গাব্ব। একজন যাবে ভিতরে একজন বাইরে। যে ভিতরে যাবে তার কাছে থাকবে পিয়ালের ট্রান্সমিটার, যে বাইরে থাকবে তার কাছে থাকবে পকেট-রেডিওটা। ভিতরে গিয়ে যদি দেখা যায় আব্বাকে সেখানে আটকে রেখেছে তাহলে ট্রান্সমিটারটা অন করে দেয়া হবে সাথে সাথে বাইরে খবর চলে যাবে। তখন গিয়ে পুলিশকে জানানো যাবে।
বুবুন পুরো পরিকল্পনাটা আরও একবার ভেবে দেখল, কাজ না করার কোনো কারণ নেই। যদি ভিতরে গিয়ে ধরাও পড়ে যায় তবু একজন বাইরে থাকবে, সে গিয়ে অন্যদের খবর দিতে পারবে। সত্যি সত্যি যদি আব্বাকে ভিতরে পাওয়া যায় আর পুলিশ নিয়ে এসে খবিরউদ্দিনের দলবলের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া যায়, বদমাইশগুলো কি তা হলে জন্মের সোজা হয়ে যাবে না?
বুবুন জানালা দিয়ে বাইরে অন্ধকারে নিমগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে ঠিক করে ফেলল যেভাবেই হোক সে যাবে তার আব্বার কাছে।
বাসা থেকে চুপিচুপি বের হয়ে এল বুবুন। সে একা যেতে পারবে না। জায়গাটা সে চেনেও না, একা যেতে চাইলেও যেতে পারবে না। গাব্বু নাহয় পিয়ালকে নিয়ে যেতে হবে। পিয়ালকে নেওয়া খুব সোজা হবে না, তার আব্বা অত্যন্ত কঠিন মানুষ, বুবুন তাই গাব্বর বাসায় হাজির হল। এরকম অসময়ে বুবুনকে দেখে গাব্বু খুব অবাক হল বলে মনে হল না, জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”
বুবুন চাপা গলায় বলল, “এখানে বলা যাবে না।”
গাব্বু সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল, বলল, “চল বাইরে যাই।”
বাইরে এসে বুবনের মুখে পুরো ঘটনা শুনে গাব্বর মুখ শক্ত হয়ে উঠল, মাটিতে থুতু ফেলে বলল,”শুওরের বাচ্চাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেব। দাড়ি টেনে ছিঁড়ে নেব–লাথি মেরে হাঁটুর জয়েন্ট খুলে দেব–”