মাইক্রোবাসটা ঘুরিয়ে গলিতে ঢোকানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে আবার বের হয়ে এল। তখন কালো দাড়িওয়ালা মানুষটা মাইক্রোবাসটায় উঠে চলে গেল–গাব্বু আর পিয়াল কিছু করতে না পেরে তার নম্বরটা শুধু টুকে রাখল।
ইঁদুরের মতো মানুষটা তখন শহরের দিকে ফিরে যেতে লাগল। গাব্বু আর পিয়াল তখন তার পিছুপিছু আসতে লাগল। শহরে, ফোন ফ্যাক্স-এর একটা দোকান থেকে কয়েকটা টেলিফোন করল, কাকে করল কী বলল সেটা তারা ধরতে পারেনি। মানুষটা সেখান থেকে বের হয়ে একটা ফার্মেসিতে গেল, সেখান থেকে একটা হার্ডওয়্যারের দোকানে। সেই দোকান থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিল, তখন পিয়াল আর গাব্বও একটা রিকশা নিল, তাদের কপাল ভালো যে পকেটে রিকশাভাড়া ছিল। সেই রিকশা করে মানুষটা শহরের প্রায় বাইরে একটা বাড়িতে হাজির হয়। বাড়িটা নির্জন একটা জায়গায়, চারিদিকে দেয়াল, সামনে বড় গেট। সেই গেটে অনেক বড় তালা ঝুলছে। মানুষটা সেই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চারিদিকে খুব সন্দেহের চোখে তাকাল, গাব্বু আর পিয়ালের কপাল ভালো, কারণ তারা ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেছে।
একটু পরে ভিতর থেকে একজন মানুষ গেট খুলে দিল, তখন তারা দেখতে পেল ভিতরে সেই মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে, নম্বরটা টুকে রেখেছিল বলে বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি!
গাব্বু আর পিয়াল দূর থেকে বাসাটা ভালো করে দেখে চলে এসেছে, আসার সময় কাছাকাছি দোকানে, এক-দুইজন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছে বাসাটা কার, তারা কেউ বলতে পারেনি। সবার ধারণা বাসাটাতে কেউ থাকে না, খালি পড়ে থাকে। তবে গাব্বু আর পিয়ালের মনে এতটুকু সন্দেহ নেই যে বুবুনকে যদি ধরতে পারত তা হলে এই বাসাতেই নিয়ে আসত।
গাব্বু আর পিয়ালের গল্প শেষ হবার পর চারজনই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। সত্যি সত্যি যদি খবিরউদ্দিনের দলবল বুবুনকে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকে তা হলে আসলেই খুব ভয়ের কথা। কিছু-একটা করা না হলে বুবুনের তো স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিতে হবে।
স্কুল থেকে দেরি করে এসেছে বলে গাব্বু আর পিয়াল তাড়াতাড়ি বাসায় চলে গেল। সুমিও কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেল, বুবুন একা একা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে রইল। আব্বা কোথায় গেছেন কে জানে, আব্বা চলে এলে গল্পগুজব করা যেত। টিলার দিকে গিয়ে দেখে আসা যায় আব্বা কোথায় আছেন, কিন্তু আজকের ঘটনার পর একা একা যাওয়ার সাহস করছে না।
আস্তে আস্তে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল তখনও আব্বার দেখা নেই। এবার বুবুনের একটু একটু ভয় লাগতে থাকে। কোথায় গেছেন আব্বা? একা একা বের হয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেননি তো? একেবারে বাচ্চা একজন মানুষের মতো–যদি কিছু-একটা বিপদ হয় তখন কী হবে?
ঠিক সন্ধ্যেবেলা আম্মা ফিরে এলেন, গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে জাহিদ চাচা বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী খবর ইয়ংম্যান।”
বুবুন বলল, “খবর ভালো না।”
জাহিদ চাচা ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী হয়েছে?”
“আজকে কয়েকজন লোক আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছিল।”
আম্মা আর জাহিদ চাচা একসাথে চিৎকার করে উঠলেন, কী বলছ!”
“হ্যাঁ। তাছাড়া আব্বাকে দেখছি না বিকাল থেকে।”
জাহিদ চাচা গাড়ি থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে পড়লেন।”কোথায় গিয়েছেন?”
“জানি না।”
আম্মা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল যে তার বুকের ভিতরে কোনো ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছিল বুঝি পড়ে যাবেন, কোনোভাবে গাড়ির জানালা ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “বুবুন বাবা, কাছে আয়।”
বুবুন আম্মার কাছে এগিয়ে গেল, আম্মা কীরকম জানি শক্ত করে তাকে ধরে ফেলে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোকে কখন কিডন্যাপ করতে চেষ্টা করছিল? কীভাবে? কোথায়?”
বুবুন মাত্র বলতে শুরু করেছে ঠিক তখন আট-নয় বছরের একটি ছেলে হাতে একটা ঠোঙা নিয়ে এসে হাজির হল। ছেলেটা আম্মাকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে রওশান কার নাম?”
আম্মা বললেন, “আমার নাম। কেন, কী হয়েছে?”
ছেলেটা ঠোঙাটা আম্মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে এইটা আপনারে দিতে বলেছে।”
“কে বলেছে?”
“একটা লোক। আমারে দশ টাকা দিছে।”
আম্মা কেমন জানি বিবর্ণ হয়ে ঠোঙাটা নিয়ে খুললেন, ভিতরে ভঁজ-করা একটা কাগজ। কাগজটা খুলে আবো-অন্ধকারে পড়ার চেষ্টা করলেন। বুবুন জিজ্ঞেন করল, “কী লেখা আম্মা?”
আম্মা বিড়বিড় করে পড়লেন, “এইবার ঠোঙাটা খালি। কাল ভোরের মাঝে তুমি যদি এই এলাকা ছেড়ে না যাও অরেকটা ঠোঙা পাঠাব, সেই ঠোঙায় থাকবে তোমার স্বামীর একটা আঙুল। কাল রাতের মাঝে যদি না যাও যে-ঠোঙাটা আসবে সেটা হবে আরও বড় কারণ তার মাঝে থাকবে তোমার বেকুব স্বামীর মাথা! আল্লাহর কসম আমরা বাজে কথা বলি না।”
আম্মা একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন, বুবুনের মাথা ঘুরে উঠল হঠাৎ তার আব্বাকে ধরে নিয়ে গেছে খবিরউদ্দিনের লোক!
জাহিদ চাচা বললেন, “দেখি চিঠিটা!”
“আরও একটা লাইন আছে।” আম্মা কাঁপা গলায় পড়লেন শেষ লাইনটা, “এই চিঠির কথা যদি জানাজানি হয় বড় ঠোঙাটা কাল ভোরেই চলে আসবে।”
আম্মা অপ্রকৃতিস্থের মতো তাকালেন, বুবুন অবাক হয়ে দেখল, আম্মা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না বুবুনকে ধরে হঠাৎ মাটিতে উবু হয়ে পড়ে গেলেন।
১০. পরিকল্পনা
আম্মা সোফায় বসে আছেন, জাহিদ চাচা খাবার টেবিলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বললেন”ডক্টর রওশান, আপনার দরকারি জিনিসগুলো একটা ব্যাগে ভরে নেন।”