গাব্বু ভয় পেয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“ঐ লোকটা!”
“কোন লোকটা!”
পিয়াল চাপা গলায় বলল, “ঐ যে টিলার উপরে ছিল। বুবুনের বাসার খোঁজ নিচ্ছিল। ইঁদুরের মতো দেখতে
সুমি বলল, “খবরদার কেউ ঘুরে তাকাবি না। কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে হেঁটে যা।”
সবাই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে লাগল। সুমি চাপা গলায় বলল, “পিয়াল, লোকটা কি আমাদের পিছনে পিছনে আসছে? তুই তাকিয়ে দ্যাখ, লোকটা যেন বুঝতে না পারে সেভাবে তাকাবি।”
পিয়াল সাবধানে চোখের কোন দিয়ে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ আসছে। সাথে আরও একজন আসছে।”
“কীরকম দেখতে?”
“কালো দাড়ি। খাটাশের মতো চেহারা।”
“সবাই স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে থাক। দেখে যেন সন্দেহ না করে।”
সবাই স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে থাকল, ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় ওঠার পরেও লোক দুইজন পিছনে পিছনে আসতে লাগল, দেখে কোনো সন্দেহই রইল না যে মানুষগুলো ওদের পিছনে পিছনে আসছে। সুমি বলল, “গাব্বু আর পিয়াল। তোরা এই দোকানে থেমে যাবি ভান করবি দোকান থেকে কিছু কিনছিস। আমরা হাঁটতে থাকব।”
“কী লাভ তা হলে?”
“তোরা মানুষ দুইজনের পিছনে চলে যাবি। তা হলে দেখতে পারবি কী করছি। বিপদ দেখলে সাবধান করতে পারবি।”
“ঠিক আছে।”
“আমরা মানুষ দুইজনকে খসিয়ে দেবার চেষ্টা করব।”
“কীভাবে?”
“হঠাৎ দৌড়ে কোনো একটা গলিতে ঢুকে যাব।”
“তখন আমরা কী করব?”
“তোরা পারলে মানুষ দুজনকে ফলো করবি–দেখিস কোথায় যায়।”
“ঠিক আছে।”
পিয়াল আর গাঙ্কু একটা দোকানে থেমে গেল, ভান করতে লাগল সেই দোকান থেকে কিছু কিনবে। সামনে একটা গলি, ইচ্ছে করলে এই গলিটা দিয়েও বেশ খানিকটা ঘুরে বাসায় যাওয়া যায়। সুমি ফিসফিস করে বুবুনকে বলল, “গলিটার কাছে এসে হঠাৎ করে ভিতরে ছুট দিবি।”
বুবুনের বুক ধ্বকধ্বক করছে, কোনোমতে ঢোক গিলে বলল, “ঠিক আছে।”
দুজনে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে যেন কিছুই হয়নি সেইভাবে হেঁটে যেতে থাকে। হঠাৎ মনে হল পিছন থেকে একটা মাইক্রোবাস এসে থামল। বুবুনের চোখের কোনা দিয়ে দেখল হঠাৎ করে একজন মানুষ তার দুই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাকে ধরার জন্যে। সত্যিই মানুষটা তাকে ধরতে চাইছে নাকি অন্যকিছু করছে বুবুন সেটা আর যাচাই করার জন্যে অপেক্ষা করল না। হঠাৎ করে ঝটকা মেরে মানুষটির হাতের নাগালের বাইরে সরে গিয়ে এক দৌড়ে গলির মাঝে ঢুকে গেল। সুমি পিছনে পিছনে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলল, “পালা!”
পিছনে অনেক কয়জন মানুষের পায়ের শব্দ এবং গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল কিন্তু বুবুন বা সুমির পিছনে ঘুরে তাকানোর সাহস হল না। দুজনে প্রাণপণে ছুটতে থাকে, পিছনে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে দৌড়ানো খুব সোজা ব্যাপার নয় কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ ডানদিকে আরেকটা সরু গলি দেখা গেল, দুজন মানুষ কষ্ট করে যেতে পারে এরকম। সুমি চাপা গলায় বলল, “ডানদিকে!”
বুবুন সুমির পিছনে পিছনে গলিতে ঢুকে গেল। আঁকাবাকা গলি সেদিক দিয়ে আরও খানিকক্ষণ দৌড়ে একটা বাসায় পিছনে লুকিয়ে দুজনে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বুবুন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “কী মনে হয়? লোকগুলোকে খসাতে পেরেছি?”
সুমি সাবধানে মাথা বের করে পিছনে উঁকি মারার চেষ্টা করতে করতে বলল, “মনে হয় পেরেছি। কাউকে তো দেখি না?”
“মাইক্রোবাসটা কি আমাকে ধরতে এসেছিল?”
“তাই তো মনে হয়।”
“খুব বাচা বেঁচে গেছি। কী সর্বনাশ!”
“সুমি কোনো কথা না বলে খুব চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল!”
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করে। একটু পরে পরে পিছনে তাকাচ্ছিল কাউকে দেখা যায় কি না দেখতে। অনেক রাস্তা ঘুরে তারা শেষ পর্যন্ত বাসায় পৌঁছাল। দেরি দেখে সুমির আম্মা চিন্তা করছিলেন, তাদের দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। বুবুনের বাসায় আম্মা নেই, আব্বা সাধারণত বাইরে বাগানে কাজ করেন, আজকে আব্বাকেও দেখা গেল না। এখানকার মাটি খারাপ বলে মাঝে মাঝে টিলার কাছ থেকে মাটি আনতে যান, এখনও সেরকম কোথাও গিয়েছেন হয়তো। গাব্বু আর পিয়ালকে দেখা গেল না, এখনও বাসায় আসেনি।
রাস্তায় যে বুবুনকে প্রায় ধরে নিয়ে যাচ্ছিল সেই কথাটা কাউকে বলা হল না, আম্মা এলে আম্মাকে বলা যেতে পারে। অন্যেরা কথাটা মনেহয় বিশ্বাস করবে না, আর যদি বা বিশ্বাস করে পুরো দোষটা তাদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হবে। কিছু-কিছু ব্যাপারে বড়মানুষেরা খুব চিবিত্র।
আরো ঘণ্টাখানেক পরে গাব্বু আর পিয়াল ফিরে এল, তাদের দুজনকেই খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। গাব্বু হাতে কিল দিয়ে বলল, “পেয়ে গেছি!”
“কী পেয়েছিস?”
“খবিরউদ্দিনের ঘাটি।”
“কেমন করে পেয়েছিস?”
“বলছি, শোন।”
গাব্বুর কথা বলার ধরন ভালো না, কোনোকিছু গুছিয়ে বলতে পারে না। ছোট একটা জিনিস নিয়ে মাথা-গরম করে সেটা নিয়েই চেঁচামেচি করতে থাকে। সেদিক দিয়ে পিয়াল আবার অন্যরকম, অল্প খানিকটা বলেই থেমে যায়, ধরে নেয় সেটা থেকেই সবাই সবকিছু বুঝে নেবে।
দুজনের কথা থেকে যেটুকু বোঝা গেল সেটা এরকম: এরা যখন দোকান থেকে কিছু কিনবে ভান করে মানুষ দুজনের পিছনে চলে এল তার একটু পরেই একটা সাদা রঙের মাইক্রোবাস এসে থামল বুবুনকে ধরার জন্যে। ঠিক যখন ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলবে তখন বুবুন আর সুমি দৌড়ে গলিতে ঢুকে গেল–মানুষগুলো তখন একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ওরা তো জানে না বুবুন আর সুমি এরকম একটা জিনিসের জন্যে তৈরি হয়ে আছে!