গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “কাছে এসে দেখুক না, লাথি মেরে হাঁটুর জয়েন্ট খুলে দেব।”
.
সেদিন সন্ধ্যেবেলা অনেকদিন পর ডক্টর রাজীব হাসান আব্বাকে দেখতে এলেন। দুজনেই দুজনকে দেখে খুব খুশি হয়ে উঠলেন, রাজীব হাসান আব্বার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, “ভালো আছ মাসুদ?”
“জি ডাক্তার সাহেব, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ, আমিও ভালো আছি।”
“আমার গাছগুলোও ভালো আছে? বারান্দার পাশে যেগুলো লাগিয়েছিলাম?”
“হ্যাঁ, সেইগুলো ভালো আছে। এত বড় বড় ফুল ফুটেছে, তুমি থাকলে নিশ্চয়ই আরও বড় ফুল ফুটত।”
“আর পিছনেরগুলো?”
”সেগুলোও ভালো আছে। এখন তুমি বলো এখানে তোমার কেমন লাগছে।”
“ভালোই লাগছে। তবে—”
”তবে কী?”
“বাচ্চাদের সবসময় দেখে রাখতে হয়। বুবুনের বন্ধুরা আছে, তাদের মাথায় একবারে বুদ্ধি নাই।”
“বুদ্ধি নাই?”
“না, সবসময় উলটাপালটা কাজ করে বিপদে পড়ে যায়।” আব্বা মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়তে লাগলেন।
“তাই নাকি?”
“জি। আমি না থাকলে আরও বড় বিপদে পড়ে যাবে।”
“তা হলে তো তোমার থাকতেই হবে।”
“মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন থাকতে হবে। তা ছাড়া এখানে একটা বাগান শুরু করেছি সেটারও দেখাশোনা করা দরকার। মাটি ভালো না এখানে।”
রাজীব হাসান মুচকি হেসে বললেন, “তোমার স্ত্রীর সাথে ভাব হয়েছে?”
আব্বাকে এক মুহূর্তের জন্যে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখাল, “স্ত্রী?” পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “ও! বুবুনের আম্মা?”
“হ্যাঁ।”
“একটু একটু হয়েছে। খুব ব্যস্ত থাকে তো, বাসায় আসতে আসতেই রাত হয়ে যায়।”
ডাক্তার রাজীব হাসান আব্বার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তাঁকে পরীক্ষা করলেন, চেয়ারে বসিয়ে হাঁটুর মাঝে ঠোকা দেওয়া, চোখের মণির দিকে তাকিয়ে দেখা, হাতের আঙুল পায়ের আঙুল টিপে টিপে দেখা এই ধরনের নানারকম পরীক্ষা। সবকিছু দেখে ডাক্তার রাজীব হাসান খুব খুশি হয়ে বললেন, “তোমার আর কোনো চিন্তা নেই মাসুদ। এইভাবে যদি আরও কিছুদিন চলতে থাকে তোমার শরীর একেবারে ঠিক হয়ে যাবে।”
আম্মা একটু পরেই এলেন, তাঁকে অফিসের গাড়ি নামিয়ে দিতে এসেছে। সাথে জাহিদ চাচাও ছিলেন, আম্মা তাঁকেও নামিয়ে নিলেন। রাতে সবাই একসাথে খেল, আগে থেকে ঠিক করা ছিল না বলে আয়োজন খুব সামান্য, কিন্তু সবাই খুব মজা করে খেল। খেতে খেতে খবিরউদ্দিনের কাজকর্মের কথা শুরু হল। আব্বা খানিকক্ষণ শুনে বললেন, “খবিরউদ্দিন কে?”
আম্মা বললেন, “একজন খুব খারাপ মানুষ।”
আব্বা বললেন, “ও।”
আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন খারাপ শুনবে না?”
“কেন খারাপ?”
আম্মা বলতে শুরু করেছিলেন তখন বুবুন বলল, “আম্মা তুমি ঠিক করে বলতে পারবে না, জাহিদ চাচা খুব সুন্দর করে বলেন। জাহিদ চাচা আপনি বলেন–”
জাহিদ চাচা হেসে চোখ পাকিয়ে হাত-পা নেড়ে বক্তৃতার মতো করে বলতে শুরু করলেন, “উনিশ শো একাত্তর সালের রাজাকার কমান্ডার, জামাতে ইসলামীর লিডার, এন-জিও-বিরোধী, নারীশিক্ষা বিরোধী, ফতোয়াবাজ, ধর্মব্যবসায়ী রগকাটা নেতা খবিরউদ্দিন বদের হাঁড়ি—”
জাহিদ চাচার কথা শুনে সবাই হাসতে শুরু করল, আব্বা হাসিতে যোগ না দিয়ে খুব চিন্তিত মুখে আম্মা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পরদিন স্কুলে যাবার সময় পিয়াল তার পকেট থেকে একটা ছোট পকেট রেডিও বের করে বুবুনকে দিয়ে বলল, “শোন।”
“কী শুনব? ক্রিকেট খেলা আছে নাকি?”
“না, ক্রিকেট খেলা না। এফ. এম. ট্রান্সমিটার তৈরি হয়ে গেছে, দুইশো মিটার দূর থেকে শুনতে পারবি।”
বুবুন রেডিওটা অন করতেই সেটা কটকট শব্দ করতে শুরু করল। পিয়াল বুক-পকেট থেকে আরেকটা ছোট সার্কিট বোর্ড বের করে বলল, “এই যে আমার ট্রান্সমিটার। এইখানে থেকে সিগনাল আসছে।”
“ধুর!” গাব্বু মুখ বাঁকা করে বলল, “গুল মারছিস!”
“বিশ্বাস করলি না? এই দ্যাখ–বলে পিয়াল কোথায় জানি কানেকশান খুলে নিতেই কটকট শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। গালুর মুখ হাঁ হয়ে যায়।”তুই নিজে তৈরি করেছিস?”
“নিজে নয়তো কী? আমার কী অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে নাকি! এই দ্যাখ এই যে ভেরিয়েবল রেজিস্টর এটা বাড়িয়ে কমিয়ে কটকট শব্দ তাড়াতাড়ি করা যায়।”
পিয়াল কী-একটা জিনিস ঘুরিয়ে দিতেই কটকট শব্দটা খুব দ্রুত হতে শুরু করল আবার উলটোদিকে ঘোরাতেই শব্দটা আস্তে আস্তে হতে লাগল। পিয়াল মুখে একটা দুনিয়া জয় করার ভাব করে বলল, “যদি বুবুন দেখে ভিতরে বিপদ বেশি তা হলে রেজিস্ট্যান্স কমিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে দেবে তখন শব্দ হবে কট কট-কট-কট-কট আবার যদি দেখে অবস্থা নিরাপদ তা হলে রেজিস্ট্যান্স বাড়িয়ে দেবে, তখন শব্দ হবে ক… ট … ক … ট, আমরাও তখন ঢুকে যাব–”
গাব্বু মাথা নাড়ল, “সব অস্ত্রপাতি নিয়ে।”
বুবুন পিয়ালের তৈরি ট্রান্সমিটার হাতে নিয়ে বলল, “কত দূর থেকে এটা কাজ করে?”
“ফাঁকা জায়গা হলে তিন-চারশো মিটার হওয়া কথা। আমি অবিশ্যি পরীক্ষা করে দেখিনি।”
চল পরীক্ষা করে দেখি।”
“চল।”
তখন-তখনই তারা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, এক দল তাড়াতাড়ি সামনে হেঁটে গেল, অন্য দল পিছনে দাঁড়িয়ে রইল, দেখা গেল প্রায় আধ কিলোমিটার সামনে চলে যাবার পরেও শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
.
বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর সবাই বাসার দিকে রওনা দিয়েছে হঠাৎ পিয়াল চাপা গলায় বলল, “সর্বনাশ!”