গাঙ্কুর গলা থেকে তখনও সেই ভয়ংকর মুখোশটা ঝুলছে, কপালের খানিকটা কেটে সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে, পিয়ালের গায়ে সাদা চাঁদরটা লেপটে আছে, সেটা পানিতে ভেজা এবং সে মেঝেতে বেকায়দাভাবে শুয়ে আছে। আব্বা খুব কাছেই উবু হয়ে বসে এই দুজনকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন, পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সুমি, হাতের খালি দুধের টিনটা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। মেঝেতে পোড়া কাগজ এবং পানি থৈথৈ করছে, ঘরের ভিতরে ধোয়ার গন্ধ। সবচেয়ে প্রথমে কথা বললেন, পিয়ালের আব্বা, হুংকার দিয়ে বললেন, “পিয়াল, হারামজাদা উঠে আয়।”
আব্বা উবু হয়ে বসে থেকে বললেন, “পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে।”
পিয়ালের আব্বা তখন কয়েক পা এগিয়ে এসে, “আমি ব্যথা পাওয়ার মজা টের পাওয়াচ্ছি।”
কয়েকজন মিলে তখন পিয়ালের আব্বাকে না থামালে সেখানেই একটা রক্তারক্তি হয়ে যেত। গাব্বর বড় ভাই বলল, “কী হয়েছে এখানে?”
জাহিদ চাচা বললেন, “সেটা আমরা পরে দেখব। এখন দেখা যাক কেউ বেশি ব্যথা পেয়েছে কি না।”
পিয়াল ওঠার চেষ্টা করল, আম্মা এবং জাহিদ চাচা এগিয়ে গেলেন, কিন্তু তার আগেই আব্বাকে ধরে পিয়াল উঠে বসেছে। গাব্বও মুখোশটা খুলে পিছনে দাঁড়িয়ে গেল। সুমি দুধের টিনটা হাতে নিয়েই আব্বার গা-ঘেঁষে দাঁড়াল।
জাহিদ চাচা বললেন, “মনে হচ্ছে কেউ বেশি ব্যথা পায়নি।” গাব্বু কপালের রক্তটা মুছে ফেলে মাথা নাড়ল। আম্মা বললেন, “ব্যথা নয়, এখন যেটা পাচ্ছে সেটা হচ্ছে ভয়।”
পিয়ালের আব্বা হুংকার দিয়ে বললেন, ‘ভয়ের দেখেছ কী? আমি যখন বাপের নাম ভুলিয়ে দেব তখন বুঝবে ভয় কাকে বলে!”
আম্মা হাসার চেষ্টা করে বললেন, “বাচ্চা মানুষ, কিছু-একটা অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে গুবলেট করে ফেলেছে। আমি দেখছি কী হয়েছে!” পিয়ালের আব্বা বললেন, “বাসায় নিয়ে যাই আমি।”
আম্মা বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমরা ওদের বাসায় পৌঁছে দেব।”
আব্বা বললেন, “হ্যাঁ। এখন ওরা খুব ভয় পাচ্ছে। আমাকে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেরাই ভয় পেয়ে গেছে।”
পিয়ালের আব্বা আবার হুংকার দিলেন,”আপনাকে ভয় দেখাতে এসেছিল? আপনাকে?”
আব্বা তাড়াতাড়ি পিয়াল, গাব্বু এবং সুমিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “না-না, এমনি এমনি মিছিমিছি ভয়।” আব্বা তারপর হাসার চেষ্টা করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন পুরো ব্যাপারটিতে ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। ছোট বাচ্চারা যেভাবে হেসে একটা জটিল ব্যাপারকে সহজ করে দেওয়ার চেষ্টা করে অনেকটা সেরকম।
আম্মা পিয়ালের আব্বাকে বলল, “আপনি বাসায় গিয়ে শান্ত হন, আমরা ওদের দেখছি।”
বাসা থেকে সবাই বের হওয়ামাত্র সুমি আম্মার কাছে এসে বলল, “চাচি। আমি সব পরিষ্কার করে দেব। আপনি বুঝতেই পারবেন না কিছু হয়েছে এখানে।”
আম্মা বললেন, “তোমাকে কিছু করতে হবে না মা। তোমাদের কারও কিছু যে হয়নি তার জন্যেই খোদার কাছে হাজার শোকর।”
আব্বা মাথা নাড়লেন, “হাজার শোকর।”
আম্মা খানিকটা তুলো নিয়ে গাব্বর কপাল পরিষ্কার করতে করতে বললেন, “এখন তো কেউ নেই, বলো দেখি ব্যাপারটি কী হয়েছে?”
কেউ কোনো কথা বলল না। আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, “পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে বুবুনের আব্বাকে তোমরা ভয় দেখাতে এসেছিলে কেন?”
সুমি বলল, “আসলে ভয় দেখাতে আসিনি। চাচার যেন সবকিছু মনে পড়ে যায়–”
আম্মা ভুরু কুচকে তাকালেন। বুবুন বলল, “মনে নেই, তুমি যে বলেছিলে আব্বা ভূত সেজে ভয় দেখিয়েছিল? ঠিক সেরকম–”
পিয়াল বলল, “ঠিক সেইরকম করতে যাচ্ছিলাম যেন দেখেই চাচার সবকিছু মনে পড়ে যায়। এই গাধা গাবুটার জন্য”
গাব্বু ফোঁস করে উঠে বলল, “আমাকে দোষ দিচ্ছিস কেন? নিজে আছাড় খেয়ে পড়েছিস আর দোষ আমার?”
আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “একজনের ঘাড়ে আরেক জনের ওঠা ঠিক হয় নাই। ওজনের চাপে সাইজ ছোট হয়ে যায়।”
আম্মা চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বললে? একজনের ঘাড়ে আরেকজন উঠেছিলে?”
সুমি বোকার মতো একটু হেসে বলল, “বেশিক্ষণের জন্যে তো না, এই একটু সময়ের জন্যে!”
আম্মা হাল ছেড়ে দেবার চেষ্টা করে বললেন, “তোমরা যে বুবুনের আব্বাকে সবকিছু মনে করানোর চেষ্টা করছ, সেই কাজটা খুবই মহৎ, কিন্তু আর করো না। যদি করতেই চাও অন্যভাবে করো যেখানে কারও ঘাড় ভাঙার ভয় থাকে না, বাড়িতে আগুন লাগার ভয় থাকে না, দুই-চারজন খুন-জখম হওয়ার চান্স থাকে না। ঠিক আছে?”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
.
রাতে ঘুমানোর সময় আম্মা বুবুনকে বললেন, “বুবুন, তোকে একটা কথা বলি।”
আম্মার গলায় স্বর শুনে ভয় পেয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “কী কথা আম্মা?”
“তুই যখন স্কুলে যাবি স্কুল থেকে বাসায় আসবি বা বাইরে খেলবি তখন কখনো কোনো অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলবি না।”
“কেন আম্মা? কী হয়েছে”
“খুব সাবধানে থাকবি। কখনো একা থাকবি না, সবাই একসাথে থাকবি। সবসময়। ঠিক আছে?”
“কেন আম্মা?”
আম্মা একটা নিঃশ্বাস ফেলেন, তারপর বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঐ যে খবিরউদ্দিন আর তার জামাতি দল আছে না, তারা একেবারে খেপে গেছে। আমাকে থামানোর জন্যে এরা যা খুশি করতে পারে। একাত্তর সালে করেছে না! ইউনিভার্সিটির সব টিচারকে মেরে শেষ করে ফেলেছিল। তাই ভাবছিলাম,