“ঐ ঘরে।”
“সবাই রেডি হয়ে যাও।”
কোনো শব্দ না করে গা মুখোশটা পরে পিয়ালের ঘাড়ের উপরে উঠে গেল। সাদা চাঁদর দিয়ে পুরোটা ঢেকে দেওয়া হল। গাব্বর হাতে একটা মোমবাতি, সেই মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দেওয়া হল। সুমি হাতে একটা দুধের খালি টিন নিয়ে এসেছে, ভিতরে মুখ লাগিয়ে কথা বললে থমথমে একটা আওয়াজ বের হয়। সবকিছু ঠিকঠাক আছে দেখার পর বুবুন বাইরের ঘরে গিয়ে মেইন সুইচটা অফ করে দিল সাথে সাথে সারা বাসা অন্ধকার হয়ে যায়, শুধু করিডোরে পিয়ালের ঘাড়ে বসে থাকা গাব্বর হাতে একটা মোমবাতি টিমটিম করে জ্বলছে।
সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, বুবুন শুনতে পেল আব্বা তার ঘরে বসে থেকে নিজের মনে বললেন, “কারেন্ট চলে গেছে।” খানিকক্ষণ কোনো শব্দ নেই, তারপর আব্বা ডাকলেন, “বুবুন!”
বুবুন কোনো কথা বলল না। সুমি তখন টিনের ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে থমথমে গলায় বলল, “আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগের কথা। ডক্টর রওশানের স্বামী মাসুদ আহমেদ ফিজিক্সে পিএইচ. ডি, করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে।”
আব্বা ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, “কে কথা বলে?”
”অতীত কথা বলে। কথা বলে পুরানো দিনের স্মৃতি।”
“বুবুন!” আব্বা ডাকলেন, “বুবুন, তুই কোথায়?”
“সেই সময় একদিন মাসুদ আহমেদের বাসায় এল তাঁর এক বন্ধু। বন্ধুকে ভয় দেখাবেন ঠিক করলেন মাসুদ আহমেদ। তার এই কাজে সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী রওশান।”
আব্বা ভাঙা গলায় ডাকলেন, “বুবুন!”
সুমি বলল, “মুখে মুখোশ পরে ভূত সাজলেন মাসুদ আহমেদ। ভয়ংকর চেহারার ভূত! কেমন ছিল সেই ভূত? তাকে কি দেখতে চান?”
আব্বা ঘর থেকে বের হয়ে এলেন, করিডোরে এসে দেখলেন লম্বা সাদা কাপড় পরা ভয়ংকর দর্শন বীভৎস একটি ভূত দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মোমবাতি জ্বলছে, মোমবাতির সেই ক্ষীণ আলোতে ভূতটির সমস্ত বীভৎসতা যেন একশো গুণ বেড়ে গেছে। সুমি বলল, “আমি ভয় দেখাতে আসিনি মাসুদ আহমেদ। আমি এসেছি স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতে। মনে আছে এইভাবে ভূত সেজে আপনি ভয় দেখিয়েছিলেন?”
আব্বা কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু-একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। গাব্বকে ঘাড়ে নিয়ে পিয়াল তখন এক পা এগিয়ে এল। সুমি তার থমথমে গলায় বলল, “মনে আছে? মনে আছে আপনার?”
আগে যেভাবে রিহার্সাল দেওয়া ছিল সেই হিসেবে তখন পিয়ালের আরও এক পা এগিয়ে যাবার কথা, পিয়াল ঠিক সেভাবে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে তাল হারিয়ে ফেলল, তাল সামলাতে গিয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেল, পায়ের নিচে চাঁদর আটকে গেল হঠাৎ এবং কিছু বোঝার আগে প্রচণ্ড শব্দে গাব্বকে নিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল পিয়াল। হাতের মোমবাতি ছিটকে পড়ল নিচে, নিভে না গিয়ে সেটা জ্বলতে থাকে একটা কাগজের উপরে, দেখতে দেখতে সেখানে আগুন জ্বলে উঠল। গাব্বু চিৎকার করে উঠল যন্ত্রণায়, পিয়াল বিকট স্বরে আর্তনাদ করতে লাগল, আর আব্বা ডাকতে লাগলেন, “বুবুন! বুবুন!” সুমি গলা ফাটিয়ে চাচাতে লাগল, “আগুন! আগুন!”
বুবুন মেইন সুইচ টিপে আলোটা জ্বালিয়ে দিলেই সমস্যার বড় অংশ মিটে যেত কিন্তু এই বিশাল গোলমালের মাঝে সেটা তার আর মনে পড়ল না, সেও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে অন্ধকারে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল।
আগুন নেভানোর জন্যে অন্ধকারে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খেতে লাগল, তার মাঝে বুবুন হাতড়ে বাথরুম থেকে বালতি দিয়ে পানি এনে ঢেলে দিল আগুনের মাঝে, আগুন নিভে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে গেল সাথে সাথে। ঠিক সেই সময় শুনতে পেল দরজার ধাক্কা দিচ্ছে অনেকে মিলে, বুবুনের মেইন সুইচের কথা মনে পড়ল তখন। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মেইন সুইচ অন করার চেষ্টা করার কোনো মানে হয় না, আছাড় খেয়ে পড়ে গাব্বু বা পিয়ালের কী অবস্থা হয়েছে কে জানে–বুবুন আগে পরে কিছু চিন্তা না করে দরজা খুলে দিল। বাইরে অনেক মানুষ–অন্ধকারে দেখা যায় না, গলায় স্বর শুনে বুঝতে পারল সেখানে আম্মা আছেন, জাহিদ চাচা আছেন, গাব্বর বড় ভাই, পিয়ালের আব্বা, পাশের বাসার দারোয়ান, আম্মার অফিসের কিছু লোকজন, গাড়ির ড্রাইভার এমনকি মনে হল দুই-একজন পুলিশও আছে। সবাই মিলে চিৎকার করতে লাগল এবং আম্মার গলা উঠল সবার উপরে, “কী হয়েছে? বুবুন কই? মাসুদ কই? চিৎকার করে কে?”
বুবুন বুঝতে পারল তারা এখন যে-বিপদে পড়েছে খোদা নিজে যদি উদ্ধার করেন কেউ তাদের উদ্ধার করতে পারবে না। কী করবে বুঝতে না পেরে সে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল, সবাই হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে গেল, আম্মা তখন ভাঙা গলায় কেমন যেন ভয়-পাওয়া গলায় ডেকে উঠলেন, “বুবুন! বাবা তুই কোথায়?”
“এই তো আম্মা!”
আম্মা হঠাৎ জাপটে ধরে ফেললেন, তারপর ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলেন, “ভালো আছিস তুই বাবা? ভালো আছিস?”
বুবুন ঠিক বুঝতে পারল না কেন আম্মা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। একজন একটা ম্যাচ জ্বালাল এবং তখন বুবুনের মেইন সুইচের কথা মনে পড়ল। সেটা বলার পর জাহিদ চাচা গিয়ে মেইন সুইচটা অন করতেই সারা বাসাটি আলোকিত হয়ে উঠল চারিদিক এক নজর দেখে বুবুনের হঠাৎ মনে হল অন্ধকারই অনেক ভালো ছিল।