কোনো দিন বাসায় আসতে আসতে রাত দশটা বেজে যায়।”
“হু।” সুমি মাথা নাড়ল,”চাচির খুব খাটনি হয়।”
“কিন্তু খাটনিটা তো ঠিক আছে। আম্মা একেবারে মোঘের মতো খাটতে পারে। একজন মানুষ যখন এত পরিশ্রম করে রাতে ফিরে আসে তখন তার কি একটু কথাবার্তা বলার ইচ্ছা করে না?”
সুমি মাথা নাড়ল। বুবুন বলতে লাগল, “সমান-সমান একজন মানুষের সাথে কথা বলার ইচ্ছা করে। কিন্তু আম্মার সেই কথা বলার মানুষ নেই। বাসায় এসে একা একা গালে হাত দিয়ে বসে বসে দেখেন আমি আর আব্বা কী করছি!”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ বুবুনের চোখে পানি এসে গেল, সে খুব চেষ্টা করল সেটা লুকিয়ে রাখতে, সুমিও এমন ভান করল যেন দেখতে পায়নি। আঙুল চাটতে চাটতে বলল, “তুই মন খারাপ করিস না, চাচার নিশ্চয়ই একসময় সবকিছু মনে পড়ে যাবে। আগের বার এমন ঘাপলা হয়ে গেল–”
“হুঁ।“
“আরেকবার চেষ্টা করতে হবে। এইবারে ঠিক করে প্ল্যান করতে হবে। আগেরবারের মতো আউলাঝাউলা করলে হবে না। প্রথমে চাচার জীবনের একটা ঘটনা জানতে হবে। সেখানে যা যা ঘটেছিল হুবহু সেটাই করতে হবে। তা হলে দেখিস ঝপাং করে সব মনে পড়ে যাবে!”
বুবুন সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল রাত্রে আম্মা একটা গল্প বলেছেন। যখন আমেরিকা ছিলেন তখন কী হয়েছিল সেই গল্প।”
“কী হয়েছিল?”
আব্বা কীভাবে মুখোশ পরে তাঁর চালবাজ বন্ধুকে ভয় দেখিয়েছিলেন বুবুন সেই গল্পটা সুমিকে খুলে বলল। শুনে সুমি হাতে কিল দিয়ে বলল, “এই তো চাই! এইটাই করতে হবে?”
“এইটাই?”
“হ্যাঁ, বুঝতে পারছিস না এর মাঝে সব আছে। মুখোশ পরে যখন ভয় দেখানো হবে সেই ভয় পেয়ে হঠাৎ করে সবকিছু মনে পড়ে যাবে। ফার্স্টক্লাস! চল গাব্বু আর পিয়ালকে গিয়ে বলি।”
“এখনই?”
“এখন নয় তো কখন? দেরি করে লাভ কী?”
.
এবারের পরিকল্পনাটা আগেরবার থেকে বেশি যত্ন করে করা হল। গাব্বর একটা রবারের মুখোশ আছে, মুখোশটা পরানো গাল্লুকে, একটা সাদা চাঁদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল সারা শরীর, দুই হাত উপরে তুলে যখন সে হেঁটে আসতে লাগল তাকে দেখতে ভয়ংকর দেখাতে লাগল সত্যি, কিন্তু আরে ছোটখাটো হওয়ায় দেখে কেন জানি ভূত না হয়ে ভূতের বাচ্চার মতো মনে হতে লাগল। সুমি মাথা নেড়ে বলল, “আরও লম্বা হতে হবে।”
গাব্বু বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি এখন লম্বা হব কেমন করে?”
“পিয়াল, তুই পর দেখি।”
পিয়াল মাথা নেড়ে বলল,”আগে মুখোশটা সাবান দিয়ে ধুয়ে আন। ভিতরে গাব্বুর সব জীবাণু আছে–”
“ফাজলেমি করবি না। দাবড়ানি দিয়ে একেবারে ছাড়াভ্যাড়া করে দেব।”
পিয়ালকে মুখোশ পরিয়েও খুব লাভ হল না। বুবুন বলল, “একজনের ঘাড়ে আরেকজন উঠলে হয়।”
সুমি হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস!”
গাব্বু এবং পিয়াল দুইজনেই মাথা নেড়ে প্রবল আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত গাবুকে পিয়ালের ঘাড়ে উঠতে হল এবং এবার সাদা চাঁদর দিয়ে ঢেকে দেবার পর সত্যি সত্যি তাদের দুজনকে একটা সত্যিকারের বিদঘুঁটে ভূতের মতো দেখাতে লাগল। সুমি খুশি হয়ে বলল, “ফার্স্ট ক্লাস!”
বুবুন, সুমি, গাব্বু আর পিয়াল মিলে অনেক সময় নিয়ে পুরো ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার প্র্যাকটিস করে নিল। গাব্বু কখন পিয়ালের ঘাড়ে উঠবে, কখন হাঁটবে, তখন সুমি কোথায় থাকবে, বুবুন কী করবে, যদি কোনো-একটা ঝামেলা হয়ে যায় তখন কী করা হবে, বড় মানুষদের এসে গেলে কীভাবে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে এইরকম খুঁটিনাটি বাদ দেওয়া হল না। কবে ভূত সেজে আব্বাকে ভয় দেখানো হবে সেটা নিয়েও একটু আলোচনা করা হল, দেখা গেল কেউই বেশি দেরি করতে রাজি না, পারলে এখনই করে ফেলে। কিন্তু একজন মানুষকে তো আর দিনের বেলায় ভূতের ভয় দেখানো যায় না অন্তত সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সন্ধ্যেবেলা বাসা থেকে বের হতে হলে একটা জুতসই কৈফিয়তও দিতে হবে। আগেরবার যে-ঝামেলাটা হয়ে গিয়েছিল সেটা জানজানি হয়নি সেটাই ভরসা, তা হলে আর কোনো কথাই কাজে লাগত না।
সন্ধ্যেবেলা পিয়াল খবর নিতে এল যে আব্বাকে ভূত সেজে ভয় দেখানোর ঘটনাটি কী আজকেই করা হবে কি না। আম্মা তখনও আসেননি, আব্বা নিজের ঘরে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা টিকটিকির দিকে তাকিয়ে আছেন, বাসায় আর কেউ নেই কাজেই মনে হয় ভয় দেখানোর জন্যে এটাই ভালো সময়। পিয়াল খবর নিয়ে চলে গেল, কিছুক্ষণের মাঝেই অন্য সবাইকে নিয়ে চলে আসবে। বুবুনের বুকের ভিতর ধক ধক করতে থাকে–আব্বার মতো এরকম ভালোমানুষকে ভয় দেখানো কি ঠিক হচ্ছে? ভয় পেয়ে যদি কিছু-একটা হয়ে যায়? বুবুন জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিল, এটা অনেকটা অসুখ হলে ইনজেকশান দেওয়ার মতো বা পেট কেটে অ্যাপেন্ডিক্স বের করার মতো, জিনিসটা করার সময় কষ্ট হয় কিন্তু করার পর তার ফল হয় ভালো।
বুবুন ঘুরে আরও একবার আব্বাকে দেখে এল, আব্বা এখনও খুব মনোযোগ দিয়ে দেয়ালের টিকটিকির দিকে তাকিয়ে আছেন, টিকটিকি বা ঘাসফড়িঙের মতো জিনিসের মধ্যেই আব্বা কী এত কৌতূহলের ব্যাপার খুঁজে পান কে জানে! কিছুক্ষণের মাঝেই দরজার মাঝে টুকটুক করে শব্দ হল, বুবুন সাবধানে দরজা খুলে দিতেই পিয়াল গাব্বু আর সুমি নিঃশব্দে ঘরের মাঝে ঢুকল। সুমি ফিসফিস করে বলল, “চাচা কোথায়?”