পিয়াল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বানালে বানাবে। তুই হাসছিস কেন?”
গাঙ্কু তার হাসিটা আরও বিস্তৃত করে বলল, “কে বলল, আমি হাসছি? হি হি হি।”
০৮. ভূত
রাতে বিছানায় শুয়ে বুবুন আম্মাকে জিজ্ঞেস করল, “আম্মা, তোমার আজকাল বাসায় আসতে এত দেরি হয় কেন?”
“বদমাইশগুলো খুব খেপেছে তো, তাই কাজ বেড়ে গেছে।”
আম্মা বদমাইশ বলতে কাঁদের বোঝাচ্ছেন বুবুন জানে–তারা হচ্ছে খবিরউদ্দিন আর তার দলবল। সে জিজ্ঞেস করল, “কী করে আম্মা?”
“একটা মেয়েদের স্কুল পুড়িয়ে দেয়, নাহলে কোনো স্কুলে যায় বলে কাফের বলে ফতোয়া দিয়ে দেয়, এইসব ভণ্ডামি।” আম্মা দাঁত-কিড়মিড় করে বললেন, “ইচ্ছে করে সবগুলোর মুখ ছিঁড়ে ফেলি।”
আম্মা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, কেমন জানি ক্লান্তির নিঃশ্বাস। বুবুনের আম্মার জন্যে এত মায়া লাগল সেটি আর বলার মতো নয়। আম্মা মানুষটি যে এত একা বুবুন সেটা আগে কখনোই টের পায়নি, আব্বা আসার পর বুঝতে পেরেছে। বুবুন যখন কখনো কখনো সুমির বাসায় যায়, দেখে সুমির আব্বা আর আম্মা বসে বসে গল্প করছেন, হাসিঠাট্টা করছেন, মাঝে মাঝে বিকেলবেলা দুজনে গল্প করতে করতে হাঁটতে বের হন। দেখে কী ভালোই না লাগে! অথচ তার আব্বা থেকেও নেই, আম্মা একেবারে একা। আব্বা মানুষটা একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো, বুবুন যেসব জিনিস নিয়ে কথা বলে আব্বাও ঠিক একই জিনিস নিয়ে কথা বলেন! আম্মার কথা বলার কোনো মানুষ নেই। রাত দশটা বাজতে -বাজতেই আব্বা দাঁত মেজে বিছানায় শুয়ে পড়েন। যদি কোনোভাবে আব্বার স্মৃতি ফিরিয়ে আনা যেত কী মজাটাই-না হত! আগেরবারের চেষ্টাটা একেবারে মাঠে মারা গেছে, কিন্তু তাই বলে কি হাল ছেড়ে দেওয়া যায়? আবার চেষ্টা করতে হবে, কী দিয়ে চেষ্টা করবে সেটা ঠিক করতে হবে। বুবুন আম্মার গলা জড়িয়ে ডাকল, “আম্মা”
“ঘুমিয়ে গেছ?”
“ঘুমুতে দিচ্ছিস কই!”
“একটা গল্প বলো-না আম্মা!”
“গল্প? এখন? তোর মাথা-খারাপ হয়ে গেছে?”
“আব্বার গল্প।”
আম্মা অন্ধকারেই বুবুনের দিকে তাকালেন, “আব্বার গল্প?”
“হ্যাঁ, আব্বা যখন ভালো ছিলেন তখন কী করতেন সেই গল্প?”
“কেন? সেই গল্প এখন কেন?”
“এমনি শুনতে ইচ্ছা করে। বলো-না!”
বুবুন ভেবেছিল এই মাঝরাতে আম্মা নিশ্চয়ই গল্প বলবেন না কিন্তু কী ভেবে সত্যি সত্যি গল্প বলতে লাগলেন। আমেরিকায় যখন পিএইচ. ডি. করছেন তখন বাসায় বেড়াতে এসেছে বন্ধুবান্ধব। একজন একটু চালবাজ ধরনের মানুষ, শুধু বড় বড় কথা বলছিল, রাতে আব্বা মুখোশ পরে তাকে কীভাবে ভয় দেখালেন সেই গল্প। শুনে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে গেল বুবুন।
.
পরদিন খুব ভোরে জাহিদ চাচা এবং আরও কয়েকজন মহিলা এসে হাজির। তাদের সবারই কিছু-একটা ব্যাপার হয়েছে, আম্মার সাথে চাপা গলায় গম্ভীরমুখে সবাই কিছু-একটা আলোচনা করলেন, তারপর সবাই মিলে নাশতা না করেই বের হয়ে গেলেন।
বুবুন আব্বাকে আবিষ্কার করল বাসার বাইরে। চারিদিকে অযত্নে কিছু ফুলগাছ লাগানো ছিল, আব্বা সেগুলো ঠিক করতে শুরু করেছেন। আব্বা যখন ডাক্তার রাজীব হাসানের কাছে ছিলেন তখন নাকি শুধু ফুলগাছ নিয়েই থাকতেন। বুবুন বেশ খানিকক্ষণ আব্বার সাথে সাথে ফুলগাছের নিচে মাটি নিড়িয়ে দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার, শুকনো পাতা, মরা ডাল কেটে দেওয়া এইসব দেখল। আব্বা এই কাজগুলো করেন খুব যত্ন করে, দেখে মনে হয় ফুলগাছ নয় যেন একটা ছোট বাচ্চাকে আদর করছেন। আব্বাকে দেখে বুবুন আরও একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করল, আব্বা কথা বলতে বলতে কাজ করতে পারেন না। বুবুন যখন কিছু-একটা জিজ্ঞেস করে, আব্বা তখন কাজ বন্ধ করে ঘুরে বুবুনের দিকে তাকান এবং উত্তর দেন। উত্তর দেওয়া শেষ হলে আবার কাজ শুরু করেন। কিন্তু প্রায় সময়েই দেখা যায় আগে কী করছিলেন সেটা এর মাঝে ভুলে গেছেন, নতুন করে অন্য একটা-কিছু করতে শুরু করেছেন! দেখে বুবুনের আব্বার জন্যে ভারি মায়া লাগতে থাকে, সে আব্বাকে একা একা কাজ করতে দিয়ে হাঁটতে বের হল।
হেঁটে হেঁটে সুমিদের বাসায় কাছে এসে সে দেখতে পেল সুমি বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আচার খেতে খেতে একটা বই পড়ছে। বুবুনকে দেখে মুখ তুলে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”
“কোথাও না। এমনি–”
”এমনি কী?””মনটা বেশি ভালো না তাই–”
“মন ভালো না?” সুমি অবাক হয়ে বলল, “মন আবার ভালো না হয় কেমন করে?” কী হয়েছে?”
“না, কিছু না।” বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “যাই, হেঁটে আসি।”
বুবুন পকেটে হাত দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করছিল, সুমি তখন বই বন্ধ করে উঠে এল। হাতের আচারটুকু বুবুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে খা। আচার খা। মন ভালো হবে।”
“না।” বুবুন মাথা নাড়ল, “আমার আচার ভালো লাগে না।”
“আচার ভালো লাগে না?” সুমি চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছিস
“দাঁত টক হয়ে যায়।”
সুমি আঙুল চেটে খেতে খেতে বলল, “সেটাই তো মজা!”
বুবুন কোনো কথা বলল না, সুমি জিজ্ঞেস করল, “এখন বল তোর মন খারাপ কেন?”
বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ব্যাপারটা হচ্ছে আম্মাকে নিয়ে।”
“কী হয়েছে চাচির?”
“কিছু হয়নি, কিন্তু এই মেয়েদের স্কুল, নারী নির্যাতন, ফতোয়াবাজি এইসব নিয়ে একেবারে সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত ঘুরতে থাকেন। কোনো