সুমি বলল, “কেঁচো? ছি!”
“দেখবি ভেলায় উঠতে কী মজা লাগে। নিচে পরিষ্কার কাঁচের মতো পানি। তার মাঝে মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
সুমি কিছু বলল না। বুবুন বলল, “দেখবে লগি দিয়ে ধাক্কা দিতেই ভেলা ভাসতে থাকবে। কী মজা হবে!”
শেষ পর্যন্ত সুমি রাজি হল। কাদা এবং পানির মাঝে ছপছপ করে সবাই যাচ্ছে এবং হঠাৎ করে একজন পানিতে একটা জোক আবিষ্কার করে ফেলল, সাপের বাচ্চার মতো সেটা কিলবিল করে যাচ্ছে। জোকটা দেখেই সুমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে একেবারে লাফ দিয়ে আব্বার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়ল। আব্বা প্রথমে খুব অবাক হলেন, একটু পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুকখুক করে হাসতে লাগলেন। বললেন, “জোককে এত ভয় পাওয়া ঠিক না।”
“কেন না চাচা? যদি ধরে?”
“ধরলে একটু লবণ দিলেই ছেড়ে দেবে।”
“লবণ? লবণ কোথায় পাব?”
“ঐ বাড়ি থেকে নিয়ে নেব।”
আব্বার কথা শুনে সুমি ভয়ে ভয়ে আব্বার ঘাড় ছেড়ে দিয়ে নেমে এল। সুমির মতো এরকম হৈহৈ করা মেয়ে কেন ভেলার মাঝে ভেসে বেড়ানোর মতো একটা মজার ব্যাপারে আসতে চাচ্ছিল না সেটা হঠাৎ করে সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, সে জোঁককে অসম্ভব ভয় পায়। ব্যাপারটা অন্যেরা জেনে ফেলার পর সবাই মিলে তার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলল। একটু পরেপরে মিছিমিছি তাকে ভয় দেখাতে লাগল। সুমি এমনিতে জাঁদরেল ধরনের মেয়ে তার, সাথে ফাজলেমি করলে সে সহজে কাউকে ছেড়ে দেয় না, কিন্তু জোঁকের বেলায় সে একেবারে ভয়ে কেঁচো হয়ে যায়। সত্য মিথ্যা যাই হোক জোঁক কথাটা উচ্চারণ করলেই সে একেবারে ছুটে গিয়ে আব্বার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়তে লাগল, সেটা দেখে সবাই যা মজা পেল সেটা আর বলার মতো নয়।
টিলার নিচে পানি জমে সমুদ্র হয়ে থাকা অংশের অন্য মাথায় যেখানে গ্রামের মানুষেরা বাসা তৈরি করে রয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে অনেকক্ষণ লেগে গেল। তারা ভেলা তৈরি করার জন্যে কলাগাছ নিতে এসেছে শুনে সবাই বেশ মজা পেল। আব্বাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই বেশ কয়েকটা কলাগাছ কেটে ফেলা হল। পিয়াল যখন আব্বার পরিচয় দিল তখন গ্রামের মানুষেরা দৌড়াদৌড়ি করে তাঁর বসার জন্য হাতলওয়ালা নকশাকাটা একটা চেয়ার নিয়ে এল। আব্বা অবশ্য সেই চেয়ারে বসলেন না, অন্য সবার সাথে ভেলা তৈরি করার কাজে যোগ দিলেন। প্রথমে কাটা কলাগাছগুলো ঠেলে পানিতে নেওয়া হল। পাশাপাশি সাজিয়ে নিয়ে দুই টুকরো বাঁশ কয়েক জায়গায় আড়াআড়িভাবে লাগিয়ে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হল। ভেলাকে ঠেলাঠেলি করার জন্যে একটা বাঁশের লগি দেওয়া হল।
কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল আব্বাকে নিয়ে বাচ্চাদের এই ছোট দলটা পানিতে ভাসতে শুরু করেছে। পানি নিয়ে গার বেশি ভয়ডর নেই, সে একপাশে পা ঝুলিয়ে বসেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই পানিতে ভিজে এবং কাদা মেখে সে ভূতের মতো হয়ে গেল। আব্বা বসেছেন মাঝখানে, তার ওজন বেশি বলে একট নড়াচড়া করলেই ভেলা টলমল করে ওঠে। জোঁকের ভয়ে সুমি আব্বার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে শক্ত করে ধরে রাখা কাগজে প্যাচানো খানিকটা লবণ। পিয়াল এবং বুবুন পালা করে লগি দিয়ে ঠেলা ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল। নিচে পানি একেবারেই কম, বৃষ্টির পরিষ্কার পানিতে সবকিছু দেখা যায়। মাছ ভেসে বেড়াবে বলে যেরকম আশা করেছিল সেরকম অবিশ্যি দেখা গেল না, মাছেরা সম্ভবত ভেলা দেখেই সতর্ক হয়ে গেছে।
বুবুনদের দেখাদেখি গ্রামের বাচ্চারাও নিজেদের ভেলা তৈরি করে পানিতে নামিয়ে এনেছে–তারা বুবুনদের থেকে অনেক বেশি দুর্দান্ত–ভেলার উপর থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে লাগল। যারা পানিতে নামতে চাইছিল না ভেলা উলটিয়ে তাদের সবাইকে পানিতে নামিয়ে দেওয়া হল।
ভেলায় করে সমুদ্রের মতো জমে থাকা পানির মাঝে আব্বাকে নিয়ে সবাই ভেসে বেড়াল। আকাশে আবার মেঘ করেছে, বৃষ্টি হতে পারে ভেবে তারা একসময় ফিরে আসতে শুরু করে। মাঝপথেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, তখন আব্বার আনন্দ দেখে কে! তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল বৃষ্টিতে ভেজার মতো আনন্দ বুঝি আর কিছুতেই নেই। আনন্দ জিনিসটা সংক্রামক, কিছুক্ষণের মাঝেই অন্যেরাও সেই আনন্দের ভাগ পেয়ে গেল। চুপচাপ বসে আনন্দ করা যায়
বলে ভেলার ওপরেই নাচানাচি শুরু হয়ে গেল এবং হঠাৎ কিছু বোঝার আগে দেখা গেল গাব্বু ঝপাং করে পানির মাঝে পড়েছে। আব্বা ভয় পেয়ে যেই গাকে ভোলার জন্যে ভেলার পাশে এগিয়ে গেলেন ভেলা কাত হয়ে পিয়াল। এবং বুবুনও পানিতে পড়ে গেল, তখন যা একটা মজা হল সে বলার মতো নয়। সবাইকে টেনে আবার ভেলার মাঝে তোলা হল এবং হঠাৎ করে দেখা গেল পিয়ালের শার্টের মাঝে ছোট একটা চকচকে মাছ লেগে আছে। পানির বাইরে এসে নির্জীবের মতো মাছটা তিরতির করে নড়ছে, আব্বা বললেন, “আহা বেচারা, কষ্ট পাচ্ছে। পানিতে ছেড়ে দাও আবার।”
কারোই মাছটাকে ছেড়ে দেবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আব্বার কথা শুনে মাছটাকে পানিতে ছেড়ে দিতেই সেটা মুহূর্তে যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে চোখের পলকে সারা শরীর দুলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আকাশে মেঘ তখন আরও ঘন হয়ে এসেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা আরও চেপে এসেছে, হঠাৎ করে একটু বাতাসও দিতে শুরু করেছে।
পানিতে ভিজে একেকজনের যা চেহারা হয়েছে সেটা বলার মতো না। গাব্বু দাঁত বের করে হেসে পিয়ালকে বলল, “তোকে আজ তোর বাবা যা বানানো বানাবে!”