পিয়াল এবং সুমি লুকিয়ে থেকে যতটুকু সম্ভব পরিকল্পনাটা উদ্ধার করার চেষ্টা করছিল কিন্তু গাব্বু তার সুযোগ দিল না। দাঁত-কিড়মিড় করে বলল, “ঐ ছাগলের বাচ্চারা, কথা বলিস না কেন? কই গেলি তোরা? পিয়াল? সুমি?”
আব্বা বললেন, “গাব্বু রাগ করেছে। অনেক রাগ করেছে।”
কোনো উপায় না দেখে পিয়াল আর সুমি আড়াল থেকে বের হয়ে এল, গাব্বু তখন প্রায় খ্যাপা মোষের মতো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যাপারটাকে আরও গুরুতর করার জন্য ঠিক সেই সময় আম্মা ঘরে এসে হাজির হলেন, বুবুন আর আব্বাকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? কী দেখছ?”
এই কয়েকদিনে আব্বা আম্মার সাথে খানিকটা সহজ হয়েছেন, আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, “গাব্বু উড়ার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ করে পড়ে গেছে।”
আম্মা জানালার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “কী বললে? উড়ার চেষ্টা করছিল?”
নিমগাছের নিচে তখন প্রচণ্ড মারামারি চলছে। গাব্বু ধরেই নিয়েছে তাকে হেনস্থা করার জন্যে ইচ্ছে করে উপর থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আব্বা আম্মাকে বললে, “ঐ যে দ্যাখো। গাব্বর বেল্টটা এখনও উড়ছে।”
আম্মা বেল্টটা নিয়ে ব্যস্ত হলেন না, উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “ওরা কারা? ঝগড়া করছে কেন?”
আম্মার গলার স্বর শুনে নিচে মারামারি বন্ধ হয়ে গেল। সুমি বলল, “চাচি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ মা ভালো আছি। তোমরা কী করছ এখানে?”
“না মানে ইয়ে এই তো–“
পিয়াল বলল, “ইয়ে, গাব্বর বেল্ট–”
“ও হা গাঙ্কুর বেল্ট। বেল্টটা নিতে এসেছে। তাই ভাবলাম–” সুমি গলার স্বর পালটে বলল, “চাচা ভালো আছেন?”
আব্বা বললেন, “বেশি ভালো নেই।” ডান হাতটা উপরে তুলে আঙ্গুলটা দেখিয়ে বললেন, “এই যে নখ কাটার সময় বেশি কেটে ফেলেছি, এখন ব্যথা করছে।
সুমি বলল, “ভালো হয়ে যাবে চাচা।”
আব্বা বললেন, “গাল্লুকে বলো যাদের পাখা নেই তাদের ওড়া ঠিক না। পড়ে ব্যথা পাবে।”
গাবু, সুমি এবং পিয়াল কথাটা না শোনার ভান করে চলে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আম্মা চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী হচ্ছে ওখানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
বুবুন অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে এরকম সময়ে সরাসরি সবকিছু স্বীকার করে ফেলে আধাঘণ্টার একটা লেকচার শুনে ফেলাই সবচেয়ে সহজ সমাধান। সে গলা-খাঁকারি দিয়ে বলল, “আমি বলছি আম্মা।”
আব্বা মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ তুই বল।” তারপর জানালা দিয়ে মাথা বের করে অন্যদেরকে বললেন, “তোমরা ভিতরে চলে আসো। বাইরে মশা কামড়াবে।”
সুমি বলল, “না চাচা। আজকে যাই” বলে আর কাউকে কিছু বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনজনই অদৃশ্য হয়ে গেল।
আব্বা সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “গাল্লুকে ভালো করে বোঝাতে হবে। মানুষ তো ফড়িং না যে আকাশে উড়বে।
আম্মা চোখ পাকিয়ে বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বলতে চাস বলে ফেল। কপালে দুঃখ আছে নাহলে জানিস তো?”
বুবুন মনে-মনে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, পৃথিবীর কত মহৎ পরিকল্পনা না জানি এইভাবে মাঠে মারা গেছে।
.
গাবুকে আকাশে ওড়ানোর চেষ্টা নিয়ে যত বড় ঝামেলা হবে সন্দেহ করেছিল দেখা গেল সেরকম কিছু হল না। আব্বাকে কোনোভাবে চমকে দিয়ে তাঁকে সবকিছু মনে করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা মনে হর আম্মা একটু বিশ্বাসও করে ফেললেন। ভবিষ্যতে আর যেন কোনো ধরনের পাগলামো করা না হয় এরকম একটা কথা দেওয়ার পর আম্মা হালকাভাবে বুবুনের কান মলে দিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন।
পরের দুইদিন হঠাৎ করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হল, বাসার আশেপাশে নিচু জায়গায় পানি জমে পুরো এলাকাটাকে একটা সমুদ্রের মতো দেখাতে লাগল। ব্যাঙদের আনন্দ হল সবচেয়ে বেশি, গলা ফুলিয়ে ঘা ঘো ঘা ঘো করে ডেকে ডেকে এলাকার সবার কান ঝালাপালা করে দিল। মেয়েদের স্কুলের কী একটা ব্যাপার নিয়ে আম্মা খুব ব্যস্ত ছিলেন, আশেপাশে গ্রামে-গ্রামে বৃষ্টির মাঝে ঘোরাঘুরি করে করে তাঁর বাসায় ফিরতে দেরি হতে লাগল।
বৃষ্টির প্রথম দিনেই গাব্বু একটা প্রস্তাব নিয়ে এল, টিলার কাছে নিচু জায়গা আছে সেখানে পানি জমে ছোটখাটো একটা সমুদ্রের মতো হয়ে গেছে সেখানে একটা ভেলা ভাসিয়ে দেওয়া। আগেও এক-দুইবার চেষ্টা করা হয়েছিল খুব একটা সুবিধে করা যায়নি। ভেলা তৈরি করার জন্যে কলাগাছ জোগার করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। এবারে অবিশ্যি অন্য ব্যাপার, আব্বাকে নিয়ে গ্রামে হাজির হয়ে কয়েকটা কলা গাছ চাইলেই গ্রামের লোকেরা খুশি হয়ে দিয়ে দেবে। আব্বা যে ডক্টর রওশানের স্বামী, নিজেও ফিজিক্সে পিএইচ. ডি. করেছেন এই সব কথা শুধু একটু গলা বাড়িয়ে বলে দিতে হবে।
আব্বাকে ভেলা তৈরি করার প্রস্তাবটা দেওয়ামাত্রই খুব খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল ছোট একটা দল আব্বার পিছুপিছু গ্রামের দিকে যাচ্ছে। এসব ব্যাপারে সুমি সবসময় আগে থাকে কিন্তু কোনো-একটা বিচিত্র কারণে এবার সুমি আসতে চাইছিল না। বুবুন বলল, “মাঠে তো পানি একেবারেই বেশি না, এই হাঁটুপানি, ভয়ের কী আছে?”
সুমি মুখ শক্ত করে বলল, “আমি ভয় পেয়েছি তোকে কে বলল?”
“তা হলে আসতে চাইছ না কেন?”
গাব্বু বলল, “ছিপ নিয়ে যাব, কেঁচো দিয়ে টোপ দিলেই কপাকপ করে মাছ ধরবে।”