“এই বিকেলবেলা কমিক দেখার সময় হল? চোখের যে বারোটা বাজিয়েছিস খেয়াল আছে?”
“আম্মা, আজকাল চোখ খারাপ হওয়া কোনো ব্যাপারই না। চশমা আছে, কন্টাক্ট লেন্স আছে—”
“পাকামো করবি না। কতবার বলেছি বিকেলে বই পড়বি না!”
“এটা বই না। এটা কমিক।”
“পার্থক্যটা কী?”
“বই পড়তে হয়। কমিক পড়তে হয় না, দেখলেই হয়। যেরকম করে ঘরবাড়ি দেখি গাছপালা দেখি। বিকালবেলা কি আমরা দেখি না? চোখ বন্ধ করে রাখি?”
ব্যাখ্যা শেষ হবার আগেই আম্মা এসে বুবুনের কান ধরে তাকে টেনে তুলে ফেললেন, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বের হ ঘর থেকে। বাইরে গিয়ে খেলাধুলা কর–”
বুবুন কোনোমতে নিজের কানকে উদ্ধার করে বলল, “এটা তোমার কীরকম অভ্যাস আম্মা? ঝপ করে কান ধরে ফেল? কেউ দেখে ফেললে—”
“কেউ দেখলে কী হবে? তোর জাত চলে যাবে?”
“আমি এত বড় হয়েছি, আর তুমি–”
আম্মা খুব অবাক হবার ভান করে বললেন, “তাই নাকি? তুই অনেক বড় হয়েছিস? কত জানি বয়স হল তোর? একশো চল্লিশ?”
“যাও! বিদেশে আমার বয়সী ছেলেরা কত কী করে, আর তুমি কথা নেই বার্তা নেই কান ধরে ফেল, চুল ধরে ফেল–”
“পাকামো করবি না। ঘর থেকে বের হ। মাহয় শুধু কান ধরব না, টেনে ছিঁড়ে ফেলব। একেবারে ভ্যান গ হয়ে যাবি। যা–”
বুবুন মুখ শক্ত করে বলল, “কোথায় যাব?”
“বাইরে। নতুন জায়গায় এসেছিস একটু কৌতূহলও নেই কী আছে আশেপাশে? পাড়ার ছেলেপিলেদের সাথে পরিচয় করবি না? দেখলি না ক্রিকেট খেলছে”
“চিনি না শুনি না গিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করে দেব?”
“যদি না খেলিস তা হলে চেনাশোনাটা হবে কীভাবে? আর পচা তর্ক করবি, যা, বের হ।”
বুবুন বিরসমুখে বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে জুতো পরল। খামোখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ চুল আঁচড়াল। শার্টটা বদলে নিল–তারপর যখন দেখল আর কিছুই করার নেই তখন ঘর থেকে বের হল। আম্মার উপর যা রাগ উঠল সেটা আর বলার মতো নয়। এমনিতে আম্মা দেখতে একেবারে সিনেমার নায়িকাঁদের মতে, পড়াশুনাও করেছেন অনেক। সোশিওলজিতে পিএইচ. ডি. অথচ কথাবার্তা বাসের কন্ডারক্টরদের মতো। গলা উঁচিয়ে ধমক না দিয়ে কোনো কথা বলতে পারে না। তার বাবা না থাকায় এটাই হয়েছে মুশকিল। বাসায় কোনো পুরুষমানুষ না থাকলে মনে হয় মেয়েরাই পুরুষ মানুষদের মতো হয়ে যায়। বুবুন একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বাবা থাকাটা কেমন কে জানে!
একটু আগে বাইরে খুব হৈচৈ করে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল বুবুন খেলাধুলায় একেবারে যাচ্ছেতাই আর ক্রিকেটে হলে তো কথাই নেই, না পারে বল করতে না পারে ব্যাট করতে। ফিল্ডিং তো আরও খারাপ, সোজা ক্যাচগুলো কীভাবে জানি ফস্কে যায়। পায়ের পাশ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বল বাউন্ডারি পার হয়ে যায়। তাই ঘর থেকে বের হয়ে যখন দেখল বাইরে এখন কেউ ক্রিকেট খেলছে না বুবুন একটু স্বস্তি পেল। ছেলেপিলেরা কোথায় গিয়েছে কে জানে।
এই এলাকাটা একটু অন্যরকম। শহরতলির বাসা, আশেপাশে অনেক গাছ গাছালি, দূরে একটা টিলামতন রয়েছে, তার ওপাশে নাকি একটা নদীও আছে। তাদের আগের বাসা ছিল একেবারে শহরের মাঝখানে, একটার পাশে আরেকটা কংক্রিটের দালান, গাছপালা যে দুএকটা ছিল ধুলার আস্তরণে তারা একেবারে ডুবে থাকত। বুবুন প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীরেসুস্থে জায়গাটা দেখতে বের হল। বাসার পিছনে কয়েকটা বড় বড় গাছ, তার পাশে একটা নিচু জায়গা, সেখানে পানি জমে আছে, কাছে আসতেই কয়েকটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আরেকটু এগিয়ে যেতেই সে ছেলেপিলের দলটাকে আবিষ্কার করল, তারা একটা গাছের নিচে জমা হয়েছে। একজনের হাতে একটা বাঁশ সেই বাঁশের উপরে কয়েকটা খবরের কাগজ শক্ত করে বাঁধা, হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটির যে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেটি একটি মেয়ে, বয়স বুবুনের সমান কিংবা একটু ছোট। বুবুনকে দেখে একজন বলল, “বেশি কাছে এসো না।”
বুবুন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কেন? কী হবে কাছে এলে?”
“আগুন জ্বালাব।”
বুবুন এইবার ভালো করে তাকাল, “বাঁশের ডগায় আগুন লাগানোর ব্যবস্থাটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, নীল রঙের শিশি থেকে যে তরল পদার্থটি খবরের কাগজে ঢালা হল সেটা নিশ্চয়ই কেরোসিন। বুবুন জিজ্ঞেস না করে পারল না, “আগুন জ্বালাচ্ছ কেন?”
যে-মেয়েটা আগুন জ্বালানোর জন্যে ম্যাচ বের করছিল সে বুবুনের দিকে না তাকিয়েই বলল, “বোলতার ইয়া বড় চাক হয়েছে। আগুন লাগিয়ে ছ্যাড়ভাড়া করে দেব।”
বুবুন ভিতরে ভিতরে চমকে উঠল, সে আগে কখনো বোলতার চাক দেখেনি বইপত্রে দুষ্টু ছেলেদের। বোলতার চাক ভাঙা নিয়ে অনেক রকম ভয়ের কাহিনী পড়েছে এখন কি তারই একটা তার চোখের সামনে ঘটবে? বুবুন গাছের উপরে তাকাল, কিন্তু চাকটা কোথায় ঠিক দেখতে পেল না।
এর মধ্যে বাঁশের ডগার মাঝে আগুন লাগানো হয়েছে, বিশাল মশালের মতো দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠতেই সবাই মিলে একটা আনন্দের মতো শব্দ করল। মেয়েটা বাঁশটা নিয়ে আগুনটাকে উঁচু করতে থাকে এবং তখন বুবুন বোলতার বিশাল চাকটা দেখতে পেল। যে-ঘটনাটি এক্ষুনি ঘটতে যাচ্ছে সেটা যে বুদ্ধিমানের কাজ নয় সেটা বুঝতে দেরি হল না। মেয়েটা চকচকে চোখে বলল,”সবাই দৌড় দেবার জন্যে রেডি হও।”