“কিন্তু সেটা করবি কেমন করে?”
পিয়াল আবার মাথা চুলকাল।”দড়ি দিয়ে বেঁধে কপিকল দিয়ে টেনে তোলা যায়। যদি দড়ি রং করে নেওয়া যায় যেন দেখা না যায়।
এরকম সময় আলোচনাটা থামিয়ে দিতে হল, কারণ হাঁটতে হাঁটতে সবাই নিচু জলার মতো জায়গাটায় এসে হাজির হয়েছে এবং ব্যাঙকে চমকে দিলে তারা কীরকম কাণ্ড জ্ঞান হারিয়ে লাফিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সেটা সবাই আবিষ্কার করে ফেলেছে। আব্বা পিছিয়ে এসে বুবুনদেরকে বললেন, “ব্যাঙেরা খুব জোরে লাফ দেয়।”
বুবুন মাথা নাড়ল। সুমি বলল, “জি চাচা।”
আব্বা খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “ব্যাঙরা বসে থেকেই লাফ দিতে পারে। দাঁড়াতে হয় না।”
বুবুন একটু অবাক হয়ে আব্বার দিকে তাকাল, ব্যাঙ যে দাঁড়াতে পারে এই জিনিসটাই কখনো তার মনে হয়নি। গাব্বু খানিকক্ষণ আব্বার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হি হি করে হাসতে শুরু করল। আব্বা অবাক হয়ে গাব্বর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “কী হল ছেলে তুমি হাস কেন?”
০৭. চমক
আব্বাকে চমকে দেওয়ার পরিকল্পনাটা খানিকটার রদবদল করা হল। ঠিক করা হল বুবুনকে হুশ করে আকাশে পাঠানোর বদলে সেখানে গাব্বকে ব্যবহার করা হবে। তার কয়েকটা কারণ প্রথম কারণ হচ্ছে ব্যাপারটা রাত্রে না করে উপায় নেই। দিনের বেলায় কারও কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে উপরে তুললে সেটা যে কেউ বুঝে ফেলবে। রাত্রিবেলা বুবুনকে দড়ি বেঁধে টেনে উপরে তোলার জন্যে প্রস্তুতি নেওয়া খুব সহজ হবে না–বুবুনকে কিছুক্ষণ না দেখলেই আব্বা বেশ অস্থির হয়ে যান। গাব্বকে ব্যবহার করা হলে সেই সমস্যা নেই। শুধু তাই নয়, যখন গাকে আকাশে টেনে তোলার সময় হবে তখন বুবুন আব্বাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে জানালার কাছে নিয়ে আসতে পারবে। জানালার কাছেই একটা বড় নিমগাছ রয়েছে, সেই নিমগাছে একটা কপিকল বাঁধা হয়েছে। বাজার থেকে নাইলনের দড়ি কেনা হয়েছে, গাব্বর বেল্টের সাথে সেই দড়ি বেঁধে তাকে টেনে উপরে তোলাও বেশ কয়েকবার প্যাকটিস করা হয়ে গেছে।
যেদিন ঘটনাটা ঘটানো হবে সেদিন সবার ভিতরেই খানিকটা উত্তেজনা টের পাওয়া গেল। সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হওয়ার জন্যে আগে থেকে বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরি করে রাখা হয়েছে। সুমি বলল তাকে বকুলের বাসায় যেতে হবে। টেলিভিশনে একটা গানের প্রোগ্রাম দুজন একসাথে না দেখলেই নয়। গাব্বু বলল বুবুন তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। পিয়ালের বাসায় কঠিন শাসন, সে বলল স্কুলে পরের দিন জ্যামিতির টেস্ট পরীক্ষা হবে, একটা বিশেষ উপপাদ্য গার বাসা থেকে বুঝে আসতে হবে।
ঠিক সময়ে সবাই গুটিগুটি হাজির হয়েছে, গাব্বকে গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে কোমরের বেল্টে দড়ি বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাবে না বলে গাব্বু হাতে একটা বড় টর্চলাইট নিয়েছে। সময় হলে নিজেই নিজের দিকে জ্বালিয়ে ধরবে।
নিমগাছের নিচে সব প্রস্তুতি শেষ করে সেখান থেকে ছোট এক টুকরা ঢিল জানালায় ছুঁড়ে মারা হল। শব্দ শুনে বুবুন জানালা খুলে তার আব্বাকে ডাকাল, “আব্বা দেখে যাও।”
আব্বা খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ঘাসফড়িংকে পরীক্ষা করছিলেন। কীভাবে সেটা জানি ঘরের ভিতরে ঢুকে গেছে। বুবুনের কথা শুনে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “কী দেখব?”
কী প্রশ্ন করলে কী বলা হবে আগে ঠিক করে রাখা ছিল, বুবুন বলল, “গাব্বু দেখা করতে এসেছে।”
গাব্বু তখন টর্চলাইট জ্বালিয়ে নিজেকে দেখিয়ে দিল। গাব্বু কেন সামনের দরজা দিয়ে না এসে বাসার পিছনে নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সেটারও উত্তর ঠিক করা ছিল কিন্তু আব্বা সেটা নিয়ে প্রশ্ন করলেন না। বললেন, ‘ও!”
ঠিক এই সময়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সুমি আর পিয়াল গাবুকে টেনে ওপরে তুলতে শুরু করল। একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই সে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে বাঁকা হয়ে ঝুলতে লাগল। আব্বা বললেন, “গাব্বুর কী হয়েছে?”
বুবুন বলল, “বাতাসে ভাসছে আব্বা।”
আব্বা বললেন, “ও!”
আব্বা যে এত সহজে ব্যাপারটা মেনে নেবেন বুবুন মোটেও সেটা আশা করেনি। সে ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্যে আবার কী-একটা বলতে যাচ্ছিল তখন আবার হ্যাঁচকা টানে গাবুকে আরও খানিকটা উপরে তোলা হল। সুপারম্যান এর কমিকে সুপারম্যান যে-ভঙ্গিতে আকাশে ওড়ে গাব্বু সেরকম ভঙ্গি করার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু সে বাঁকা হয়ে ঝুলেছিল বলে ভঙ্গি দেখাতে লাগল বিচিত্র। ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে দেওয়ার জন্যে গাব্বু দড়িতে বাধা
অবস্থায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। আব্বা বললেন, “গাব্বু ঘুরছে।”
দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় ঘুরপাক খাওয়ার অংশটুকু পরিকল্পনার মাঝে ছিল না, গাব্বু নিজেকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু খুব সুবিধে করতে পারল না। হাত-পা নাড়া অবস্থায় তাকে অত্যন্ত হাস্যকর দেখাতে থাকে, দেখে আব্বা পর্যন্ত খুকখুক করে হেসে ফেললেন।
পরিকল্পনাটি এমনিতেই মাঠে মারা যাচ্ছিল কিন্তু এর পর যা ঘটল তাতে পরিকল্পনাটি শুধু মাঠে মারা গেল না, মরে একেবারে ভূত হয়ে গেল। হঠাৎ পটাং শব্দ করে গাব্বর বেল্ট খুলে গিয়ে সে উপর থেকে ধড়াম করে নিচে এসে পড়ল এবং শূন্যে শুধু তার বেল্ট ঝুলতে লাগল। গাব্বর যে ইচ্ছে করে বেল্ট খুলে গিয়েছে সেটা সে বুঝতে পারল না, মনে করল তাকে বুঝি আর পিয়াল নিচে ফেলে দিয়েছে। গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সে চিৎকার দিয়ে বলল, “গাধার বাচ্চারা আমাকে ফেরে দিলি যে?”