ঠিক তখন একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, গর্তের ভিতর থেকে হঠাৎ বিদঘুঁটে কী-একটা জিনিস ছুটে এল, আগুনের কাছে এসে সেটা এক মুহূর্ত থেমে যায় এবং হঠাৎ করে সেই বিদঘুঁটে জন্তুটার সারা শরীরে অসংখ্যা কাটা খাড়া হয়ে যায়। বাচ্চাকাচ্চা যারা ছিল তারা ভয় পেয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে থাকে, বুবুনের মনে হতে থাকে এখন সেটা বুঝি তাদের উপর লাফিয়ে পড়বে। সবাই ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করছিল, আব্বা কিন্তু একটুও ভয় না পেয়ে জিনিসটাকে আরও ভালো করে দেখার জন্যে একেবারে কাছে এগিয়ে গেলেন। সেই অদ্ভুত জন্তু আগুনটাকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বের হয়ে এল, তারপর ঝমঝম শব্দ করতে করতে টিলা বেয়ে নিচে নেমে গিয়ে গাছ-গাছালির মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সবাই গলা ফাটিয়ে চাচামেচি করছে আব্বা তখন মুখে হাসি ফুটিয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন, “কী আশ্চর্য! শজারু! এটা নিশ্চয় শজারু।”
মজা দেখার জন্য যারা হাজির হয়েছিল তাদের মাঝেও একজন মাথা নেড়ে বলল যে এটা নিশ্চয় শজারুই হবে। শজারুর গায়ে নাকি এরকম কাঁটা থাকে এবং ভয় পেলে তাদের কাঁটাগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
পুরো এলাকাটাতে যখন সবকিছু নিয়ে খুব হৈচৈ হচ্ছে তখন বুবুন আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, “আব্বা, তুমি আগে কখনো শজারু দেখেছ?”
“নাহ!”
“তা হলে এটা তুমি চিনলে কেমন করে? তুমি না সবকিছু ভুলে গেছ?” আব্বাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখাল, মাথা চুলকে বললেন, “তা তো জানি না!”
“তার মানে আসলে তোমার সবকিছু মনে আছে, তুমি জান না।”
“আমি জানি না?”
“না। চেষ্টা করলে আবার তোমার মনে পড়ে যাবে।”
শেয়াল দেখার চেষ্টা করে যে-দলটা শজারু দেখে ফেলেছে তারা আবার দল বেঁধে ফিরে আসতে থাকে। পিছন দিকে বুবুন, সুমি, পিয়াল এবং গাব্ব। আব্বা কেমন হঠাৎ করে শজারু চিনে ফেলেছেন সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সুমি বলল, “তার মানে যদি চাচাকে হঠাৎ করে কোনোকিছু দিয়ে চমকে দেওয়া যায় তা হলে আবার সবকিছু মনে পড়ে যাবে।”
গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস?”
“আমি একটা উপন্যাসে পড়েছি। নায়িকা সবকিছু ভুলে গিয়েছিল, তখন নায়ক এসে–”
সুমিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে গাঙ্কু বলল, “আমি একটা উপন্যাস পড়েছি সেখানে নায়ক ব্যাঙ হয়ে গেছে। নায়িকা এসে সেই ব্যাঙকে চুমো দিয়েছে–”
সুমি রেগে গাব্বুর পেটে একটা ঘুসি মারার চেষ্টা করল, কিন্তু গাব্বু সাবধান ছিল বলে সময়মতো লাফিয়ে সরে গেল।
বুবুন বলল, “তোমরা মারপিট করছ কেন? নিজেরাই তো দেখতে পেলে হঠাৎ করে আব্বার শজারুর কথা মনে পড়ে গেল। যদি শজারুর কথা মনে পড়ে যায় তা হলে অন্যকিছু মনে পড়তে অসুবিধে কী আছে?”
পিয়াল মাথা নাড়ল, “নাই। কোনো অসুবিধা নাই। শুধু চমকে দিতে হবে।”
সুমি চিন্তিত মুখে বলল, “কী দিয়ে চমকে দেওয়া যায়?”
গাব্বু বলল, “একটা সাপ ধরে এনে ছেড়ে দিলে কেমন হয়?
“ধুর গাধা! সাপ ব্যাঙ শজারু এইসব চিনিয়ে কী হবে! যদি চাচিকে চেনানো যেত তা হলে লাভ হত।”
“যদি মনে কর আমরা একটা নাটকের মতো করি। চাচিকে আগে থেকে রাজী করালাম। একটা ডাকাত এসে গুলি করল, চাচি গুলি খেয়ে পড়ে গেলেন–”
বুবুন মাথা নাড়ল, বলল, “আম্মা কোনোদিন রাজি হবেন না। আব্বার সামনে একটা নাটকের মতো করা? অসম্ভব!”
পিয়াল পিছিয়ে পড়েছিল, এইবার দুই পা এগিয়ে এসে বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”
“কী আইডিয়া।”
“চাচা তো আসলে সায়েন্টিস্ট। বুবুন তুই বলেছিস না চাচা ফিজিক্সে পিএইচ. ডি. করেছে?”
“হ্যাঁ।”
“সায়েন্টিস্ট মানুষকে চমকে দেওয়া খুব সোজা।”
“কী রকম?”
যদি দেখানো যায় বিজ্ঞানের সূত্র কাজ করছে না তারা চমকে ওঠে?”
বুবুন ভুরু কুঁচকে বলল, “বিজ্ঞানের সূত্র?”
“হ্যাঁ। মনে কর যদি দেখানো যায় আলোর গতি হঠাৎ কমে অর্ধেক হয়ে গেছে কিংবা ইকুয়েল টু এম সি স্কয়ারটা ভুল। কিংবা আর্কিমিডিসের সূত্র ভুল। কিংবা–”
সুমি এবং গাব্বু হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বুবুন ভদ্রতা করে কিছু বলল না। সুমি দ্রতা নিয়ে মাথা ঘামায় না, সোজাসুজি বলে ফেলল, “পিয়াল, তোর মাথাটা খারাপ।”
“মাথা-খারাপ?” পিয়াল চোখ লাল করে বলল, “কেন বলছিস আমার মাথা খারাপ?
“কেন মাথা-খারাপ সেটা যে বুঝতে পারিস না সেটাই হচ্ছে তার প্রমাণ।”
পিয়াল এবারে রেগে গেল। পিয়াল রেগে গেলে তার কথার মাঝে একটু তোতলামো এসে যায়। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “য-য-যদি দেখা যায় মা মা মাধ্যাকর্ষণ কাজ করছে না, বু-বু-বুবুন হঠাৎ হুশ করে আকাশে উঠে গেল–”
“কী বললে? বুবুন চোখ বড় বড় করে বলল, “আমি আকাশে উঠে গেলাম?”
“হ্যাঁ। তা হলে চাচা অবাক হবেন না? চমকে উঠবেন না?”
সুমি এবং গাকেও স্বীকার করতে হল যদি এরকম একটা ব্যাপার ঘটে তা হলে আব্বা রীতিমতো চমকে উঠবেন এবং ভুলে-যাওয়া অনেক কিছু মনে পড়ে যেতে পারে। গাব্বু কানে আঙুল দিয়ে খানিকক্ষণ কান চুলকে বলল, “কিন্তু বুবুনকে হুশ করে আকাশে পাঠাবি কেমন করে? পিঠে রকেট বেঁধে আগুন জ্বালিয়ে দিবি নাকি?”
পিয়াল মাথা চুলকে বলল, “সেটাই চিন্তা করে করতে হবে। সত্যি সত্যি তো আর আকাশে পাঠানো যাবে না, দেখে যেন মনে হয় আকাশে উঠে যাচ্ছে।”