আব্বা সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। সবাই মিলে কিং-কুইন খেলছিল, তারা আব্বাকে টেনে মাঠে নিয়ে গেল। খেলার নিয়ম-কানুন বুঝিয়ে দেওয়া হল এবং আব্বাকে নিয়ে খেলা শুরু হল। কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি দেখা গেল আব্বা যত উৎসাহ নিয়ে খেলতে নেমেছেন তত উৎসাহ নিয়ে খেলতে পারেন না। বলটা ধরতে সমস্যা হয়, ধরার পরেও কার দিকে ছুঁড়ে মারতে হয় সেটা নিয়েও কিছুতেই মনস্থির করতে পারেন না। কোনোভাবে যদি মনস্থির করেও ফেলেন তার পরেও বলটা ছুঁড়তে চান না পাছে কেউ ব্যথা পেয়ে যায়।
খেলার অবস্থা দেখে গাম্বু বলল, “এর থেকে চল চাচাকে নিয়ে টিলা বেড়িয়ে আসি।”
সাথে সাথে সবাই রাজি হয়ে গেল এবং আব্বাকে নিয়ে সবাই টিলার দিকে রওনা দিল। পিছনের ভোলা মাঠ নিচু জায়গায় জমে-থাকা পানি, ঝোঁপঝাড় এবং টিলা, টিলার পিছনে ছোট নদী–সবকিছু দেখে আব্বা কেমন জানি ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে উঠলেন। ফিরে আসার সময় গাঙ্কু বলল, “চাচা আপনি কি শিয়াল চেনেন?”
“শিয়াল?”
“হ্যাঁ, ঐ যে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া করে ডাকে?”
আব্বা অনেকক্ষণ ভরু কুঁচকে চিন্তা কের বললেন, “না, চিনি না।”
“এই টিলায় শিয়ালের গর্ত আছে। গর্তের মুখে আগুন দিলে শিয়াল বের হয়ে আসে।”
“সত্যি?”
গাব্বু মাথা চুলকে বলল, “আমরা একবার চেষ্টা করেছিলাম, তখন অবিশ্যি বের হয় নাই।”
সুমি বলল, “অনেক বড় আগুন করতে হবে, আমরা আসলে বেশি বড় আগুন করতে পারি নাই।”
আব্বা অবাক-চোখে সুমি এবং গাব্বর চোখে তাকিয়ে রইলেন। পিয়াল বলল, “আপনি দেখবেন চাচা?”
আব্বা উৎসাহে মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, দেখব। দেখাও।”
সুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে তো প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে। আজকে হবে না, কালকে দেখাব।”
আব্বার মুখ দেখে মনে হল ব্যাপারটা আজকেই দেখা যাবে না বলে তার বেশ মন খারাপ হয়ে গেল।
সন্ধ্যেবেলা বাসায় ফেরার সময় বুবুন বলল, “আব্বা!”
“কী হল?”
আমরা যে কালকে শেয়াল দেখতে যাব সেই কথাটা তুমি কিন্তু আম্মাকে বলো না। ঠিক আছে?”
আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “বলব না।” একটু থেমে বললেন, “আমি তো তোমার আম্মার সাথে এমনিতেও কথা বলি না।”
বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কেন বল না আব্বা?”
“চিনি না তো তাই।”
.
পরদিন বিকেলে যখন দলটি শেয়াল দেখতে বের হল তখন তাদের সাথে অনেক রকম জোগাড়যন্ত্র নেওয়া হয়েছে। কয়েকজনের হাতে খবরের কাগজের বাণ্ডিল, একজনের হাতে কেরোসিনের বোতল এবং ম্যাচ, গর্তের মুখে শব্দ করার জন্যে কয়েকটা খালি টিন এবং লাঠি। দূর থেকে তাদের দেখে মনে হল একটা অভিযাত্রীর দল।
দলটা ডোবার পাশে দিয়ে হেঁটে যখন টিলার উপরে উঠতে শুরু করল তখন আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরও কিছু গ্রামের বাচ্চাকাচ্চা তাদের সাথে যোগ দিল। শুধু তাই নয়, এক-দুইজন বয়স্ক মানুষও কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এল। এর আগে যতবার তারা কোথাও দল বেঁধে গিয়েছে বয়স্ক মানুষেরা খুব সন্দেহের চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, কিন্তু এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। তাদের সাথে আব্বাও আছেন কাজেই সবাই ধরে নিল তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে যাচ্ছে।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় চলেছেন সবাইকে নিয়ে?”
আব্বা কিছু বলার আগেই গাব্বু বলল, “শেয়াল দেখতে।”
মানুষটা খুব অবাক হয়ে বলল, “শেয়াল দেখতে?”
আব্বা মাথা নাড়লেন। মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “কেমন করে শেয়াল দেখা যাবে?”
আব্বা কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই সুমি বলল, “ শেয়ালের গর্তে ধোঁয়া দিয়ে।”
“ধোঁয়া?”
“হ্যাঁ?”
পিয়াল বলল, “সাথে খালি টিন এনেছি, সেটা পিটিয়ে ঢংঢং করে শব্দ করতে হবে।”
“তা হলেই শেয়াল দেখা যাবে?”
আব্বা মাথা নাড়লেন। মধ্যবয়স্ক মানুষটাকে পুরো ব্যাপারে খুব উৎসাহী দেখা গেল, সেও তাদের সাথে চলল। আব্বা যদি সাথে না থাকতেন তা হলে পুরো ব্যাপারটাই অন্যরকম হত, তারা শেয়ালের গর্তের মুখে আগুন দেবে শুনেই সবাই একেবারে হা হা করে উঠে আপত্তি করত। সাথে আব্বা থাকায় আজকে কোনো সমস্যা নেই।
টিলার উপরে উঠে গর্তের সামনে পুরো দলটি দাঁড়াল। মধ্যবয়স্ক মানুটা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন গর্তটা?”
সুমি বড়সড় একটা গর্তকে দেখিয়ে দিল। সেই গর্তেই সামনে খবরের কাগজ স্থূপ করে রাখা হল। সেখানে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেবার সময় মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, “তা হলে তো খালি আগুন হবে, ‘ধোয়া তো হবে না!”
বুবুন জিজ্ঞেস করল, “ধোয়া কেমন করে হয়?”
“আগুন যখন ঠিক করে জ্বলতে পারে না তখন ধোয়া হয়। মানুষটা আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, “তা-ই না স্যার?”
আব্বা অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়লেন। লোকটা বলল, “ভালো করে একটা আগুন জ্বালিয়ে তখন সেটাকে ভেজা লতাপাতা দিয়ে চাপা দিতে হবে।” তারপর সে নিজেই গাছের লতাপাতা আধভেজা খড়কুটো খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মাঝেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে, আগুনের আঁচে কাছে যাওয়া যায় না। তার উপরে গাছের লতাপাতা, আধভেজা খড়কুটো চাপা দেওয়া হল, সত্যি সত্যি তখন সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। গাব্বু খালি টিন হাতে নিয়ে সেটাকে পেটাতে শুরু করল, তার দেখাদেখি অন্যেরাও। শব্দে কানের পর্দা প্রায় ফেটে যাবার অবস্থা। মজা দেখার জন্যে আরও মানুষ জড়ো হয়েছে, তারাও যে যেভাবে পারছে শব্দ করছে, আগুনটাকে খুঁচিয়ে দিচ্ছে, লতাপাতা, খড়কুটো এনে আগুনের উপরে দিচ্ছে।