“একটু ছুঁয়ে দেখি।”
আব্বা হঠাৎ ঘুমের মাঝে বিড়বিড় করে কিছু-একটা বলে মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরে শুলেন–আম্মা তাড়াতাড়ি পিছনে সরে এলেন। বুবুনকে ফিসফিস করে বললেন”তুই যা ঘুমা।”
“তুমি কী করবে?”
“আমি এখানে বসে থাকি কিছুক্ষণ।”
“কোথায় বসবে?”
“এই তো এখানে।” বলে আম্মা দরজায় হেলান দিয়ে বসলেন। হাঁটুতে মুখ রেখে বললেন, “তোর আব্বাকে দেখি খানিকক্ষণ। কতদিন দেখি না!”
বুবুন বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রইল, চারিদিকে কী সুমসাম নীরবতা–মনে হয় যেন একটা ফিনফিনে পাতলা কাঁচের গ্লাস, টুং করে শব্দ হলেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়বে।
০৬. শেয়াল দেখা
বিকালবেলা সবাই দল বেঁধে আব্বাকে দেখতে এল। বুবুন সবার সাথে আব্বার
পরিচয় করিয়ে দিল, “আব্বা, এই যে ছেলেটা-এর নাম পিয়াল।”
“পিয়াল?”
“হ্যাঁ।”
গাব্বু বলল, “ওর নাম রাখার কথা ছিল শিয়াল, ভুল করে শ-এর জায়গায় প লিখে–হি হি হি—”
আব্বা বললেন, “ধুর! শিয়াল কি কখনো কারও নাম হয়?”
বুবুন গাল্লুকে দেখিয়ে বলল, “আর এর হচ্ছে গাব্ব।”
আব্বা হেসে বললেন, “খালি ঠাট্টা করে! গাব্বু কখনো কারও নাম হয় না।”
সুমি মাথা নেড়ে বলল, “চাচা, আপনি ঠিকই বলেছেন, গাব্বু কারও নাম হয়। কিন্তু বিশ্বাস করেন তবু এর নাম গাব্বু।”
বুবুন সুমিকে দেখিয়ে বলল, “আর এই মেয়েটার নাম সুমি।”
গাব্বু বলল, “বল, এই মেলেটার নাম সুমি।”
আব্বা অবাক হয়ে বললেন, “মেলে?”
“হ্যাঁ। সুমি হচ্ছে অর্ধেক মেয়ে আর অর্ধেক ছেলে। তাই সে হচ্ছে মেলে।”সত্যি?”
“সুমি বড় হলে মনে হয় গুণ্ডা হবে।”
“গুণ্ডা?”
“হ্যাঁ। স্কুলে সেদিন একটা ছেলে তার সাথে ফাজলেমি করেছিল, তাই সুমি তাকে ল্যাং মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছিল।”
আব্বা অবাক হয়ে সুমির দিকে তাকালেন। বুবুন বলল, “আব্বা, তুমি গাব্বুর সব কথা বিশ্বাস করো না। গাব্বু সবসময় বাড়িয়ে চাড়িয়ে কথা বলে। একটা উকুন মারলে গাব্বু এসে বলে সে একটা ইঁদুর মেরেছে। ইঁদুর মারলে বলে হাতি মেরেছে।”
আব্বা বললেন, “আর হাতি মারলে?”
“এখনও মারে নাই, কিন্তু যদি মারে তা হলে মনে হয় বলবে ডাইনোসর মেরে ফেলেছেন হয় আব্বা আপন
কথাটা মনে হয় আব্বার খুব পছন্দ হল, আব্বা খুকখুক করে হেসে উঠলেন।”
সুমি জিজ্ঞেস করল, “চাচা আপনার আগের কথা কিছু মনে নেই?”
আব্বা মাথা নাড়লেন, “নাহ্!”
“বুবুনের কথা? চাচির কথা?”
“বুবুন যখন খুব ছোট ছিল সেই কথা একটু একটু মনে আছে।”
“কী করত বুবুন?”
আব্বা ভুরু কুঁচকে কিছু-একটা মনে করার চেষ্টা করে বললেন, “মাথাটা মেঝেতে লাগিয়ে পিছনটা উপরে তুলে পায়ের নিচে দিয়ে তাকিয়ে বলত বুঁদ বুদ বুদ-_”
“বুদ বুঁদ বুদ?” গাব্বু আবার হি হি হি করে হেসে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু সুমি এমনভাবে চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল যে সে আর সাহস পেল না। সুমি জিজ্ঞেস করল, “আপনার আর কিছু মনে নেই? চাচির কথা মনে নেই?”
“চাচি? সেটা কে?”
সুমি বুবুন পিয়াল এবং গাব্বু সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। বুবুন বলল, “আম্মা। আমার আম্মা।”
সুমি জিজ্ঞেস করল, “মনে নেই?”
আব্বা কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলেন, লাজুক-লাজুক মুখে বললেন, “নাহ্।”
“দেখেন চেষ্টা করে।” সুমি হাল ছাড়ল না, বলল, “বুবুন যে-সময় পিছনটা উঁচু করে বলত বুঁদ বুদ বুঁদ তখন কাছে আরেকজন সুন্দর মহিলা থাকত না? সিনেমার নায়িকার মতো সুন্দর?”
আব্বা আবার খানিকক্ষণ চিন্তা করে চিন্তিত মুখে বললেন, “নাহ্।”
“এটা হতেই পারে না।” সুমি এবারে কেমন যেন রেগে গেল, “চাচা এটা হতেই পারে না। এরকম সুন্দর একজন মানুষের কথা কেমন করে ভুলে গেলেন! নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। আছে না?”
আব্বাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখা গেল, মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন, সুমি আবার কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল বুবুন তাকে থামাল। বলল, “সুমি, আব্বার ব্রেনে অপারেশন করেছিল সেজন্যে মনে নাই। এখন তো আর জোর করে মনে করানো যাবে না।”
“তা-ই বলে চাচির মতো সুন্দর একজন মানুষকে কি কেউ ভুলতে পারে? সেটাও কি সম্ভব?” সুমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই মনে পড়বে। এমনি যদি মনে না পড়ে তা হলে সাহায্য করতে হবে।”
“কীভাবে সাহায্য করবি?”
“জানি না। দেখি চিন্তা করে।”
বিকালবেলা যখন সব বাচ্চারা মাঠে হৈচৈ করে খেলছে তখন বুবুন তার আব্বাকে নিয়ে বাইরে এল। আব্বা হাত পকেটে ঢুকিয়ে মাথাটা একটু নিচু করে কেমন যেন একটু বিচিত্র ভঙ্গি করে খুব মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাদের খেলা দেখতে লাগলেন। বাচ্চারা অবশ্য কিছুক্ষণের মাঝেই খেলা বন্ধ করে বুবুনের আব্বাকে দেখতে চলে এল। এর মাঝেই চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে বুবুনের আব্বা মানুষটা বড় হলেও আসলে একেবারে বাচ্চাদের মতো। এতজন বাচ্চাকাচ্চা যে আব্বাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে সেজন্যে আব্বাকে মোটেও অপ্রস্তুত মনে হল না, বরং আব্বাকে কেমন জানি খুশি-খুশি দেখাতে লাগল। নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই এখানে থাক?”
বাচ্চারা মাথা নাড়ল। আব্বারও মাথা নেড়ে বললেন, “বিকালে খেলাধুলা করতে হয়। তা হলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।”
ছোট একটা বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমাদের সাথে খেলবেন?”