“তাহলে?”
রাজীব হাসান চলে যাবার পর আব্বা সোফায় সোজা হয়ে বসে রইলেন। আম্মা পাশের সোফায় বসলেন, আম্মার পাশে বসল বুবুন। আব্বা আড়চোখে একবার আম্মার দিকে তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আম্মা নরম গলায় বললেন, “মাসুদ। তোমার খিদে পেয়েছে?”
“নাহ্।”
“কী খেয়েছ?”
“ভাত। ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত।”
“তা হলে কি চা খাবে একটু?”
“আমি চা খাই না। চা খাওয়া ভালো না।”
“কেন? কী হয় চা খেলে?”
“চা খেলে রাতে ঘুম হয় না। আর গায়ের রং কালো হয়ে যায়।”
আম্মা হেসে ফেলে বললেন, “আমি তো অনেক চা খাই। আমার গায়ের রং কি কালো হয়েছে?”
আব্বা আড়চোখে একবার আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাহ! এখনও হয় নাই।”
“তুমি কি তা হলে দুধ খাবে?”
“দুধ খাওয়া ভালো। গায়ে জোর হয়।”
“খাবে তা হলে?”
“নাহ্। আমি খাব না। বুবুন খাবে।”
আম্মা বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বুবুন, তোমার আব্বা বলেছে তোমাকে দুধ খেতে হবে!”
বুবুন কাতর গলায় বলল, “না আম্মা! প্লিজ!”
আব্বা হাসি-হাসি মুখে বললেন, “বুবুন দুষ্টু। দুধ খেতে চায় না।”
আব্বাকে খুশি করার জন্য বুবুনকে এক গ্লাস দুধ আর আস্ত একটা কলা খেতে হল। আব্বার সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ার নিয়ম। তাই একটু পরেই আম্মা আর বুবুন মিলে তাকে তার শোয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। আব্বা তার বিছানাটা ভালো করে উলটে পালটে দেখলেন, জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলেন, তারপর বেশ অনেকবার লাইট-সুইচ অন-অফ করে দেখলেন। আব্বার জন্যে নতুন একটা স্লিপিং সুট কেনা হয়েছে, আব্বার সেটা খুব পছন্দ হল বলে মনে হল। আব্বাকে বাখরুম দেখিয়ে দেওয়া হল, সেখানে তার জন্যে নতুন টুথব্রাশ টুথপেস্ট রাখা আছে। আব্বা টুব্রাশে টুথপেস্ট লাগাতে গিয়ে ভুলে বেশি জোরে টিপে অনেকখানি টুথপেস্ট বের করে ফেললেন। আব্বা তখন বাড়তি টুথপেস্টটা আবার টুথপেস্টের টিউবে ঢোকানোর চেষ্টা করতে লাগলেন, কাজটি মোটেও সহজ নয়, কিছুক্ষণের মাঝেই তার হাত টুথপেস্টে মাখামাখি হেয় গেল। আব্বা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, “পাজি টুথপেস্ট।”
বুবুন বলল, “টুথপেস্ট একবার বের হয়ে গেলে ভিতরে ঢোকানো যায় না, আব্বা।”
আব্বা মনে হল খুব অবাক হয়ে গেলেন, “যায় না?”
“না।”
আব্বা তখন বাচ্চাদের মতো মুখ উঁচু করে দাঁত ব্রাশ করতে শুরু করলেন তাকে দেখে মনে হতে লাগল ঠিক করে দাঁত ব্রাশ করার মাঝেই পৃথিবীর সবকিছু নির্ভর করছে।
দাঁত ব্রাশ করে আব্বা বিছানায় পিঠ সোজা করে বসে রইলেন। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “আব্বা, তোমার এই ঘরটা পছন্দ হয়েছে?”
আব্বা মাথা নাড়লেন, “নাহ্। বেশি পছন্দ হয় নাই।”
বুবুন খুকখুক করে হেসে ফেলল, আব্বা যে সত্যিই করে ছোট একটা বাচ্চার মতো হয়ে গেছেন এটাই তার প্রমাণ। একজন বড় মানুষ কখনোই এরকম কথা বলে না। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কেন বেশি পছন্দ হয় নাই?”
“জানালাটা উলটা দিকে।”
“উলটা দিকে?”
“হ্যাঁ। সবসময় মাথার কাছে জানালা থাকতে হয়। আব্বা বিছানাটা দেখিয়ে বললেন, “এইখানে জানালাটা পায়ের কাছে।”
বুবুন বালিশটা নিয়ে বিছানার অন্যপাশে দিয়ে বলল, “এখন এই দিকে মাথা দিয়ে ঘুমাবে। তা হলেই মাথার দিকে জানালা হবে।”
ব্যাপারটা বুঝতে আব্বার খানিকক্ষণ সময় লাগল। যখন বুঝতে পারলেন তখন হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে উঠলেন। মাথা নেড়ে নেড়ে বললেন, “ফার্স্টক্লাস বুদ্ধি। বুবুনের ফার্স্টক্লাস বুদ্ধি!”
.
অনেকদিন পর বুবুন আম্মার সাথে শুয়েছে। অনেক বড় হয়েছে তাই আম্মার সাথে শোয়া হয় না, সবসময় আলাদা ঘরে নিজের বিছানায় ঘুমায়। আজকে শুয়ে সে হাত দিয়ে আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আম্মা, তোমার কি মন-খারাপ?”
“কেন? মন-খারাপ হবে কেন?”
“আব্বা যে তোমার সাথে কথা বলছেন না?”
আম্মার একটু হাসলেন,বললেন, “না রে পাগল! সেজন্যে আমার একটুও মন-খারাপ না। আস্তে আস্তে আমাকে যখন চিনবে তখন কথা বলবে। আমি এগারো বছর অপেক্ষা করলাম আর এই কয়দিনে কী হবে?”
“আম্মা!”
“কী?”
“তোমাকে দেখলেই আব্বা কেমন জানি লজ্জা পেয়ে যাচ্ছে। দেখেছ?”
বুবুনের কথা শুনে আম্মাও মনে হল একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন, বললেন, “সে রকমই মনে হচ্ছে।”
“কী আশ্চর্য! নিজের বউকে দেখে লজ্জা! হি হি হি!”
“পাকামো করবি না, ঘুমা।”
“আম্মা, আব্বা যদি কখনোই তোমাকে না চিনতে পারে, তা হলে কী হবে?”
“না চিনলে নাই। আমার সামনে তো থাকবে। তা হলেই হবে–আমি আরকিছু চাই না!”
গভীর রাতে বুবুনের মনে হল আম্মা বিছানা থেকে উঠছেন। বুবুন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাও মা?”
আম্মা ফিসফিস করে বললেন, “তোর আব্বাকে দেখে আসি।”
“আমিও আসি?”
“আয়। শব্দ করিস না কিন্তু!”
বুবুন আম্মার সাথে সাথে আব্বার ঘরে গেল। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসেছে, সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে আব্বা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছেন। ছোট বাচ্চারা যেভাবে পা ভাঁজ করে গোল হয়ে শুয়ে থাকে, থুতনি লেগে যায় হাঁটুর মাঝে ঠিক সেভাবে। আম্মা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন, বুবুন একেবার আম্মার গায়ের সাথে লেগে রইল। আম্মা কিছুক্ষণ একেবারে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর খুব সাবধানে মশারি তুলে আব্বার কপালে হাত রাখলেন। বুবুন ফিসফিস করে বলল, “কী করছ আম্মা?”