রাজীব হাসান বুবুন এবং আম্মাকে দেখিয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলেন, “মাসুদ, তুমি এদের চিনতে পারছ?”
আব্বা ভালো করে বুবুন বা আম্মার দিকে না তাকিয়েই বললেন, “নাহ্!”
“দেখো ভালো করে তাকিয়ে। এই যে ইনি হচ্ছেন তোমার স্ত্রী। আর এই যে তোমার ছেলে।”
আব্বা কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলেন, বলেন, “ধুর!”
“সত্যি।”
আব্বা এবার হেসে ফেললেন যেন ডক্টর রাজীব হাসান খুব মজার কথা বলেছেন। আম্মা এই প্রথমবার আব্বার সাথে কথা বললেন। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে শান্ত রেখে বললেন, “মাসুদ। তুমি আমার দিকে তাকিয়ে দেখ চিনতে পার কি না।”
আব্বা আম্বার দিকে না তাকিয়েই বললেন, “না।”
রাজীব হাসান বললেন, “ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ। ইনি তোমার স্ত্রী।”
আব্বা আবার কেমন জানি লজ্জা পেয়ে হেসে বললেন, “ডাক্তার সাহেব শুধু আমার সাথে ঠাট্টা করেন।
“না মাসুদ, আমি মোটেই ঠাট্টা করছি না। তোমার মনে নেই তাই তুমি চিনতে পারছ না।”
আব্বা কিছু বললেন না কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা গেল রাজীব হাসানের একটা কথাও বিশ্বাস করেননি।
রাজীব হাসান আবার বলেলন, “তুমি এখানে কয়েকদিন থাকবে মাসুদ?”
আব্বা কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলেন, তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললেন, “না।”
“কেন না?”
“আমি আপনার সাথে যাব।”
“ঠিক আছে আমি নাহয় কয়েকদিন পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি কয়েকদিন এখানে থাকো। ঠিক আছে?”
আব্বা কেমন যেন ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকালেন, আম্মার চোখে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন, বুবুনের দিকে ভালো করে তাকালেন না, ঘুরে ডক্টর রাজীব হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “না, আমি এখানে থাকব না।”
“কেন থাকবে না?”
আব্বা কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। রাজীব হাসান জিজ্ঞেস করলেন, “ভয় করে?”
আব্বা কোনো কথা না বলে মাথা নাড়লেন। রাজীব হাসান বললেন, “তোমার ভয় কী? এরা তোমার একেবারে সবচেয়ে আপন মানুষ। একজন হচ্ছে তোমার স্ত্রী, আরেকজন ছেলে। এরা তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে–আমি তোমাকে যত ভালোবাসি তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসে।”
“না, আমি থাকব না। আমি যাব” বলে আব্বা দাঁড়িয়ে গেলেন। বুবুন আম্মার দিকে তাকাতে পারছিল না। আম্মাকে দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি এক্ষুনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠবেন, কিন্তু আম্মা কাঁদলেন না, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।
আব্বা দরজার দিকে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে পিছনে তাকালেন এবং প্রথমবার দেয়ালে ফ্রেম-করা তাঁর নিজের ছবিটা দেখতে পেলেন। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা সাদা একটা পাঞ্জাবি পরে আছেন–আব্বার কোলে বুবুন, তার বয়স তখন এক কিংবা দুই, বুবুনের হাতে একটা লা। দমকলের খেলনাগাড়ি। আব্বা কী মনে করে হেঁটে হেঁটে ছবিটার কাছে গেলেন, কেমন যেন হতচকিতের মতো ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখে মনে হল কিছু-একটা মনে করার চেষ্টা করছেন, তাঁর চোখেমুখে কেমন যেন একটা যন্ত্রণার ভাব ফুটে উঠল। আব্বা হাত দিয়ে ছবির যেই অংশে বুবুন রয়েছে সেখানে হাত বুলালেন, বুবুন দেখল আব্বার চোখ হঠাৎ পানিতে ভরে উঠেছে। আব্বা ঘরে রাজীব হাসানের দিকে তাকালেই তারপর ফিসফিস করে বললেন, “বুবুন!”
ঘরের সবাই একসাথে চমকে উঠল, আব্বা বুবুনকে চিনতে পেরেছেন! আম্মা দুই পা এগিয়ে এসে বললেন, “হ্যাঁ বুবুন!”
আব্বা আবার আস্তে আস্তে বললেন, “আমার বুবুন।”
আম্মা বললেন, “হ্যাঁ, তোমার বুবুন। এই দ্যাখ তোমার বুবুন কত বড় হয়েছে।”
আব্বা এবারে প্রথমবার বুবুনের দিকে ভালো করে তাকালেন। কেমন জানি একধরনের বিস্ময় এবং কৌতূহল নিয়ে বুবুনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আবার তার মুখে একধরনের যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠল। বুবুন একদৃষ্টে তার আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। আর নিজের আব্বা তার এত কাছে দাঁড়িয়েও তাকে চিনতে পারছেন না! হঠাৎ করে তার বুকের ভিতরে কী যেন হয়ে গেল, সবকিছু ভুলে সে ভাঙা গলায় ডাকল, “আব্বা!”
আব্বার মুখে যন্ত্রণার চিহ্নটা হঠাৎ যেন আরও বেড়ে গেল। বুবুনের চোখে পানি এসে যায় হঠাৎ, অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখে বলল, “আব্বা! আমি বুবুন।”
খুব ধীরে ধীরে আব্বার মুখে শিশুর মতো একধরনের হাসি ফুটে উঠল, বুবুনের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “বুবুন! আমার বুবুন?”
“হ্যাঁ আব্বা।” বুবুন হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আব্বা এগিয়ে এসে শার্টের আস্তিন দিয়ে বুবুনের চোখ মুছিয়ে দিয়ে রাজীব হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বুবুন অনেক বড় হয়ে গেছে।”
“হ্যাঁ। বড় হয়ে গেছে।”
“অনেক বড় হয়ে গেছে।”
“হ্যাঁ, অনেক বড় হয়ে গেছে।”
“আগে ছোট ছিল।” আব্বা হাত দিয়ে দেখালেন, “এতটুকু ছিল আগে। এই যে এতটুকু।”
রাজীব হাসান এগিয়ে এসে আব্বার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “তুমি কয়েকদিন তোমার ছেলের সাথে থাকো। যদি তোমার ভালো না লাগে তা হলে আমি নিয়ে যাব।”
আব্বা কিছু বললেন না, কেমন যেন খুব চিন্তিত মুখে রাজীব হাসানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাজীব হাসান বললেন, “থাকবে?”
আব্বা বললেন, “সত্যি সত্যি আমাকে নিয়ে যাবেন তো?”
রাজীব হাসান হেসে ফেলে বললেন, “আমি কি কখনো তোমার সাথে মিথ্যা কথা বলেছি?”
আব্বা মাথা নাড়লেন, “না, বলেন নাই।”