বুবুন ঘুম থেকে উঠল বুকের ভিতরে একটা ফুরফুরে আনন্দ নিয়ে। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে এসে দেখল আম্মা কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করছেন। বুবুনকে দেখে বললেন, “কী হল? ঘুম ভাঙল?”
“কয়টা বাজে আম্মা?”
“অনেক বেলা হয়ে গেছে, ঘড়ি দ্যাখ!”
“স্কুল! আমার স্কুল?”
“হবে না আজকে।”
বুবুন ঘড়ি দেখতে যাচ্ছিল ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল, সাথে পিয়ালের গলার স্বর, “বুবুন তাড়াতাড়ি!”
বুবুন দরজা খুলতেই দেখতে পেল বাইরে পিয়াল আর সুমি স্কুলের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। গাব্বু পিঠে ব্যাগ ঝোলাতে ঝোলাতে আসছে। সুমি অবাক হয়ে বলল, “কী হল? তুইও এখনও রেডি হোসনি? স্কুলে যাবি না?”
“নাহ্!”
“কেন?”
“আমার আব্বাকে পাওয়া গেছে!”
“কী?” একসাথে সবাই চিৎকার করে উঠল, “কী বললি?”
বুবুন মাথা নাড়ল, “আমাদের কথা অবশ্যি মনে নাই। সব স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। আর—”
“আর কী?”
তার আব্বা যে বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছেন সেটা এখনই বলবে কি না বুঝতে পারছিল না, কিন্তু এত বড় একটা খবর চেপে রাখে কেমন করে? বলল, “আমার আব্বা এখন বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছেন।”
“বাচ্চা ছেলের মতো?”
“হ্যাঁ। আম্মা বলেছেন আমার ছোট ভাইয়ের মতো দেখে রাখতে হবে। সেজন্যে আজকে ঘরদোর গোছাতে হবে। তোরা যা।”
সুমির চোখ গোল গোল হয়ে উঠল, “কীভাবে ঘর গোছাবি?”
“এখনও জানি না। ছোট বাচ্চা থাকলে যেরকম ধারালো চাকু টাকু সরিয়ে রাখতে হয়, ম্যাচ লুকিয়ে রাখতে হয় মনে হয় সেরকম।”
“সত্যি?”
বুবুন মাথা নাড়ল।
সুমি উত্তেজনা লুকিয়ে রাখতে পারল না, “স্কুল থেকে এসে আমিও তোর আব্বার জন্যে ঘর সাজিয়ে দেব। ঠিক আছে?”
পিয়াল মুখ শক্ত করে বলল, “বুবুনের আব্বা ছোট ছেলের মতো হয়ে গেছেন–ছোট মেয়ের মতো তো হননি। তুই কেন সাজাবি?”
সুমি চোখ পাকিয়ে বলল, “সেটা বোঝার মতো ঘিলু যদি থাকত তা হলে তো তুই মেয়ে হয়েই জন্মতি!”
বাকবিতণ্ডা আরও খানিক দূর এগিয়ে যেত কিন্তু স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছিল, অন্য বাচ্চারা ডাকাডাকি শুরু করেছে বলে সুমি, পিয়াল আর গাবুকে চলে যেতে হল।
আম্মা আর বুবুন মিলে ঘরদোর পরিষ্কার করল। যেটা ছিল বুবুনের ঘর সেখানে আব্বা থাকবেন, বুবুন ঘুমাবে তার আম্মার সাথে। বুবুনের টেবিলটা খালি করা হল, তার খেলনা বই আর খাতাপত্র সরিয়ে আম্মার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। একটা শেলফ এনে সেখানে কিছু বই রাখা হল, আব্বা যখন ভালো ছিলেন তখন নাকি সেই বইগুলো পড়তেন। আগে বাসায় আব্বার কোনো ছবি টাঙানো থাকত না–দেখলেই আম্মার মন-খারাপ হয়ে যেত, সেজন্যে। এখন আর সেই সমস্যা নেই তাই আব্বার ছবিগুলো বের করে টানানো হল। বুবুনের বিছানায় ডাইনোসরের ছবি আঁকা বিছানার চাঁদর আর বালিশ ছিল, সেগুলো পালটে সাদা চাঁদর বালিশ দেওয়া হল। আব্বা গান শুনতে ভালোবাসতেন বলে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আর অনেকগুলি বরীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট রাখা হল, বুবুন অবিশ্যি আপত্তি করে বলল, “আম্মা, আব্বা যদি বাচ্চা ছেলের মতন হয়ে থাকেন তা হলে কি আর বরীন্দ্রসংগীত শুনবেন?”
আম্মা ভুরু কুচকে বললেন, “কী শুনবে তা হলে?”
“রবীন্দ্রসংগীত তো শোনে বুড়োমানুষেরা–”
“আমি বুড়ো?”
“আমার থেকে তো বুড়ো।”
“তা হলে কী গান রাখতে চাস?”
“খুব হৈচৈ মার্কা তালের গান।”
আম্মা বেশি কিছু বললেন না। দিনের বড় একটা অংশ গেল খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে। আব্বা যেসব জিনিস খেতে পছন্দ করতেন সেগুলো বাজার করে আনা হল, আম্মা হৈচৈ করে যেসব রান্না করলেন। বিকেলবেলা, সুমি, পিয়াল, গাব্ব, বকুল সবাই হাজির হল। সুমি বাগান থেকে ফুল তুলে এনেছে সেটা দিয়ে ফুলের তোড়া তৈরি করে ফুলদানিতে রাখা হল। গাব্বু এনেছে একটা সুপারম্যান এর পোস্টার আব্বা যখন বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছেন তখন বাচ্চা ছেলেরা যেসব পছন্দ করে সেসব নিশ্চয়ই পছন্দ করবেন–কিন্তু সুমি আর বকুলের প্রবল আপত্তির জন্যে সেটা টানানো গেল না!
বিকেলবেলা জাহিদ চাচা আব্বার জন্যে কিছু জামাকাপড় ভোয়ালে গেঞ্জি এসব কিনে আনলেন। আব্বা নাকি আগে ভালো চা পছন্দ করতেন সেইজন্যে ভালো দার্জিলিং চা নিয়ে এসেছেন। সাথে ভালো বিস্কুট।
সব মিলিয়ে চারিদিকে শুধু উৎসব-উৎসব ভাব। এখন বাকি শুধু আব্বার হাজির হওয়া। বুবুনের আর সময় কাটতে চায় না।
০৫. বাবা
৫. বাবা
দরজা খুলে বুবুন দেখল ডক্টর রাজীব হাসান হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, তার পাশে ফরসামতন একজন লম্বা মানুষ। রাজীব হাসান বললেন, “ভিতরে যাও মাসুদ।
ফরসা মতন লম্বা মানুষটি একটু অনিশ্চিতের মতো ভিতরে ঢুকল, বুবুন দেখল তার আম্মা অনেক কষ্টে নিজেকে থামিয়ে রেখেছেন, কিন্তু তার দুই চোখ : থেকে ঝরঝর করে পানি বের হতে শুরু করেছে। রাজীব হাসান অনেকবার বলে দিয়েছেন যেন কিছুতেই কোনোরকম হৈচৈ করা না হয়, এমন একটি ভান করতে হবে যেন পুরো ব্যাপারটি খুবই স্বাভাবিক। রাজীব হাসান যদি না বলতেন তা হলে আম্মা নিশ্চয়ই এখন ছুটে গিয়ে আব্বাকে ধরে ফেলতেন।
বুবুন অবাক হয়ে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল, বাসায় আব্বার সব ছবিতে আব্বা কালো ফ্রেমের চশমা পরে আছেন, কিন্তু এখন আব্বার চোখে কোনো চশমা নেই। আব্বার গায়ে খুব সাধারণ পোশাক, শার্টটা নতুন কিন্তু ইস্ত্রি নেই এরকম একটা প্যান্ট। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখে মনে হয় হাত দুটি নিয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। আব্বার চেহারা দেখে মনে হয় কিছু-একটা দেখে একেবারে হকচকিয়ে গেছেন, দুই চোখে একই সাথে বিস্ময় এবং ভয়। বুবুন হতচকিত হয়ে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল, এই তার আব্বা? তার নিজের আব্বা? আব্বা সম্পর্কে তার নিজের ভিতরে যেসব ধারণা ছিল তার কিছুই এই মানুষটার মাঝে নেই, এই মানুষটা একেবারে সাধারণ চেহারার সাধারণ একজন মানুষ, বড়দের মাঝে যেরকম একটা আত্মবিশ্বাস থাকে, তার কিছুই এর মাঝে নেই, একেবারে ছোট একজন বাচ্চার মতো। একজন বড় মানুষের শরীরে যেন একটা ছোট বাচ্চা আটকা পড়ে আছে–দেখে বুবুনের এমন মায়া হল যে সেটি আর বলার মতো নয়।