“কিন্তু মাসুদ একটা শিশুর মতো হয়ে গেছে। তার মানসিক বয়স আট-নয় বৎসর বয়সের একটা বাচ্চার মতো।”
আম্মা বুকে আটকে-থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে আবার ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, “আমার একটা বাচ্চা আছে, এখন নাহয় দুটো বাচ্চা থাকবে।”
রাজীব হাসান মাথা নেড়ে বললেন, “আপনার অ্যাটিচুড আমার খুব পছন্দ হয়েছে ডক্টর রওশান। আমি এটা নিয়ে একটু ভয় পাচ্ছিলাম। এতদিনের ব্যাপার, কিছু-একটা অন্যরকমও তো হতে পারত।”
“কী হবে? আমি এগারো বছর ধরে অপেক্ষা করছি!”
“এখনও অবিশ্যি একটা সমস্যা রয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি সবচেয়ে বড় সমস্যা।”
আম্মার মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল, “কী সমস্যা?”
‘মাসুদকে আপনাদের হাতে তুলে দেওয়া! বুঝতেই পারছেন, সে একেবারে সাত-আট বছরের বাচ্চার মতো–আমার ওখানেই মোটামুটি আছে। আপনাদের কথা জানে না–এখন সে তো আপনাদের সাথে থাকতে চাইবে না!”
বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“তুমি কি এখন তোমার মাকে ছেড়ে আরেকজনের সাথে থাকতে পারবে? সেই একই ব্যাপার। তোমার আব্বা এখন বয়সে তোমার থেকেও ছোট একটা বাচ্চার মতো!”
বুবুন কথাটা বুঝতে পারল কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব সেটা কোনোভাবেই ভেবে পেল না। রাজীব হাসান বললেন, “এখন একটা দিন ঠিক করে, খুব সাবধানে মাসুদকে এখানে আনতে হবে। প্রথম আপনাদের একসেপ্ট করবে না–“
আম্মা রাজীব হাসানকে বাধা দিয়ে বললেন, “আপনার কাছে ছবি আছে? মাসুদের ছবি?”
“হ্যাঁ। আমি একটা ছবি এনেছি। এই যে–” বলে রাজীব হাসান বুকপকেট থেকে একটা ছবি বের করলেন, আম্মা প্রায় এক নিমিষে ছিনিয়ে নিলেন ছবিটা। এক নজর দেখে ছবিটা দুই হাতে বুকের মাঝে চেপে ধরে আবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
ঠিক এই সময় দরজায় শব্দ হল, আম্মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছর চেষ্টা করলেন, বুবুন গিয়ে খুলে দিল। দরজায় জাহিদ চাচা দাঁড়িয়ে আছেন, হাসিহাসি মুখে বললেন, “কী খবর মিস্টার বুবুন?”
বুবুন কী বলবে বুঝতে পারল না, জাহিদ চাচা ভিতরে ঢুকে আম্মাকে আঁচল দিয়ে চোখমুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে একেবারে থতমত খেয়ে গেলেন। জাহিদ চাচা একবার ডাক্তার রাজীব হাসান আরেকবার বুবুনের দিকে তাকালেন, তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “আমি বলেছি না, আমি প্রত্যেকবার ভুল সময়ে চলে আসি!”
বুবুন বলল, “জাহিদ চাচা আমার আব্বা বেঁচে আছেন?”
জাহিদ চাচা চমকে উঠলেন, “কী বললে?”
“আমার আব্বা বেঁচে আছেন।”
“বেঁচে আছেন? সত্যি?”
“হ্যাঁ চাচা। আমাদের কারও কথা নাকি মনে নেই!”
জাহিদ চাচা তখনও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন, কোনোমতে আবার বললেন, “বেঁচে আছেন! বেঁচে আছেন?”
“হ্যাঁ চাচা। কিন্তু ব্রেনে টিউমার হয়েছিল তো তাই আমার আব্বা নাকি বাচ্চাদের মতো হয়ে গিয়েছেন।”
জাহিদ চাচা বললেন, “বেঁচে আছেন তা হলে! কী আশ্চর্য!”
.
ডাক্তার রাজীব হাসান আর জহিদ চাচাকে রাতে খেয়ে যেতে হল। খেতে খেতে ডাক্তার রাজীব হাসান আব্বার গল্প করলেন। কেমন করে তাকে পাওয়া গেল, কেমন করে তাকে হাসপাতালে রাখা হল, কেমন করে তার নাক দিয়ে চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল কোনো উপায় না দেখে কীভাবে তাঁর অপারেশান করা হল। কীভাবে কীভাবে আব্বা সুস্থ হলেন শুনতে শুনতে বুবুনের চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। আব্বার শার্টে যে ঠিকানা সেলাই করে রাখা ছিল এবং সেটা কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল সেটা শুনে বুবুনের প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এতদিন পরে কেমন করে সেই ঠিকানাটা খুঁজে পাওয়া গেল আর ডাক্তার রাজীব হাসান কীভাবে খুঁজে খুঁজে আম্মাকে বের করল সেই অংশটা শুনে বুবুন আনন্দে প্রায় হাততালি দিতে থাকে।
গভীর রাতে সবাই চলে গেলে আম্মা বুবুনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললেন, “বুঝলি বুবুন, সবাই বলেছিল তোর আব্বাকে ভুলে যেতে। সবাই! তুই পর্যন্ত বলেছিলি। আমি তবু মানুষটাকে মনে রেখেছিলাম। প্রত্যেকদিন রাতে আমি খোদাকে বলেছি, হে খোদা, মানুষটাকে ফিরিয়ে দাও। দেখলি, খোদা মানুষটাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে!”
“আমরা আব্বাকে আনতে কবে যাব আম্মা?”
“আমি তো আজ রাতেই যেতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু ডাক্তার সাহেব যে না। করলেন! বললেন একটু সময় দিতে।”
“কেন আম্মা?”
“তোর আব্বা তো এখন একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো, জোর করে আনা যাবে না, বুঝিয়ে আনতে হবে! ডাক্তার সাহেব গিয়ে বোঝাবেন, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসবেন। আমরা এই ফাঁকে বাসাটা রেডি করে ফেলব!”
“আম্মা!”
“কীরে বুবুন?”
“আব্বা যে তোমাকে ভুলে গেছে, বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছে, সেজন্যে তোমার মন-খারাপ হচ্ছে না?”
“ধূর বোকা ছেলে, মন-খারাপ হবে কেন! তোর আব্বা আগেই ভুলোমনের ছিল। তুই কি ভাবছিস আগে সে খুব বড় মানুষের মতো ছিল?”
বুবুন আম্মার গা ঘেঁষে বলল, “আম্মা!”
“কীরে বুবুন?”
“আব্বার একটা গল্প বলো না!” শুনবি? কীরকম বোকা ছিল মানুষটা বলি শোন!”
রাতে গল্প শেষ করে যখন বুবুন আর আম্মা শুতে গেলেন তখন ঘড়িতে রাত আড়াইটা বাজে। বুবুন অনেকক্ষণ জেগে রইল, তার মনে হচ্ছিল বুঝি কোনোদিন ঘুমাতে পারবে না। কিন্তু একসময় তার চোখেও ঘুম নেমে এল, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল তার আব্বা এসেছেন,বাচ্চা ছেলের মতো মোটেই নন, কী সুন্দর তার চেহারা, বিশাল পাহাড়ের মতো শক্ত শরীর। সে তার আব্বার ঘাড়ে চেপে বসে রইল আর আব্বা তাকে নিয়ে পাহাড়-জঙ্গল নদী পার হয়ে যাচ্ছেন, খবিরউদ্দিন আসছিল হাতে রামদা নিয়ে, আব্বা এক লাথি দিতেই সে উলটেপালটে ছিটকে গেল, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল, উড়ে গেল বাতাসে! কী যে ভালো লাগল বুবুনের সে আর বলার মতো নয়।