বুবুন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল তাদের বাসার সামনে আবছা অন্ধকারে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা তাদের বাসার দিকে আসতে শুরু করে আবার পিছিয়ে গেল। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে খুব ধীরে ধীরে বাসার সামনে পায়চারি করতে থাকে। সেখানে থাকে হেঁটে হেঁটে অন্যদিকে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আবার তাদের বাসায় সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
বুবুন কেমন জানি ভয় পেয়ে যায়। আম্মা রান্নাঘরে কাটাকাটি করছিলেন, বুবুন কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আম্মা, একটা লোক বাসার সামনে অনেকক্ষণ থেকে ঘোরাঘুরি করছে।”
“তুই কেমন করে জানিস?”
“আমি দেখেছি। বাসার দিকে আসতে শুরু করে আবার পিছিয়ে যায়।”
আম্মা গম্ভীর হয়ে গেলেন। সবজি কাটার ছুরিটা টেবিলে রেখে বললেন, “আয় দেখি।”
ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। বুবুন বলল, “ঐ যে, এসেছে।”
আম্মা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন, দরজার অন্যপাশে একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটার চোখে চশমা, মাথার চুল বেশিরভাগ সাদা। আম্মাকে দেখে বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই ডক্টর রওশান। আমি একজন ডাক্তার, আমার নাম রাজীব হাসান। আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে এসেছিলাম।”
আম্মা দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন, “আসেন। ভিতরে আসেন।”
ডাক্তার রাজীব হাসান ভিতরে এসে সোফায় বসে বুবুনকে দেখিয়ে বললেন, “এ নিশ্চয়ই আপনার ছেলে বুবুন?”
আম্মা মাথা নাড়লেন। ডাক্তার সাহেব মুখটা হাসিহাসি করে বললেন, “আপনার ছেলের বয়স এখন তেরো। যখন তার দুই বছর বয়স তখন থেকে আপনার হাসব্যান্ড মিসিং।”
হঠাৎ করে আম্মার মুখটা কেমন যেন কঠিন হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “আপনি ঠিক কী নিয়ে কথা বলতে এসেছেন?”
ডাক্তার রাজীব হাসান কেমন যেন কাঁচুমাচু হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ নিজের নখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “বলছি। তার আগে এক গ্লাস পানি খেতে পারি?”
আম্মা উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। ডাক্তার সাহেবের পানি খাওয়া দেখে মনে হল আসলে তার পানি তেষ্টা পায়নি, এমনি সময় নেওয়ার জন্যে খাচ্ছেন। একরকম জোর করে পুরো গ্লাস শেষ করে হাতের উলটোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে বললেন, “আমি ঠিক কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। সত্যি কথা বলতে কি আমি অনেকক্ষণ থেকে আপনার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছি।”
আম্মা বললেন, “জি, আমি জানি।”
“ব্যাপারটা আপনার ছেলের সামনেই বলব কি না বুঝতে পারছি না।”
আম্মা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “কথাটা না শোনা পর্যন্ত আমিও তো বলতে পারছি না আমার ছেলের সেটা শোনা উচিত হবে কি না।”
“কোনো-না-কোনো সময়ে তাকে তো জানতেই হবে”
“তা হলে তার সামনেই বলুন।”
ডাক্তার রাজীব হাসান আবার নিজের নখের দিকে তাকালেন, তারপর একরকম জোর করে মুখ তুলে আম্মার দিকে তাকালেন। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কথাটা আপনার স্বামীকে নিয়ে।”
আম্মা হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে প্রায় আর্তচিৎকার করে বললেন কী কথা?”
“আপনার স্বামী—”
রাজীব হাসান কথা শেষ করার আগেই আম্মা প্রায় দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, “বেঁচে আছে?”
রাজীব হাসান কিছু-একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু ঠিক বলতে পারলেন না। আম্মা ভাঙা গলায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, “বেঁচে আছে এখনও?”
রাজীব হাসান আস্তে আস্তে বললেন, “আমি ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি ডক্টর রওশান। হ্যাঁ, আপনার স্বামী মাসুদ আহমেদ বেঁচে আছে, তবে
আম্মা হঠাৎ বুবুনকে ঝাঁপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “বুবুন! তোর আব্বা বেঁচে আছে–
ডক্টর রাজীব হাসান সোফা থেকে উঠে আম্মার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “ডক্টর রওশান, প্লিজ আপনি আমাকে আমার কথা শেষ করতে দিন, নাহয় আপনার ভয়ংকর আশাভঙ্গ হবে, আমি তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। প্লিজ—প্লিজ–”
আম্মা রাজীব হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “না ডাক্তার সাহেব, আমার আশাভঙ্গ হবে না। মানুষটা যদি শুধু বেঁচে থাকে তা হলেই হবে, আমি আর কিছু চাই না। মানুষটা পাগল হোক, বদ্ধ উন্মাদ হোক, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হোক, কিছু আসে যায় না। গত এগারো বছর প্রতি রাতে আমি খোদার কাছে দোয়া করেছি, খোদা, মানুষটাকে বাঁচিয়েং রাখো, বাঁচিয়ে রাখো–”
রাজীব হাসান আম্মার পাশে বসে বললেন, “খোদা আপনার দোয়া শুনেছেন ডক্টর রওশান। আপনার স্বামী বেঁচে আছেন সত্যি, কিন্তু পুরোটুকু আগে শুনুন”
আম্মা চোখ মুছলেন, বুবুন বুঝতে পারল আম্মা এখনও থরথর করে কাঁপছেন। ডাক্তার রাজীব হাসান বললেন, “আপনার স্বামী অর্থাৎ মাসুদ বেঁচে আছে, কিন্তু তার কোনকিছু মনে নেই। তার থেকেও যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে–” ডাক্তার রাজীব হাসান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তার ব্রেনের সেরেব্রাল করটেক্সে যে ম্যালিগনেন্ট টিউমার হয়েছিল সেটা সরানোর সময় ব্রেনে মেজর ড্যামেজ হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম সে পুরোপুরি একটা ভেজিটেবলে হয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি প্রথমে তাই ছিল কিন্তু খুব ধীরে ধীরে বাউন্স ব্যাক করেছে। তার শরীরের কোঅর্ডিনেশান ফেরত পেয়েছে। কিন্তু–”
ডাক্তার রাজীব হাসান আবার একটু থেমে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের নখগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। আম্মা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললেন, “কিন্তু?”