গাব্বু বলল, “যারা সিগারেট খায় তাদের নিয়ে এলে হত, সবাই মিলে। সিগারেটে টান দিয়ে ভিতরে ধোয়া ছাড়ত।”
সুমি কোনো কথা না বলে বিষদৃষ্টিতে গাব্বর দিকে তাকাল। কিছুক্ষণের মাঝেই যেটুকু খবরের কাগজ আনা হয়েছিল পুড়ে ছাই হয়ে গেল, লাভের মাঝে লাভ হল সবাই কয়েক জায়গায় ছ্যাকা খেল, নাক দিয়ে ধোঁয়া ঢুকে খানিকক্ষণ কাশাকাশি করল, চোখে লেগে চোখ জ্বালা করতে লাগল। যে-শেয়ালকে বের করার জন্যে এত চেষ্টা-চরিত্র তার টিকিটিও দেখা গেল না। সুমি বলল, “পরের বার বেশি করে খবরের কাগজ আনতে হবে।”
“খবরের কাগজে হবে না–” পিয়াল মাথা নেড়ে বলল, “লাকড়ি নিয়ে আসতে হবে। সাথে বড় টেবিল ফ্যান। ফ্যান দিয়ে ধোঁয়া ভিতরে ঢোকাতে হবে।”
“ফ্যানটার প্রাগ লাগাবে কোথায়?”
পিয়াল থতমত খেয়ে বলল, “তাও তো কথা!”
সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে ফিরে যেতে যেতে টিলার চূড়োয় এসে আবার সেই আগের ইঁদুরের মতো মানুষটাকে দেখতে পেল, উদাস-উদাস মুখ করে তাকিয়ে আছে। তাদের এই ছোট দলটাকে দেখে আবার কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাল। ওরা যখন প্রায় চলে যাচ্ছিল তখন লোকটা বলল, “তোমরা কোথায় থাক?”
অচেনা সন্দেহজনক মানুষের সাথে কথাবার্তা বলা ঠিক না, কিন্তু একজন মানুষ যখন প্রশ্ন করছে কিছু-একটা তো বলতে হয়। গা অনিশ্চিতের মতো হাত নেড়ে বলল, ঐ তো ওইখানে।”
মানুষটা দূরে তাদের বাসার দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রওশন মানে একজন মেয়েলোক থাকে তারা বাসা কোনটা জান?”
বুবুন একটু চমকে উঠল, তার আম্মার নাম রওশন জাহান কিন্তু সবাই ডাকে ডক্টর রওশান। কখনো কেউ তাকে মেয়েলোক’ বলবে না, আরকিছু না হলে অন্ততপক্ষে ভদ্রমহিলা তো বলবে। বুবুনের সাথে সাথে সবাই তখন লোকটার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল। গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “কি করবেন তার বাসা দিয়ে?”
লোকটা এইবার থতমত খেয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, “না, মানে, এমনি জানতে চাচ্ছিলাম।”
বুবুন একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী করেন?”
“আমি?”
“হ্যাঁ। কী করেন আপনি? নাম কী আপনার? কোথায় থাকেন?”
লোকটার মুখ হঠাৎ কেমন জানি শক্ত হয়ে যায়, কর্কশস্বরে বলল, “আমি কী করি না-করি সেটা দিয়ে তুমি কী করবে?”
বুবুন বলল, “আপনি কিছু জানতে চাইলে দোষ নেই, আমরা জানতে চাইলে দোষ?”
সুমি বলল, “কথা বলে কাজ নই বুবুন, চলে আয়।”
বুবুন অন্য সবার সাথে ফিরে চলল, যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল মানুষটা চোখ ছোট ঘোট করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেন মানুষটা আম্মা কোন বাসায় থাকেন জানতে চেয়েছিল?
রাতে আম্মা একটা খাম খুলে একটা চিঠি বের করে পড়তে পড়তে হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। বুবুন একটু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আম্মা?”
“না, কিছু না।” খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “এই চিঠিটা কে দিয়েছে তুই জানিস?”
“না, আম্মা। কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
শেয়ালের গর্তে আগুন দিতে গিয়ে যে-মানুষটার সাথে দেখা হয়েছিল তার কথা বলবে কি না চিন্তা করে বুবুন বলেই ফেলল।”আমরা টিলায় গিয়েছিলাম সেখানে একটা লোক তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল।”
“কী রকম দেখতে?”
“ইঁদুরের মতো।”
আম্মা হেসে ফেলেন, “মানুষের চেহারা আবার ইঁদুরের মতো হয় কেমন। করে?”
“হয় আম্মা হয়। তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে।”
আম্মা কিছু বললেন না, হাতের চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কী লেখা আছে চিঠিতে!”
আম্মা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বললেন, “ঐ তো যা থাকে। ভয়-টয় দেখার আর কি!”
“কেন ভয় দেখায় আম্মা?”
“নিজেরা ভয় পায় তো সেইজন্যে ভয় দেখায়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ তো পড়াশোনা জানে না তাই ধর্মের কথা বলে কাঠমোল্লারা তাদের কন্ট্রোল করে। যখন মানুষ পড়াশোনা করে তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় এই কাঠমোল্লাদের। তাই মানুষজন পড়াশোনা করলে তারা খুব রেগে যায়।”
“পড়াশোনা করলে ক্ষতি হয় কেন আম্মা?”
“মনে কর এক জায়গায় ভূমিকম্প হল। তখন এই কাঠমোল্লারা বলবে এখানে আল্লাহর গজব হয়েছে। কিন্তু যদি তারা পড়াশোনা করে তা হলে জানবে আসলে আল্লাহর গজব না, এটা হয় ফল্ট লাইন থেকে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া থেকে। তখন তো তাদের ধোঁকা দেওয়া যায় না। যারা পড়াশোনা জানে না অসুখ হলে তারা পানিপড়া খায় আর যারা পড়াশোনা করেছে তারা খায় ওষুধ। এই হচ্ছে পার্থক্য।“
“কিন্তু তোমাকে কেন ভয় দেখায়?”
“আমার উপরে রাগ বেশি। একে আমি পড়াশোনার কথা বলি, তার উপর মেয়েদের পড়াশোনার–সেইজন্যে যা এখন ঘুমা গিয়ে।”
বুবুন যেতে ফিরে এসে বলল, “তারা তোমার কিছু করবে আম্মা?”
আম্মা হেসে বললেন, “ধুর বোকা! কী করবে আবার? এরা হচ্ছে যত রাজাকার আলবদর জামাতিদের দল। সেভেনটি ওয়ানে একবার তাদের টাইট দেওয়া হয়েছে–এখন আবার দেবে!”
বুবুন নিজের ঘরে ফিরে এল। আম্মা পুরো ব্যাপারটি হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ভান করেছেন কিন্তু বুবুন লক্ষ্য করেছে আম্মার মুখে সূক্ষ্ম একটা দুশ্চিন্তার ছায়া।
ইশ! তার যদি একটা বাবা থাকত! বিশাল শক্তিশালী একটা বাবা। সেই বাবা যদি তাকে আর তার আম্মাকে সমস্ত বিপদ থেকে বুক পেতে রক্ষা করত।
বুবুন বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
০৪. খবর
৪. খবর