শিউলি জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি শিউলি।”
.
ঝিকঝিক করে ট্রেন যাচ্ছে, জানালার কাছে শিউলি বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। তার এক হাতে একটা পেপসির বোতল আর অন্য হাতে একটা আপেল। আপেলটিতে ঘ্যাঁচ করে একটা কামড় বসিয়ে দিয়ে সেটা কচকচ করে খেতে খেতে শিউলি বলল, “এই বিলাতি পেয়ারাটা খেতে কী মজা দেখেছ?”
রইসউদ্দিন বললেন, “এটার নাম আপেল।”
“আপেল? এটাকে বলে আপেল?”
শিউলি হাতের আধখাওয়া আপেলটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ভেবেছিলাম আপেল আরও ছোট হয়, বরইয়ের মতন।”
শিউলি ঘ্যাঁচ করে আরও একটা কামড় দিয়ে আবার কচকচ করে আপেল খেতে খেতে হাতের পেপসিটাকে দেখিয়ে বলল, “এইটাকে কী বলে?”
“এটার নাম পেপসি।”
“পেপসি?”
শিউলি হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “ধরছি, মারছি, খাইছি, পেপসি! হি। হি হি!”
শিউলি অকারণে হাসতে থাকে এবং রইসউদ্দিন একটা বিচিত্র আতঙ্ক নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। যে-ছোট মেয়েটার জীবন বাঁচানোর জন্যে তিনি মোটামুটি পাগলের মতো ছুটে গেছেন, গত কয়েক ঘণ্টায় আবিষ্কার করেছেন, তার জীবন নেবার জন্যে স্বয়ং আজরাইল এলেও সে মনে হয় তাঁকে ঘোল খাইয়ে ফিরিয়ে দেবে। এত ছোট একটা মেয়ে কেমন করে এরকম চালাক-চতুর এবং ভয়ংকর হয় রইসউদ্দিন কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না। সবচেয়ে যেটা ভয়ের ব্যাপার সেটা হচ্ছে এই ভয়ংকর বাচ্চাটিকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন–এটা যদি আত্মহত্যা না হয় তা হলে আত্মহত্যা কাকে বলে?
শিউলি পেপসির বোতল থেকে বড় এক চুমুক পেপসি নিয়ে মুখে সেটা কুলকুচা করে খানিকটা পিচিক করে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ অকারণে আবার হি হি করে হেসে উঠল। রইসউদ্দিন শুকনো-মুখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন, “তুমি যে আমার সাথে চলে আসছ তোমার
ভয় করছে না?”
শিউলি মাথা নাড়ল, “করছে।”
“তা হলে?”
“কফিল চাচার কাছে থাকলে ভয় আরও বেশি হত। মনে নাই কফিল চাচা কেটেকুটে আমার কলিজা বিক্রি করতে যাচ্ছিল?”
“কলিজা না, কিডনি।”
“এক কথা।”
শিউলি পেপসির বোতলে আরেকটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, “কফিল চাচাকে একেবারে উচিত শাস্তি দিয়ে এসেছি। একেবারে টাইট করে দিয়ে আসছি!”
রইসউদ্দিন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী শাস্তি দিয়েছ?”
শিউলি তখন পেপসির বোতলে চুমুক দিতে দিতে কফিলউদ্দিনের নাকের ডগায় কীভাবে পাকাঁপাকিভাবে তার চশমাটা সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে দিয়ে এসেছে সেটা বর্ণনা করল এবং বলতে বলতে হাসির চোটে একসময় তার নাক দিয়ে খানিকটা পেপসি বের হয়ে এল।
শিউলির বর্ণনা শুনে রইসউদ্দিনের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তিনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শিউলির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। খানিকক্ষণ পর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে শুকনো গলায় বললেন, “তু-তু-তুমি কি মাঝে মাঝেই মানুষকে শাস্তি দাও?”
শিউলি মাথা নাড়ল, “দেই।”
“কেন দাও?”
“রাগ উঠে যায় সেইজন্যে দেই।”
“রা-রাগ উঠে যায়?”
“হ্যাঁ। কেউ বদমাইশি করলেই আমার রাগ উঠে যায়। চাচি যেইবার খামোকা আমাকে মারল সেইবারও আমার রাগ উঠে গিয়েছিল। তারেও শাস্তি দিয়েছিলাম।”
“কী শাস্তি দিয়েছিলে?”
শিউলি ঘটনাটা বর্ণনা করার আগেই হাসতে হাসতে একবার বিষম খেয়ে ফেলল। পুরো ঘটনাটা তার মুখে শোনার পর হঠাৎ করে রইসউদ্দিনের মনে হতে লাগল তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে চিঁচি করে বলেন, “তোমার আসলেই কোনো আত্মীয়স্বজন নেই?”
“আছে। আমার ছোট চাচা আছে।”
“কে? ঐ যে রাইচউদ্দিন?”
শিউলি তার পেপসির শেষ ফোঁটাটা খুব তৃপ্তির সাথে শেষ করে বলল, “না, ঐটা বানানো। কফিল চাচাকে শান্ত রাখার জন্যে বলেছিলাম। আমার আসল চাচা আমেরিকা থাকে।”
“কী নাম?”
“পুরো নাম কী?”
শিউলি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “পুরো নাম তো জানি না।”
“কী করেন তোমার চাচা?”
“আমাকে পিঠে নিয়ে দৌড়ান, পেটে কাতুকুতু দেন।”
রইসউদ্দিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আর কী করেন? কোথায় কাজ করেন?”
“সেটা তো জানি না।”
শিউলির মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “খুব সুন্দর চেহারা রঞ্জু চাচার, একেবারে সিনেমার নায়কদের মতো।”
“আমেরিকায় কোথায় থাকেন জান?”
”না, জানি না।”
শিউলি হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেল। এই দুষ্টু মেয়েটার চেহারায় সবকিছু মানিয়ে যায়, গাম্ভীর্যটা একেবারেই মানায় না। সেই বেমানান চেহারায় বলল, রঞ্জু চাচা আমাকে খুব আদর করেন। যদি শুধু খবর পান তা হলেই আমেরিকা থেকে এসে নিয়ে যাবেন।
রইসউদ্দিন চুপ করে রইলেন। শিউলি তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি আমেরিকায় রঞ্জু চাচাকে খবর পাঠাতে পারবে?”
রইসউদ্দিন শিউলির দিকে তাকালেন, নায়কের মতো চেহারার একজন মানুষ যে শিউলিকে কাঁধে নিয়ে দৌড়ায়, পেটে কাতুকুতু দেয়, যার সম্পর্কে একমাত্র তথ্য যে তার নাম রঞ্জু-তাকে আমেরিকার পঁচিশ কোটি মানুষের মাঝে থেকে খুঁজে বের করে শিউলির খবরটা পৌঁছাতে হবে। রইসউদ্দিনের কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, কিন্তু শিউলির চোখের দিকে তাকিয়ে তার মায়া হল, তিনি নরম গলায় বললেন, “পারব শিউলি। তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তোমার চাচাকে খবর পাঠাব।”
০৩. খেতে বসে প্লেটের দিকে তাকিয়ে
০৩.