পরদিন ভোরে আবার কেউ ঘুম থেকে জাগার আগেই বকুল ছুটে ছুটে শুশুকটাকে দেখতে এল। তারাপদ মাস্টার যে-গাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল তার নিচে দাঁড়িয়ে বকুল নদীর তীরে উঁকি দিয়ে দেখল শুশুকটা সেখানে নেই। শুশুকটা নিশ্চয়ই ভালো হয়ে চলে গেছে, বকুলের আনন্দ হবার কথা ছিল, কিন্তু কেন জানি আনন্দ না হয়ে তার একটু মনখারাপ হয়ে গেল, শুশুকটার উপরে তার এত মায়া পড়ে গিয়েছে যে, সে আর বলার নয়। বকুল খানিকক্ষণ নদীতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, পা দিয়ে পানিতে শব্দ করল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে নদী থেকে উঠে এল। শুশুকটা চলেই গেল শেষ পর্যন্ত, তাকে শেষবারের মতো ভালো করে একবার আদরও করে দিতে পারল না!
বকুল মন-খারাপ করে নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকে, সামনে কিছু ঝোঁপঝাড়, তারপর সর্ষেক্ষেত, সর্ষেক্ষেতের পর কুমোরপাড়া শুরু হয়েছে। বকুল সর্ষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ নদীর পানিতে ছলাৎ করে একটা শব্দ শুনতে পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, পানিতে আধডোবা হয়ে শুশুকটা ভেসে আছে, দেখে মনে হচ্ছে বকুলকে কিছু বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
বকুল ছোট একটা চিৎকার দিয়ে পানিতে ছুটে গেল, শুশুকটা ভয় পেয়ে সরে গেল না, বরং লেজ নেড়ে একটু এগিয়ে এল। বকুল হাত দিয়ে শুশুকটার মাথায় থাবা দিয়ে বলল, “আরে শুশুক সোনা! তুই এসেছিস? এসেছিস আমার কাছে?”
শুশুকটা আরেকটু এগিয়ে এসে তার মাথা দিয়ে বকুলকে একটা ছোট ধাক্কা দেয়, মনে হয় এটা তার ভালোবাসা প্রকাশের একটা ভঙ্গি। বকুল গলায় হাত বুলিয়ে আদর করার মতো গলায় বলল, “আরে আমার শুশকি টুশকি! আমি ভাবলাম তুই আর কোনদিন আসবি না! ভালো হয়ে চলে গেছিস!”
শুশুকটা আবার তার মাথা দিয়ে বকুলকে ছোট একটা ধাক্কা দিল। বকুল তার গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল, “খুব সাবধানে থাকিস শুশকি টুশকি। শ্যালো নৌকার নিচে আর যাবি না, লঞ্চের ধারেকাছে আসিস না। যখন বড় জাল দিয়ে মাছ ধরবে তুই দূরে দূরে থাকিস। ভালো করে খাবি। তুই কি খাস সেটা তো জানি না তবে যেটাই খাস ভালো করে খাবি। পেট ভরে খাবি। ঠিক আছে?”
শুশুকটা পানি থেকে মাথা উপরে তুলে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বকুল শুশুকটার মসৃণ চকচকে শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, “দুষ্টুমি করবি না শুশুকি টুশকি। মারপিট করবি না। পিঠের ঘা’টা সারতে মনে হয় সময় নেবে, লক্ষ রাখিস। কোনকিছু দরকার হলে চলে আসিস আমার কাছে, ঠিক আছে টুশকি?”
হঠাৎ দূর থেকে কে যেন বলল, “কী রে বকুল, এত সকালে পানিতে নেমে কী করছিস?”
বকুল মাথা তুলে দেখল, গরু নিয়ে যাচ্ছেন রহমত চাচা। এত দূর থেকে শুশুকটাকে নিশ্চয়ই দেখেননি। বকুল ফিসফিস করে শুশুকটাকে বলল, “যা টুশকি যা। চলে যা এখন। কেউ দেখলে সমস্যা হয়ে যাবে!”
বকুল পানি থেকে উঠে আসতে শুরু করতেই শুশুকটা লেজ নেড়ে নদীর গভীর চলে যেতে শুরু করল। রহমত চাচা কাছাকাছি গরুটার লেজ মুচড়ে দিয়ে বললেন, “একলা একলা কার সাথে কথা বলিস?”
“কারও সাথে না। পায়ে গোরব লেগেছিল তাই ধুতে গিয়েছিলাম।”
রহমত চাচা হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বললেন, “পাগলি মেয়ে! আমি দেখলাম তুই বিড়বিড় করে কথা বলছিস। বড় হয়ে তুইও আরেকটা জমিলা বুড়ি হবি নাকি?”
বকুল দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে শুরু করল।
০৪. নীলা বিছানায় হেলান দিয়ে
নীলা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে, তার বুক পর্যন্ত একটা সাদা চাঁদর দিয়ে ঢাকা। তার মাথার কাছে কালো টেবিলের উপর একটা কাঁচের ট্রে। সেই ট্রে’র উপরে ক্রিস্টালের গ্লাসে কমলার রস। হাফপ্লেটে রুটির উপর মাখন লাগানো, দুটি আপেল। বিছানায় তার পায়ের কাছে ইশতিয়াক সাহেব বসে আছেন। তিনি একটু এগিয়ে এসে নীলার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে বললেন, “কিছুই তো খেলি না মা!”
“খেতে ইচ্ছে করে না বাবা।”
“ইচ্ছে না করলেও তো খেতে হয়। নাহয় শরীরে জোর পাবি কেমন করে?”
নীলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি আর শরীরে জোর পাব না আব্বু। আমি জানি।”
ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ছি! এভাবে কথা বলে না মা।–”
“কী হয় বললে? এটা তো সত্যি। আমি তো মরে যাব বাবা। আমি জানি, তুমি জান, সবাই জানে।”
“এভাবে কথা বলে না। ছি মা!”
“আমি কবে মারা যাব সেটাও আমি জানি।”
“ছি মা, এভাবে কথা বলে না!”
নীলা হঠাৎ দুই হাত দিয়ে তার বাবার হাত ধরে বলল, “ঠিক আছে আব্বু, বলব না। আর কখনো বলব না।”
কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপ করে বসে থাকে। ইশতিয়াক সাহেব–মালা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের সর্বময় কর্তা, বোর্ড অফ ডিরেক্টরস থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের বড় বড় মানুষের সাথে যে-কোন সময় যে-কোন পরিবেশে কথা বলতে পারেন, কিন্তু হঠাৎ করে নিজের বারো বছরের মেয়ের সামনে আর কথা বলার কিছু খুঁজে পেলেন না। নীলা খানিকক্ষণ তার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমার শুধু তোমার জন্যে চিন্তা হয় আব্বু। আমি তো আম্মুর সাথে থাকব। তুমি একা একা কেমন করে থাকবে?”
ইশতিয়াক সাহেবের চোখে হঠাৎ পানি চলে আসতে চায়। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বললেন, “তুই তো আম্মুকে কখনো স্বপ্নে দেখিস মা?”