নদীর তীরে এসে বকুলের মনটা একটু শান্ত হল। নদীর মাঝে মনে হয় কোন ধরনের জাদু থাকে, রাগ দুঃখ যেটাই থাকুক কেমন করে জানি সেটা কমে আসে। বকুল একা একা নদীর তীরে ধরে হেঁটে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল, এদিকে কুমোরপাড়া, তার পরে খানিকটা ফাঁকা মাঠ, এরপর সর্ষেক্ষেত, কিছু ঝোঁপঝাড় এবং বড় বড় গাছপালা। বছর দুয়েক আগে এখানে একটা গাছে তারাপদ মাস্টার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল বলে কেউ সহজে আসতে চায় না। বকুল নিজেও এদিকে খুব আসে না। কিন্তু আজ মন-খারাপ করে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে এসেছে। গ্রামের অনেকেই মাঝরাতে এখানে তারাপদ মাস্টারকে বইপত্র নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছে কথাটা মনে পড়তেই বকুলের কেমন জানি ভয়-ভয় করতে লাগল। সে যখন ফিরে চলে আসছিল হঠাৎ মনে হল নদীর কাছে ঝোঁপের মাঝ থেকে কেউ তাকে শব্দ করে ডাকল। বকুল ভয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠতে গিয়ে কোনমতে নিজেকে সামলে নিল, দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
কেউ তার কথার উত্তর দিল না, কিন্তু মনে হল কেউ যেন এবারে পানিতে একটা শব্দ করল। বকুল খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, দৌড়ে পালিয়ে যাবার একটা প্রবল ইচ্ছেকে অনেক কষ্ট করে আটকে রেখে সে সাবধানে এগিয়ে যায়। পা টিপে টিপে ঝোঁপটার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে সে চমকে ওঠে, একজন মানুষ নদীর পানিতে অর্ধেক শরীর ডুবিয়ে তীরের কাদাপানিতে শুয়ে আছে। বকুল ভয়ে ভয়ে ডাকল, “কে?”
মানুষটা কোন কথা না বলে নিঃশ্বাস ফেলার মতো একটা শব্দ করল এবং বকুল হঠাৎ চমকে উঠে আবিষ্কার করল এটি মানুষ নয়, এটি একটি শুশুক।
বকুল জন্মের পর থেকে নদীর তীরে তীরে মানুষ হয়েছে, সে অসংখ্যবার শুশুককে পানি থেকে লাফিয়ে উঠতে দেখেছে, এক-দুইবার জেলের জালেও শুশুককে আটকা পড়তে দেখেছে, কিন্তু কখনোই এভাবে ডাঙায় মাথা রেখে কোনো শুশুককে শুয়ে থাকতে দেখেনি। বকুল প্রায় দৌড়ে শুশুকটার কাছে ছুটে গেল, ভেবেছিল শুশুকটা বুঝি সাথে সাথে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে–কিন্তু তা হল না, যেভাবে শুয়েছিল সেভাবেই শুয়ে রইল। বকুল পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়, শুশুকটার মাথাটা দেখে কেমন জানি হাসিহাসি মুখের একজন মানুষের মাথার মতো মনে হয়, চোখ দুটি এত ছোট সেটা দিয়ে কিছু দেখতে পায় বলেই মনে হয় না। ধূসর চকচকে মসৃণ দেহে শুশুকটা নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। বকুল কাছে গিয়ে সাবধানে শুশুকটাকে স্পর্শ করতেই সেটি তার লেজ নেড়ে পানিতে একটা শব্দ করল, শুশুকটাকে দেখে মরে গেছে বলে মনে হলেও সেটা আসলে এখনও মরেনি।
বকুল ভালো করে শুশুকটাকে দেখল, সে জানে এটা পানিতে থাকলেও এবং মাছের সাথে চেহারায় একধরনের মিল থাকলেও এটা মাছ না। এটা কুকুর বেড়াল বা গরু-ছাগলের মতো একটা প্রাণী। কুকুর-বেড়াল বা গরু-ছাগলের যেরকম অসুখ হয় এটার মনে হয় কোনরকম অসুখ হয়েছে। বকুল আবার সাবধানে শুশুকটার শরীর স্পর্শ করল, মসৃণ চামড়া কেমন যেন শুকিয়ে আছে। যে-প্রাণী পানিতে থাকে তার শরীর এভাবে শুকিয়ে থাকা নিশ্চয়ই ভালো ব্যাপার না, শরীরটা ভিজিয়ে দিলে শুশুকটা হয়তো একটু আরাম পাবে। বকুল সাবধানে পাশে গিয়ে দুই হাতে আঁজলা করে পানি এনে শুশুকটার শরীরে ভিজিয়ে দিতে থাকে। শুশুকটা আবার একটা নিঃশ্বাস নেবার শব্দ করে দুর্বলভাবে একটু নড়ে উঠল এবং ঠিক তখন সে শুশুকটার সমস্যাটা বুঝতে পারল। তার পিঠের কাছে এক জায়গায় একটা ধাতব কী যেন লেগে আছে। শুকনো রক্তের ধারা দুই পাশে শুকিয়ে আছে। বকুল জিব দিয়ে চুকচক করে বলল, “আহা বেচারা!”
শুশুকটা মনে হল তার কথা বুঝতে পারল এবং হঠাৎ মুখটা একটু খুলে নিচু একধরনের শব্দ করল, বকুলের একেবারে পরিষ্কার মনে হল যেন সেটি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। একটা ছোট বাচ্চা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে যেরকম মায়া হয় হঠাৎ করে বকুলের শুশুকটার জন্যে সেরকম মায়া হতে লাগল। সে ভিজে হাত দিয়ে শুশুকটার শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলল, “তোমার কোনো চিন্তা নেই শুশুক সোনা, আমি তোমার পিঠ থেকে এই লোহার টুকরোটা তুলে দেব। একেবারে ভালো হয়ে যাবে তুমি, তখন আবার নদীর মাঝে সাঁতার কাটতে পারবে–”
কথা বলতে বলতে সে শুশুকটার পিঠে হাত দিয়ে ধাতব টুকরোটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টানে সেটা খুলে আনল, সাথে সাথে গলগল করে খানিকটা রক্ত বের হয়ে এল। শুশুকটা হঠাৎ ছটফট করে উঠে শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করল, বকুলের মনে হল সেটা পানিতে চলে যাবার চেষ্টা করছে। বকুল শুশুকাকে ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে আদর করার ভঙ্গিতে বলল, “আহা রে শুশুক সোনা, তোমার ব্যথা লেগেছে? আমি তো ব্যথা দিতে চাইনি, শুধু এটা খুলে দিতে চাইছি! এই তো এখন খুলে গেছে, আর কোন ভয় নেই!”
বকুলের কথা মনে হয় শুশুকটা বুঝতে পারল, এক-দুবার লেজ দিয়ে পানিতে ঝাঁপটা দিয়ে আবার শান্ত হয়ে গেল। পিঠ দিয়ে এখনও রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে মনে হচ্ছে থেমে আসবে একটু পরেই। বকুল আপার হাত দিয়ে আঁজলা করে পানি এনে শুশুকটাকে ভিজিয়ে দিল। একবার চেষ্টা করল সেটাকে ঠেলে পানিতে নামিয়ে দিতে, কিন্তু পারল না, মনে হচ্ছে কোন কারণে এটা পানিতে নামতে চাইছে না।