হ্যাঁ।
দুঃস্বপ্ন এখন নিশ্চয়ই দেখছি না?
জ্বি-না, দেখছি না।
শুনে খুব খুশি হলাম। মনস্তত্ত্ববিদ্যা একটি বড় বিদ্যা–তা কি বুঝতে পারছ?
পারছি।
ভবিষ্যতে যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে আমার কাছে আসবে। তবে আমার মনে হয়। ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না। যদি হয় তুমি নিজে তার সমাধান করতে পারবে। পাববে না?
হ্যাঁ পারব।
তোমার হাসি-খুশি মুখ দেখে ভালো লাগছে। সত্যিকাব হাসিমুখ অনেক দিন দেখি না। চারদিকে ভেজাল হাসি দেখি।
হাসির ভেজালও আপনি ধরতে পারেন?
অবশ্যই পাবি। আমার নিজের মুখে যে হাসিটি আমি ঝুলিযে রাখি তা হলো ভেজাল হাসি। একশ ভাগ ভেজাল। তুমি তোমার জীবনে ভেজাল হাসিকে আসতে দিও না। মনে কষ্ট পেলে কাদবো। মনের কষ্ট চাপা দেয়ার জন্য হাসির ভান করাধ প্রয়োজন নেই।
আমি আপনার উপদেশ মনে রাখব ডা. ভারমান।
ডা. ভারমানের উপদেশের জন্যই হয়তো দেশ থেকে মার চিঠি পেয়ে লিলিয়ান সারাদিন কাঁদল। চিঠিটি তিনি মেয়ের বিয়ের সংবাদ পাওয়ার পর লিখেছেন। সংক্ষিপ্ত চিঠি। যদিও লিলিয়ানের মার হাতে লেখা। তবু লিলিয়ান জানে–এই চিঠি তার বাবা লিখে দিয়েছেন। মা শুধু দেখে দেখে কপি করেছেন। কপি করতে গিয়েও মার বানান ভুল হয়েছে। বাবা সেইসব বানান শুদ্ধ করেছেন।
লিলিয়ান,
তোমার বিবাহের সংবাদ পাইয়াছি। আনন্দে উল্লসিত হই নাই। তুমি নিশ্চয়ই তা আশাও কর না। তুমি খুব ভালো জানো তুমি আমাদের সবার অতি আদরের ধন ছিলে। তোমাকে নিয়া আমাদের স্বপ্নের অন্ত ছিল না। তুমি সব স্বপ্নের অবসান ঘটাইয়াছ। আমি তোমাকে দোষ দেই না। ঈশ্বরের হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না। এই ক্ষেত্রেও তাঁর ইচ্ছারই প্রতিফলন হইয়াছে। আমি তোমার এবং তোমার স্বামীর সুখী সুন্দর জীবন কামনা করি। যে সুখের জন্য তুমি আমাদের পরিবারের সকলের সুখ তুচ্ছ করিয়াছ, ঈশ্বর যেন সেই সুখ তোমাকে দেন ইহাই আমাদের সকলের কামনা।
এখন তোমাকে কিছু কথা বলিব, মন দিয়া শোন। তোমার বাধা পরিবারের সদস্য হিসেবে তোমাকে গ্ৰহণ করিবার ব্যাপারে অনিচ্ছা! প্ৰকাশ করিয়াছেন। আমাদের সকলেরই সেইমতো অভিমত। সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে তোমাকে বর্জন করা হইয়াছে। ইহাতে মনে কষ্ট পাইও না। তুমি সকলকে ত্যাগ করিয়া একজনকে পাইতে চাহিয়াছ। ঈশ্বর তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করিয়াছেন।
এক্ষণে বাড়িতে তোমার নাম আর উচ্চারিত হইবে না। তোমার ব্যবহারী জিনিস, তোমার ফটোগ্রাফ সমস্ত নষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তুমি আমাদের সহিত কোনো রকম যোগাযোগ রাখিবার চেষ্টা করিবে না। যোগাযোগ করিবার চেষ্টার অর্থই হইবে আমাদিগকে কষ্ট দেওয়া এবং নিজে কষ্ট পাওয়া।
ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। ঈশ্বরের নিকট তোমার প্রসঙ্গে ইহাই আমাদের শেষ প্রার্থনা।
তোমার হতভাগিনী মা।
পুনশ্চ: মা, তোমার দুঃস্বপ্ন দেখা কি বন্ধ হয়েছে?
লিলিয়ানের ধারণা চিঠির শেষের পুনশ্চ অংশটি মার লেখা। মা বাবাকে না জানিয়ে এই বাক্যটি লিখেছেন। কেন মায়েরা এত ভালো হয়? কেন হয়? সে নিজে কি কোনো একদিন এমন একজন মা হবে?
লিলিয়ান কাঁদতে কাঁদতে ভাবল আমার প্রথম সন্তানটি যেন মেয়ে হয়। মেয়ে হলেই আমি মার নামে তার নাম রাখতে পারব।
ভিন দেশের ভিন ধর্মের
ভিন দেশের ভিন ধর্মের একটি ছেলেকে বিয়ে করে ফেলার মতো কোজ সাধারণত প্ৰচণ্ড ঝোঁকের মাথায় করা হয়, এবং ঝোঁক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিয়ের এক মাসের মধ্যেই মনে হতে থাকে, কাজটা ঠিক হয় নি। খুব ভুল হয়ে গেছে। এদের বেলায় এটা ঘটল না। বিয়ের এক বছর পর এক গভীর রাতে লিলিয়ানের মনে হলো, আমি নিশ্চয়ই আমার শৈশবে কিংবা আমার যৌবনে বড় ধরনের কোনো পুণ্যকর্ম করেছি। বড় ধরনের কোনো পুণ্যকর্ম ছাড়া এমন একজনকে স্বামী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে পাওয়া যায় না। লিলিয়ান একা একা কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর চেষ্টা করল তাহেরের ঘুম ভাঙাতে। পারল না। তাহেরের ঘুম ভাঙানো সত্যি সত্যি অসম্ভব ব্যাপার। লিলিয়ানের খুব ইচ্ছা করছিল তাহেরের ঘুম ভাঙিয়ে তাকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে যায়। গভীর রাতে নির্জন রাস্তায় হাত ধরাধরি করে। হাঁটতে হাঁটতে সে তাহেরকে বলে–আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার জন্য আলাদা করে রাখা এই ভালোবাসা কখনো নষ্ট হবে না। কখনো না।
বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তাহের ফিফথ এভিন্নুতে নতুন বাড়ি নিল। বিশাল ড়ুপলেক্স। একতলায় খাবার ঘর, বসার ঘর, লাইব্রেরি। কাম স্টাডি রুম এবং একটা গেস্ট রুম। দোতলায় চারটা শোবার ঘর। এত বড় বাড়ির তাদের কোনোই প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাহের ছোট বাড়ি নেবে না। ছোট বাড়িতে তার নাকি দিম বন্ধ হয়ে আসে। ছোট বাড়ি নেবার কথা বলতেই তাহের হাসতে হাসতে বলল, আমার পূর্বপুরুষরা খুব বড় বড় বাড়িতে থাকতেন–বুঝলেন বিদেশিনী; কাজেই আমিও বড় বাড়িতে থাকব। বেতন যা পাই সেখান থেকে টাকা আলাদা করে রাখব। বছর পনের পর সেই টাকায় দশ একর জায়গা নিয়ে এমন বাড়ি বানাব যে তোমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাবে।
হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে তাহের যা পায় তা তার জন্য যথেষ্ট–জমানো দূরে থাকুক মাসের শেষে সে শেষ কোয়ার্টারটিও খরচ করে শুকনো মুখে লিলিয়ানকে বলে–লিলি! তোমার কাছে কি গোটা বিশেক ডলাব হবে? তখন তাহেরের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে লিলিয়ানের চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করে–I love you, I love you… সে অবশ্যি চেঁচিয়ে বলে না। মনে মনে বলে যেন তাহের কখনো ধরতে না পাবে। যেমন ধরা যাক, তাহের কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে যখন বলে–বাহ তুমি তো একসেলেন্ট কাঁপাচিনো কফি বানাতে শিখে গেছ? এসো আমরা একটি কফি শপ চালু কবি। কফি শপের নাম হবে–লিলিয়ানস কাঁপাচিনো। তখন লিলিয়ান মনে মনে বলে–I love you, I love you, ঈশ্বর মানুষকে প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছেন, মনের কথা বুঝবার ক্ষমতা দেন নি। যদি দিতেন তাহলে তাহের বুঝতে পারত কী গাঢ় ভালোবাসায় লিলিয়ান এই মানুষটাকে ঘিরে রেখেছে।