- বইয়ের নামঃ আসমানীরা তিন বোন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
বড় বোনের নাম আসমানী
বড় বোনের নাম আসমানী। আসমানীর সঙ্গে মিল রেখে তার পরের জনের নাম। জামদানী। তৃতীয়জনের জন্যে মিলের নাম খুঁজে পাওয়া গেল না। তার নাম পয়সা।
এত নাম থাকতে পয়সা নাম কেন–তার ইতিহাস আছে। জমির আলী তার তৃতীয় কন্যার জন্মের সময় খুবই অর্থকষ্টে পড়েছিল। সে বসে ছিল নদীর ঘাটলায়। খেয়া পারানি দেখতে দেখতে তার মনে অতি উচ্চশ্রেণীর চিন্তা-ভাবনা হচ্ছিল। যেমন–এমন কোনো ব্যবস্থা যদি থাকত যে, সন্তান জন্মের পরপর তাকে ওজন করা হবে। সরকারের কাছ থেকে ওজনের সমান সোনা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেয়া হবে। মোটাসোটা বাচ্চা যাদের হবে তারা লাভবান, সোনা বেশি পাবে। চিকনা-চাকনাগুলি পাবে কম। মায়ের কোলে যেসব সন্তান মারা যাবে তাদের জন্যে আফসোস লাশ দাফনের খরচ ছাড়া কিছুই পাবে না।
জমির আলী মাটি কাটার কাজ করত। বর্তমানে ভিক্ষা করে। ভিক্ষা করার জন্যে সুন্দর সুন্দর জায়গা খুঁজে বের করে। খেয়াঘাট জায়গা হিসেবে ভালো। ভিক্ষা তেমন পাওয়া যায় না, তবে নৌকায় লোক পারাপার করে, দেখতে ভালো লাগে। কত কিসিমের মানুষ নামে। কেউ উদাস কেউ কুদাস। কুদাস শব্দটা জমির আলীর আবিষ্কার। কুদাস হলো উদাসের উল্টা। উদাস মানুষ দেখতে ভালো লাগে। কুদাস দেখতে ভালো লাগে না। জমির আলীর ধারণা। সে একজন উদাস মানুষ এবং ভাবের মানুষ। সে ভাবনা-চিন্তা ছাড়া থাকতেই পারে না।
ভাবনা-চিন্তার জন্যে ভিক্ষা পেশাকে তার আদর্শ পেশা বলে মনে হয়। সামনে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা রেখে ভাবনা-চিন্তা কর। কোনো সমস্যা নাই। মাঝে মধ্যে চলমান পাবলিকের দিকে তাকিয়ে বলা একটা পয়সা দিয়া যান। একটা পয়সা হারায়ে গেলে আপনের কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু একজনের জীবন রক্ষা হবে। কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলেও হয়। যার দেবার সে চাইলেও দিবে, না চাইলেও দিবে। যে দিবে না তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে এক ঘণ্টার বক্তৃতা দিলেও কিছু হবে না। খামাখা পরিশ্রম।
জমির আলী পরিশ্রম পছন্দ করে না। তার ধারণা আল্লাহপাক পরিশ্রম করার জন্যে মানুষকে তৈরি করেন নাই। পরিশ্রম করার জন্যে তিনি তৈরি করেছেন গাধা এবং মহিষকে। ফাজলামি করার জন্যে তৈরি করেছেন বানরকে। ময়লা ঘটার জন্যে তৈরি করেছেন শূকর এবং কাককে। একেক কিসিমের জন্তু একেক উদ্দেশ্যে তৈরি করা। মানুষও জন্তু। তাকেও একটা উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। উদ্দেশ্যটা কী, মাঝে-মধ্যে জমির আলী সেই নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করে। এখনো তেমন কিছু বের করতে পারে নি।
তার তৃতীয় সন্তানের জন্মের খবর যখন সে পায় তখন সে উদাস গলায় বলছিল–ভদ্রলোকের সন্তানরা, একটা পয়সা পঙ্গু মানুষটাকে দিয়া যান। (কথাটা সত্য না। সে পঙ্গু না। মাটি কাটার কাজ সে ইচ্ছা করলে এখনো করতে পারে, তবে ইচ্ছা করে না।) কন্যার জন্মের সময় পয়সা নামটা মুখে ছিল বলে। কন্যার নাম রাখা হলো পয়সা। সে তৎক্ষণাৎ মেয়ের মুখ দেখার জন্যে বাড়িতে রওনা হলো না। মেয়ের ভাগ্য কেমন দেখার জন্যে ঘণ্টা দুই খেয়াপাড়ে বসে রইল। মেয়ে ভাগ্যবতী হলে ভালো ভিক্ষা পাওয়া যাবে। দেখা গেল মেয়ের ভাগ্য খারাপ না। দুই ঘণ্টায় এগারো টাকা উঠে গেল।
মেয়ের পয়সা নামকরণের পর তার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা এলো তা হচ্ছে–পয়সা জিনিসটা দেশ থেকে উঠে গেছে। ভিক্ষা করার সময় সে অবশ্যি চায় পয়সা। মানুষ দেয় টাকা। জিনিস উঠে গেছে কিন্তু নাম থেকে গেছে। পয়সা বলে কিছু নাই, কিন্তু পয়সা নামটা আছে! এরকম জিনিস আর কী আছে যে জিনিস নাই কিন্তু নাম আছে? জমির আলী গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। একই সঙ্গে জগতে চিন্তার বিষয় অনেক আছে এটা ভেবে সে নিশ্চিন্ত বোধ করে। চিন্তার বিষয় শেষ হয়ে গেলে তার জন্যে সমস্যা হতো। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া অ্যালুমিনিয়ামের থালা নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকা কষ্টের ব্যাপার। হতো। মাটি কাটার চেয়েও কষ্টের হতো।
আছরের নামাজের সময় জমির আলী তার কন্যাকে দেখতে গেল। দুটাকার একটা চকচকে নোট আলাদা করা। মুখ দেখে মেয়ের হাতের মুঠোয়। ধরিয়ে দেবে। সে রাজা-বাদশা হলে মোহর দিয়ে মেয়ের মুখ দেখত। মেয়ের। হাতে এক মোহর। মেয়ের মায়ের হাতে এক মোহর। আল্লাহ তাকে ফকির বানিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, কাজেই দুটা গিনি সোনার মোহরের বদলে দুটাকার চকচকে নোট।
মেয়ের মুখ দেখে জমির আলী আনন্দিত গলায় বলল, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, মেয়ে তোমার মতোই সুন্দরী হয়েছে। মাশাল্লাহ।
মেয়ের মা আছিয়া তীব্র গলায় বলল, ঢং কইরেন না কইলাম।
ঢং এর কী দেখলা? দেখি আবুরে কোলে দাও, তার জন্যে পুরস্কার আছে।
দূরে থাকেন। দূরে থাকেন কইলাম। আপনের পুরস্কারে আমি ঝাড়ু মারি।
জমির আলী আহত গলায় বলল, নিজের সন্তানরে কোলে নিব না? আমি জন্মদাতা পিতা।
আছিয়া তীব্র গলায় বলল, দূরে থাকেন কইলাম।
জমির আলী নিজেকে সংযত করে সহজ গলায় বলল, ঠিক আছে। মা বিনা অন্য কারোর কাঁচা আবু কোলে নেওন ঠিক না। গর্দানে ব্যথা পাইতে পারে। কাঁচা আবুর গর্দান পাটখড়ির মতো নরম।
খামাখা বকর বকর কইরেন না। নাই কাজের উজির। আসল পরিচয় পথের ফকির। ছিঃ ছিঃ।
জমির আলী অপমান গায়ে মাখল না। যারা ফকিরি ব্যবসায় নামে তাদের অপমান গায়ে মাখতে হয় না। তাদের হতে হয় হাঁসের মতো। পানির মধ্যে বাস কিন্তু শরীর শুকনা। জমির আলী কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে বলল–নয়া আবুরে মধু খাওয়াইছ? মধু না খাওয়াইলে জবান মিষ্ট হবে না। জবান হবে কাকপক্ষীর মতো কর্কশ।
আছিয়া বলল, আমারে কি আপনে মধুর চাকের উপরে বসাইয়া রাখছেন? চাক ভাইঙ্গা আবুর মুখে মধু দিব?
জমির আলী চিন্তিত মুখে বলল, মুখে মধু দেয়া প্রয়োজন ছিল। মেয়ে মানুষের আসল পরিচয় জবানে। যার যত মিষ্ট জবান সে তত পেয়ারা।
সামনে থাইক্যা যান কইলাম।
দুবলা শইল্যে চিল্লাফাল্লা করবা না। পেটের নাড়িতে টান পড়ব। পুয়াতি মেয়েছেলের নাড়িতে টান পড়লে বিরাট সমস্যা।
আরেব্বাসরে, আমরার কবিরাজ আইছে। সামনে থাইক্যা না গেলে আফনের খবর আছে।
জমির আলী ঘর থেকে বের হলো। সন্তানের মুখ দেখে সে খুবই আনন্দিত। গায়ের রঙ মাশাল্লা ভালো হয়েছে। চৈত্র মাসের সকালের রোদের মতো রঙ। আসমানী এবং জামদানী দুই জনের গায়ের রঙ একটু ময়লার দিকে। এই মেয়ে রঙের দিকে উড়াল দিয়েছে। জমির আলী পেছনের উঠানে গিয়ে মধুর গলায় ডাকল–আমার দুই মেয়ে কই? কই আমার আসি, কই আমার জামি?
দুই মেয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটে এলো। দুই মেয়েই বাবাঅন্তঃপ্রাণ। মার ধমক খেয়ে তারা বাড়ির উত্তরে বাঁশঝাড়ে চুপচাপ বসে ছিল। দুজনেরই খুব ইচ্ছা নয়া বোনকে কোলে নেয়। কোলে নেয়া দূরের কথা, ভালোমতো দেখতেই পারে নি। আছিয়া ধমকে তাদের বাড়িছাড়া করেছে।
জমির আলী মেয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরার সবচে ছোট ভইনটার নাম আমি দিলাম পয়সা। কী, নাম কেমুন হয়েছে?
আসমানী বলল, পয়সা আবার কেমুন নাম?
খুবই সৌন্দর্য নাম। ডাক নাম পয়সা, ভালো নাম মোসাম্মত পয়সা কুমারী। এখন বলো, নাম ভালো হইছে না?
হুঁ।
এখন যাও চুলা ধরাও। খিচুড়ি রান্ধা হইব। ইসপিসাল খিচুড়ি। ঘরে চাউল ডাউলের অবস্থা কী দেখ। না থাকলে দোকানে যাইবা।
দুই বোনের চোখ আনন্দে চকচক করতে লাগল। তারা তাদের বাবার হাতের খিচুড়ির ভক্ত। খিচুড়ি রান্নার প্রক্রিয়ারও ভক্ত। হাঁড়িতে জ্বাল উঠতে থাকে। হাঁড়ি ঘিরে সবাই বসে আছে। জমির আলী হাসিমুখে বলে–আরেকটা কিছু দিলে ভালো হইত। ঘরে আর কিছু আছে? না থাকলে দুই ভইন দুইটা যাও দৌড়াইতে থাকবা, চোখের সামনে সবজি বা সবজি কিসিমের যা পাইবা নিয়া আসবা। খালি কাঁঠাল পাতা আর ঘাস আনবা না। এই গুলান গরু-ছাগলের খাদ্য।
দুই মেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বের হয়ে যায়। তাদের বড়ই মজা লাগে।
জমির আলী খিচুড়ি রাঁধতে বসেছে। আজকের খিচুড়ি ইসপিসাল, খিচুড়িতে দুটা ডিম ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আসমানী এবং জামদানী চোখ বড় বড় করে বাবার দুপাশে বসেছে। মাঝে মাঝে হাঁড়ির ঢাকনা খোলা হয়। খিচুড়ির সুঘ্রাণ নাকে এসে লাগে–তাদের শরীর ঝিমঝিম করে। এরা দুজনই সকাল থেকে কিছু খায় নি। আছিয়া প্রসব-বেদনায় কাতর হয়ে ছটফট করছিল। দুটি ক্ষুধার্ত শিশুর কথা তার একবারও মনে হয় নি। মনে হলেও কিছু করা যেত না। ঘরে কোনো খাবার ছিল না।
জমির আলী বলল, বলো দেখি জগতের সবচে ভালো খাদ্যের নাম কী?
আসমানী এবং জামদানী এক সঙ্গে উত্তর দিল, খিচুড়ি।
জমির আলী আনন্দিত স্বরে বলল, হয়েছে। দুইজনেই পাস। ফাস ডিভিসনে পাস। এখন বলো দেখি খিচুড়ি কী জন্যে সবচে ভালো খাদ্য?
জানি না। চিন্তা-ভাবনা কইরা বলো।
তুমি বলো।
জমির আলী আগ্রহ নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে খিচুড়ি-মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে। তার দুই কন্যা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। তারা তাদের বাবার জ্ঞান ও প্রতিভায় বিস্মিত বোধ করে।
খিচুড়ি জগতের সবচে ভালো খাদ্য, কারণ আল্লাহপাক খিচুড়ি পছন্দ করেন। জগৎ-সংসারের দিকে চাইয়া দেখ–যে-দিকে চোখ যায় সেদিকে খিচুড়ি। কালা মানুষ, ধলা মানুষ, শ্যামলা মানুষ মানুষের খিচুড়ি। গাছপালার কথা বিবেচনা কর–আম গাছ, জাম গাছ, কাঁঠাল গাছ, তেঁতুল গাছ। গাছের খিচুড়ি। ঠিক কি-না?
হুঁ।
জগাই বিরাট এক খিচুড়ি। আল্লাহপাক কী করেছে শোন–বিরাট এক হাঁড়ি জ্বালে বসাইছে। সেই হাঁড়ির মধ্যে মানুষ, গরু, ছাগল, গাছপালা সব দিয়া খালি ঘুঁটতাছে।
জামদানী বলল, কী জন্যে?
উনার মনের কথা আমি কেমনে বলব? আমি ফকির মানুষ–আমার কি জ্ঞান বুদ্ধি আছে?
আসমানী বলল, বাপজান, তোমার বেজায় জ্ঞান বুদ্ধি।
জমির আলী মেয়ের কথায় আনন্দিত বোধ করে। সংসার তার কাছে মধুর বোধ হয়। নতুন শিশুর আগমনে অভাবের সংসার যে আরো জটিল হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। নয়া আবুর খানা খাদ্যের পিছনে বাড়তি খরচ নাই। নয়া আবুর খানা খাদ্যের ব্যবস্থা আল্লাহপাক নিজে করেন। মায়ের বুকে দুধ দিয়ে দেন। আল্লাহপাকের নাম রহমান রহিম তো খামাখা হয় নাই। আল্লাহপাক খামাখার মধ্যে নাই।
জমির আলীর ক্ষীণ সন্দেহ ছিল রাগ করে আছিয়া খিচুড়ি খাবে না। কিন্তু জমির আলীকে অবাক করে দিয়ে সে খিচুড়ি খুবই আগ্রহ করে খেল। জমির আলী বলল, টেস ভালো হইছে না?
আছিয়া জবাব দিল না।
জমির আলী বলল, চাউলের বদলে গম দিয়াও খিচুড়ি হয়। গমের খিচুড়ির টেস আরো বেশি, তয় গমের খিচুড়ির মধ্যে মাংস দেয়া লাগে। দেখি তোমরারে একদিন গমের খিচুড়ি খাওয়াব। ইনশাল্লাহ।
আছিয়া থালার খিচুড়ি শেষ করে ফেলেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার ক্ষুধা এখনো আছে। জমির আলী বলল, আরেক হাত খিচুড়ি দেই?
আছিয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, থাকলে দেন। আরেকটা কথা মন দিয়া শুনেন–আমি আপনের সংসারে থাকব না।
জমির আলী বলল, কই যাইবা?
যেখানে ইচ্ছা যাব। সেইটা দিয়া আপনের দরকার নাই। সেইটা আমার বিবেচনা।
নয়া আবুরে নিয়া ঘুরাঘুরি করা ঠিক না।
নয়া আবুরে সাথে নিব আপনেরে কে বলেছে?
জমির আলী অবাক হয়ে বলল, তারে কই থুইয়া যাইবা?
আছিয়া বলল, আফনেরে দিয়া যাব। তারে সাথে নিয়া ভিক্ষা করবেন।
যাইবা কবে?
শইল্যে যেদিন বল পাইব সেইদিন চইল্যা যাব। আপনের গুষ্ঠী আপনে সামলাইবেন। ভাত-কাপড় দিবেন। মেয়েরা বড় হইলে বিবাহ দিবেন। আমি ঝামেলার মধ্যে নাই।
জমির আলী চিন্তিত বোধ করছে। তার চিন্তার প্রধান কারণ হলো আছিয়া সহজ মেয়ে না। জটিল মেয়ে। মুখে যা বলে তাই করে। জমির আলী চিন্তিত মুখে বলল, সংসারে ঝামেলা আছে কথা সত্য, তবে বউ, সংসারে মজাও আছে।
আছিয়া বলল, মজা থাকলে তো ভালোই, আপনে চাইট্যা চাইট্যা মজা খনি। আমি মজা খাইতে পারব না। অনেক খাইছি। আমার পেট ভরা। ফকির সাব শুনেন চোখের সামনে দুই মাইয়া না খাইয়া ঘুরে। পেটের ক্ষিধায় বাঁশঝাড়ে বইস্যা কান্দে। অনেক কান্দন গুনছি, আর শুনব না।
তুমি যাইবা কই?
সেটা আমার বিবেচনা। পান খাওয়াইতে পারবেন। খিচুড়ি আরাম কইরা খাইছি–একটা পান খাইতে পারলে ভালো হইত।
পান নিয়া আসতেছি। এইটা কোনো বিষয়ই না। জর্দা খয়ের দিয়া বানানি পান। কাঁচা সুপারি দিয়া আনব?
যা ইচ্ছা দিয়া আনেন। কাঁচা সুপারি দিয়া আনেন, পাকনা সুপারি দিয়া আনেন। আমার পান খাওয়া দিয়া কথা।
ঘরে পান-সুপারি ছিল না। দোকান থেকে দুই খিলি পান কিনে এনে জমির আলী দেখল আছিয়া হাঁটা চলা করছে। সামান্য খিচুড়ি খেয়েই তার শরীরে মনে হয় বল ফিরে এসেছে। নয় আবু হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে, আছিয়া সে দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। আসমানী এবং জামদানী বোনের কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তারা ভীত চোখে একবার মাকে দেখছে, একবার কথায় মোড় নতুন শিশুটির দিকে তাকাচ্ছে।
জমির আলীর হাত থেকে পান নিতে নিতে আছিয়া বলল–আপনের পুটল কানতাছে। পুটলা সামলান। জমির আলী বলল, মনে হয় ক্ষিধা লাগছে। বুকের দুধের জন্যে কানতেছে। আছিয়া পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, বুকে দুধ
অখনো নামে নাই। আর নামলেও লাভ নাই। আমি আর এর মধ্যে নাই।
কীসের মধ্যে নাই?
সংসারের মধ্যে নাই। অনেক সংসার করলাম। অখন অসিসালামু আলায়কুম।
তোমার কথাবার্তা কিছুই বুঝতেছি না।
না বুঝলে নাই।
আছিয়া উঠানে চলে গেল। জলচৌকিতে বসে বাঁশঝাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। জমির আলী চিন্তিত মুখে শিশুর কান্না সামলানোর জন্যে এগিয়ে গেল। তার সঙ্গে যুক্ত হলো আসমানী ও জামদানী। বাচ্চাটাকে এখন আরো ফরসা লাগছে। হাত-পা ছুড়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে কাদছে। জমির আলী মেয়ের মুখের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, এই পয়সা–এই। পয়সা কান্না থামাচ্ছে না। আসমানি বলল, বাপজান, গীত গাও। জমির আলী গীত ধরল। বানিয়ে বানিয়ে সুর করে কথা বলা। ভিক্ষুকরা এটা খুব ভালো পারে–
এই পয়সা কান্দে রে
তার ভইন রে বান্দে রে
ভইনের নাম আসমানী
হে দেশের রাজরানী।
তার ছোটটা জামদানী
ঘরে টেকার আমদানি
টেকা বলে পয়সা কই
হে আমার প্রাণের সই।
জামদানী উৎফুল্ল গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কান্দন বন্ধ হইছে। কান্দন বন্ধ হইছে। জমির আলী অবাক–আরে তাই তো, পিচকা কান্না বন্ধ করে তাকাচ্ছে।
আসমানী বলল, বাপজান, তোমারে দেখে। তোমারে দেখে।
জমির আলী বলল, কী দেখসরে বেটি? আমি কে—ক দেহি। আমি তোর পিতা জমির আলী। তোর মাতার নাম আছিয়া। দুই ভইনের একজনের নাম আসমানী, আরেকজনের নাম জামদানী। আমাদের সবেরে যে সৃষ্টি করেছেন তার নাম আল্লাহ। সাত আসমানের উপরে তার সিংহাসন।
জামদানী বলল, তোমার সব কথা শুনতাছে। মনে হয় বুঝতাছে।
জমির আলী গম্ভীর গলায় বলল, বুঝনের কথা। শিশুরা ফিরিশতার সামিল। ফিরিশতা কথা বুঝব না এইটা কেমন কথা? আমার পয়সা আম্মা সব বুঝতাছে। বুঝতাম না মা?
কী আশ্চর্য কথা, পিচকি চোখ মিটমিট করছে! পাখির পালকের মতো একটা হাত এগিয়ে দিল বাবার মুখের দিকে। আসমানী উত্তেজিত গলায় বলল, বাপজান, তোমার নাক ধরতে চায়।
জমির আলী নাক বাড়িয়ে দিয়ে হৃষ্ট গলায় বলল, ধর বেটি নাক ধর। জন্মের পরেই নাক ধইরা টানাটানি এ কেমন মাইয়া! বয়সকালে এর খবর আছে।
কন্যা নিয়ে উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সন্ধ্যা নামার পর পর সে কাঁদতে শুরু করল। দিনও খারাপ করল। ঝুম বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে ঘরের চালা নড়বড় করছে। বাড়ি-ঘরের যে অবস্থা বাতাসের বেগ আরেকটু বাড়লে বাড়ি উড়ে যাবে। আছিয়া তার রোরুদ্যমান কন্যার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সে ভেতরের বারান্দায় মাদুর পেতে বসে আছে। মনে হচ্ছে গভীর আগ্রহে সে ঝড়-বৃষ্টি দেখছে। আসমানী মায়ের কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, পয়সা কানতেছে।
আছিয়া বলল, কান্দুক। কান্দনের কপাল নিয়া আসছে, কানব না তো কী করব!
মনে হয় ক্ষিধা লাগছে।
তোর বাপরে দুধ খাওয়াইতে ক। আমি আর ঝামেলার মইদ্যে নাই।
বাচ্চার কান্নার চেয়েও যে দুশ্চিন্তা জমির আলীকে কাতর করে ফেলল সেটা দিনের অবস্থা। ভাবভঙ্গি মোটেই সুবিধার না। অনেক দূর থেকে গুম গুম শব্দ আসছে। সবাইকে নিয়ে কেরামতের পাকা দালানে চলে যাওয়া দরকার।
জামদানী ভীত গলায় বলল, ঘর-বাড়ি কাঁপতাছে বাপজান।
জমির আলী বলল, কোনো চিন্তা করিস না। আমরার সাথে ছোট শিশু আছে। ছোট শিশু ফিরিশতার সামিল। ফিরিশতার বিপদ-আপদ নাই।
আসমানী বলল, কেরামত চাচার বাড়িত যাইবা?
জমির আলী বলল, মনে হয় যাইতে হবে। তোর মারে বল।… আচ্ছা আমিই বলব। ঝড়-তুফানরে সমীহ করা লাগে। ঝড়-তুফান কারোর খালাতো ভাই মামাতো ভাই না।
আছিয়া বলল, আপনের যেইখানে ইচ্ছা সেইখানে যান। গুষ্ঠী সাথে লইয়া যান। আমি যাব না।
জমির আলী চিন্তিত মুখে বলল, ঘর-বাড়ি তো পইড়া যাইতেছে। যাউক পইড়া।
সত্যি যাইবা না?
না।
বউ তোমারে আল্লাহর দোহাই লাগে।
আফনেরে আল্লাহর দোহাই লাগে কানের কাছে ভ্যানভ্যান কইরেন না।
ঝড় প্রবল হয়েছে। বাড়ির চালার একটা অংশ উড়ে চলে গেল। আসমানী এবং জামদানী দুদিক থেকে বাবাকে জাপ্টে ধরে আছে। জমির আলী শিশু সন্তানটিকে কথায় মুড়ে বুকের কাছে দুহাতে ধরে রেখেছে। ঝড়-ঝঞার জন্যই হোক বা পরিশ্রান্ত হবার কারণেই হোক সে কাঁদছে না। জমির আলী বলল, চল রওনা দেই। দুইজন আমারে শক্ত কইরা ধর। মনে মনে নুহ নবির নাম নে। ঝড়-তুফানের সময় নুহ নবির নাম খুব কামে দেয়।
আসমানী বলল, তুমি অত কিছু জান ক্যামনে?
আছিয়া তিক্ত গলায় বলল, তোর বাপ বিরাট তালেবর বিদ্যার মটকি। হে জানব না তো কে জানব? যা বাপের সাথে যা। পথে পিছলাইয়া পইড়া পাও ভাঙ। এক আধজন লুলা হইলে সুবিধা আছে। ভিক্ষা বেশি পাওন যাইব।
ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকের আলো দেখে দেখে এগুতে হচ্ছে। এমিতে চারদিক ঘন অন্ধকার। বৃষ্টির পানি বরফ শীতল। বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ। বৃষ্টির পানিতে পিছল হয়ে আছে। বুড়ো আঙুলটি টিপে টিপে খুব সাবধানে এগুতে হচ্ছে। ঝড় এমন ঝাপটা দিচ্ছে যে জমির আলীর মনে হচ্ছে, তার দুটি মেয়ের একটিকে বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জমির আলী বলল, শক্ত কইরা ধইরা থাক। প্রয়োজনে পাও ধইরা ঝুইলা পড়। মনে মনে বল–লাইলাহা ইল্লাল্লাহ।
পথের উপর বাঁশঝাড়ের বাঁশ ভেঙে পড়েছে। ডিঙিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। বাঁ দিকের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে কিছুদূর যাওয়া যাবে, সেটিও বিপদজনক। রুস্তমের ভিটার উপর দিয়ে যেতে হবে। রুস্তমের ভিটার উপর দিয়ে দিনমানেও কেউ যায় না। ঝড়-বৃষ্টির নিশুতি রাতে অভিশপ্ত ভিটার ধারেকাছে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। হয়তো দেখা যাবে উঁচু ভিটার উপর সাদা থান পরা রুস্তমের দাদি বসে আছে। বহুঁ বছর আগে মৃত এই খুনখুনি বুড়িকে দেখে নাই এমন লোকের সংখ্যা এই গ্রামে খুবই কম। বুড়ি ভিটার উপর বসে পান খায়। পানের পিক ফেলে। পিকের বর্ণ টকটকে লাল। মনে হয় যেন পিক না–তাজা রক্ত।
মনের ভুলে রাতে বিরাতে কেউ যদি রুস্তমের ভিটার পাশ দিয়ে যায় তাহলেই বুড়ি মধুর গলায় ডাকবে–যায় কেডা? বদরুলের বেটা ছদরুল? কেমন আছসরে ভাইটি? আয় কাছে আয়, পান খাইয়া যা। মনের ভুলে কেউ যদি বুড়ির সঙ্গে গল্পগুজব শুরু করে তাহলেই সর্বনাশ। সে বাড়ি ফিরে আসবে প্রবল জ্বর নিয়ে। খিচুনি শুরু হবে। মুখ দিয়ে গেজলা বেরুবে। ডাক্তার-কবিরাজ করার আগেই শেষ। এই গ্রামের দুইজন আর ভিনদেশী একজন এইভাবে শেষ হয়েছে।
জমির আলী ভীত গলায় বলল, আসমানী জামদানী, আমরা রুস্তম আলীর ভিটার উপর দিয়া যাব। বুড়িরে যদি দেখস ভয় খাইস না। আর বুড়ির কোনো কথার জবাব দিবি না। খবরদার কইলাম। আমি মনে মনে আয়াতুল কুরশি পড়তে থাকব। ভয়ের কিছু নাই। আয়াতুল কুরশির কাছে কেউ ভিড়তে পারে না। বড় শক্ত সূরা। জীন-ভূতের জন্যে কোরামিন ইনজেকশন।
আসমানী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আইচ্ছা।
আয়াতুল কুরশি পড়ার ব্যাপারটা জমির আলী মেয়েদের সাহস দেবার জন্যে বলেছে। আয়াতুল কুরশি সে জানে না। আল্লাহর পাক কালাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলা মহাঅপরাধ। মেয়ে দুটিকে সাহস দেবার জন্যে জমির আলী এত বড় অপরাধ করল। মেয়েরা সাহস পেল কি-না বুঝা গেল না, তবে ভয়ে জমির আলীর বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। সে নিশ্চিত রুস্তম আলীর দাদিকে দেখা যাবেই। বুড়ি পানের পিক ফেলতে ফেলতে মধুর গলায় বলবে–কে যায়? আমরার ফকির জমির আলী না? ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তিন কইন্যা লইয়া কই যাস? একটারে আমার কাছে থুইয়া যা। আদর কইরা পালব।
মেয়ে তিনটিকে কেরামতের পাকাবাড়ির বারান্দায় রেখে জমির আলী আবার বের হলো। আছিয়ার খোঁজ নেয়া দরকার। রাগ ভাঙায়ে তাকে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে কোলে করে আনতে হবে। স্ত্রী স্বামীকে কোলে নিতে পারে না, তবে স্বামী স্ত্রীকে কোলে নিতে পারে। তাতে দোষ হয় না।
আছিয়াকে পাওয়া গেল না। সে উঠানে বসে নেই। ঘরের ভেতরে নেই। আশেপাশে কোথাও নেই। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে অসুস্থ মানুষটা যাবে কোথায়? এমন কি হতে পারে মেয়ে তিনটার টানে সে ঘুরপথে কেরামতের পাকা দালানে উপস্থিত হয়েছে! সন্তানের টান বড় মারাত্মক টান। লোহার শিকলের টান। জমির আলী আবারো কেরামতের বাড়িতে উপস্থিত হলো।
দুই বোনই জড়সড় হয়ে উঠানে বসে আছে। আসমানীর কোলে পয়সা। সে কুঁকুঁ শব্দ করছে। দুটি মেয়েই শীতে কাঁপছে। কেরামত দরজা খুলে মেয়েগুলিকে ভিতরে ঢুকতে দেয় নি। আসমানী বলল, বাপজান, মা কই?
জমির তখন বলল, এখনো খুঁজতে যাই নাই, তরার কী অবস্থা দেখতে আসছি। অবস্থা কী?
আসমানী বলল, শীত লাগে।
ভিজা কাপড়ে শীত তো লাগবই। তোরা টাইট হইয়া বইয়া থাক। তোর মারে নিয়া আসতাছি। নয়া আবুর খবর কী?
একটু পরে পরে কান্দে।
কান্দুক, জন্মের সময় যে সব সন্তান বেশি কান্দে তারা বড় হইয়া এমন সুখে থাকে যে কান্দন কী জিনিস ভুইল্যা যায়। তোর ছোট ভইন বড়ই ভাগ্যবতী। তার ভাইগ্য দেইখা অবাক হইতেছি।
জমির আলী আবারো স্ত্রীর সন্ধানে বের হলো। তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
চুকচুক শব্দ হচ্ছে
চুকচুক শব্দ হচ্ছে।
পয়সা দুধ খাচ্ছে। দুধের বাটিতে কড়ে আঙুল ডুবিয়ে সেই আঙুল ঠোটের কাছে ধরতেই পয়সা আঙুল মুখে নিয়ে চুকচুক শব্দ করছে। বড়ই মজার দৃশ্য। জামাদানীর খুব ইচ্ছা সেও বড়বোনের মতো দুধ খাওয়ায়। কথাটা বলতে কেন জানি তার লজ্জা করছে। তার লজ্জা একটু বেশি; তবে সে মোটামুটি নিশ্চিত আসমানী দয়াপরবশ হয়ে এক সময় বলবে, নে তুই দুধ খাওয়া। জামদানী সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে।
দুধ খাওয়ানো উৎসব হচ্ছে বাড়ির উঠোনে। অনেক আয়োজন করা হয়েছে। পাটি বিছানো হয়েছে। কাঁথা বালিশ আনা হয়েছে। জলচৌকিতে রাখা হয়েছে দুধের বাটি এবং সরিষার তেলের বাটি। দুধ খাওয়ানো শেষ হলেই পয়সার গায়ে তেল মাখিয়ে রোদে শুইয়ে রাখা হবে। সমস্ত শরীরটা থাকবে। রোদে, শুধু মাথার উপর ছায়া ফেলে একজনকে ছাতা ধরে রাখতে হবে। জমির আলী সেই নির্দেশ দিয়ে গিয়েছে।
আঙুল চুবিয়ে দুধ খাওয়ানোর কৌশলটা আসমানী বের করেছে। আগে ন্যাকড়া দুধে ডুবিয়ে মুখে ধরা হতো। এতে সময় লাগত অনেক বেশি। আঙুল পদ্ধতিতে সময় কম লাগছে। পুরো ব্যাপারটায় আনন্দও আছে। এই আনন্দ স্থায়ী হবে না। জমির আলী বলেছে–এক মাস কষ্ট কর। এক মাস পরে আবু শিশি দিয়া দুধ খাইব। তখন নয়া আবুর মুখে শিশি ধরার কষ্ট ছাড়া আর কষ্ট নাই। তখন খালি আরাম। আসমানী এবং জামদানীর কাছে আঙুল দিয়ে দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটা কষ্টের না, বরং আনন্দের। এই আনন্দ এক মাসের মধ্যে
শেষ হয়ে যাবে ভাবতে ভালো লাগে না।
জামদানী অনেকক্ষণ হলো চুপচাপ বসে আছে। আসমানী তাকে কিছুই বলছে না। লজ্জা ভেঙে সে নিজেই মিনমিন করে বলল, বুবু, আমি দুধ খাওয়াই?
আসমানী গম্ভীর গলায় বলল, হাত ধুইয়া আয়। ভালোমতো ধুবি।
জামদানী প্রায় দৌড়ে গেল হাত ধুতে। এই ফাঁকে আসমানী তার বোনের সঙ্গে কিছু গল্পগুজব করল–এখন তোমারে কে দুধ খাওয়াইব জানো? তোমার ভইন। তার নাম জামদানী। হে তোমারে খুবই পেয়ার করে। ও আমার পয়সা ভইন, তোমার মনটা খারাপ কেন গো? মার জন্যে পেট পুড়ে? আহারে লক্ষ্মী। আহারে কুটুরা পক্ষী। মা চইল্যা আসব। কয়েকটা দিনের মামলা। মা আইস্যা তোরে কুলে নিয়া খালি হাঁটব, খালি হাঁটব। হাঁটতে হাঁটতে গীত গাইব। গীত শুইন্যা তুই ঘুমাইয়া পড়বি।
বোনের হাতে দায়িত্ব দিয়ে আসমানী উঠে পড়ল। তার অনেক কাজ। কলসিতে খাওয়ার পানি নাই। টিউব কল থেকে জগে করে পানি এনে এনে কলসি ভরতে হবে। তাকে আসা যাওয়া করতে হবে পনের বার। কলসি ভরতে পনের জগ পানি লাগে। সব তার হিসাব করা।
গাঙ্গের পাড়ে কচুগাছে প্রচুর লতি এসেছে। লতি তুলে আনতে হবে। রুস্তমের ভিটার সবরি গাছে সবরির বান ডাকছে। সেইখানে একলা যাওয়া যাবে না। ভয় লাগে। বাপজানকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। জঙ্গলার ভেতর লটকন গাছ ঝেপে লটকন এসেছে। এখনো পাকে নি, তবে পাকার সময় হয়ে এসেছে। রোজ একবার খবর না নিলে পাকা লটকন অন্য কেউ নিয়ে যাবে। জঙ্গলা থেকে খড়ির ব্যবস্থাও করতে হবে। রান্ধাবাড়ার ঝামেলা অবশ্যি নাই। জমির আলী সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে রাঁধতে বসবে। রান্না হয় একবেলা, তাতে কষ্ট হয় না। দুইবোন চিড়া খেয়ে থাকে। চিড়া খুবই গুণের খাদ্য। গুড় দিয়ে দুই মুঠ চিড়া খেয়ে ভরপেট পানি খেলে সারাদিন আর ক্ষিধে লাগে না। ক্ষিধা লাগতে থাকে আছরের পর থেকে। সন্ধ্যাবেলায় ক্ষিধায় চোখ অন্ধকার হয়ে আসে। তখন গরম গরম ভাত কী যে ভালো লাগে!
টিউব কলটা সরকার বাড়ির পিছনে। সরকার বাড়ির বড় বউ রমিলা টিউব কলে কাপড় ধুচ্ছিল। আসমানীকে দেখে বলল, আসমানী, তোর ভইন কেমন আছে?
আসমানী বলল, ভালো। তোর মার কোনো খোঁজ আছে?
না।
সংসার ফালাইয়া তোর মা গেল কই?
আসমানী জবাব দিল না। জবাব দেবার কিছু নেই। তার মা কোথায় গিয়েছে সে জানে না।
তোর বাপও তো বাদাইম্যা। শইল্যে শক্তি আছে, অসুখ নাই বিসুখ নাই–করে ভিক্ষা। এমন মানুষরে কানে ধইরা গেরামের বাইরে বাইর কইরা দেওন। দরকার। ছিঃ ছিঃ!
আসমানীর মনটা খারাপ হলো। তার বাপজানরে কেউ কিছু বললে মন খারাপ লাগে। রাগ হয়। সে রমিলা চাচির উপর রাগ করতে পারছে না। রমিলা চাচি অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। সব সময় তাদের খোঁজখবর করছে। এটা সেটা দিচ্ছে। সে এখন যে হলুদ জামাটা পরে আছে এটাও রমিলা চাচির দেওয়া।
রমিলা বলল, তুই কেমন মেয়েরে আসমানী, তোর বাপরে নিয়া দুইটা মন্দ কথা বললাম সাথে সাথে মুখ কালা। যে মন্দ তারে মন্দ বলব না?
আসমানী নিচু গলায় বলল, বাপজান মন্দ না।
রমিলা হাসি মুখে বলল, আচ্ছা যা তোর বাপজান মন্দ না। হে রসগোল্লা। রসের মইধ্যে ডুইব্যা আছে। কি খুশি হইছস?
আসমানী কিছু বলল না। রমিলা বলল, একটা মুরগি ছদগা দিছি। মনে কইরা নিয়া যাবি।
ছদগা কী জন্যে দিছেন? বিপদ আপদ হইছে?
রমিলা বিষণ্ণ গলায় বলল, তোর চাচা থাকে বৈদেশে। তার জন্যে মনটা সব সময় খারাপ থাকে। তার যেন বিপদ আপদ না হয় এই জন্যে ছদগা দিলাম। গত রাইত একটা খারাপ খোয়াবও দেখছি। মনটা পেরেশান। খোয়াবে দেখলাম তোর চাচা সাদা চাদ্দর গায়ে দিয়া বিছানায় শুইয়া আছে। একটু পরে পরে বলতেছে–বৌ, আমারে পানি দেও। বড় তিয়াস লাগছে। আমি পাগলের মতো পানি খুঁজতেছি। পানি পাইতেছি না। সবই আছে, পানি নাই। তখন ঘুম ভাঙ্গছে, সারা রাইত আর ঘুম হয় নাই।
আসমানী কলপাড়ে বসল। রমিলা চাচির সঙ্গে গল্প-গুজব করতে তার খুব ভালো লাগে।
রমিলা বলল, চুলে তেল দেস না? চুলে জট পইড়া গেছে। সাবান দিয়া ভালোমতো গোসল দিবি। চুলে তেল দিবি। রাজরানীর মতো চেহারা, ময়লা মাইখ্যা ঘুইরা বেড়াস। ঘরে সাবান আছে?
না।
সাবান নিয়া যাইস। বিকালে আইস্যা সাবান আর মুরগি নিয়া যাবি।
আইচ্ছা।
আসমানী বসে আছে। রমিলা কাপড় ধুচ্ছে। রমিলার চোখে পানি। স্বামীর প্রসঙ্গে কথা বললেই রমিলার চোখে পানি আসে।
রমিলা বলল, চুপচাপ বইস্যা থাকবি না। এখন সামনে থাইক্যা যা। নয়া আবুর কিছু লাগলে আমারে খবর দিস।
আসমানী চলে গেল না। বসে রইল। রমিলা চাচি কাঁদছে। তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে আসমানীর খুব মায়া লাগছে।
জামদানী হাঁটুগেড়ে পয়সার কাছে বসে আছে। তার দুধ খাওয়া শেষ হয়েছে। এখন সে হাত-পা ছুঁড়ছে। মাঝখানে সে একবার কান্না থামিয়েছে। জামদানী তার বাবার কাছ থেকে ভিক্ষার গান শিখেছে। টেনে টেনে সুর করে ভালোই গায়। এই ধরনের গানের বিষয়ে জমির আলীর বক্তব্য হলো–ফকিরি গানে এক সঙ্গে তিন কাম হয়–গান গাইয়া আনন্দ, যে শুনে তার আনন্দ, আর গানের মধ্যে আল্লাহ খোদা নবিজির নাম থাকে বিধায় সোয়াবও হয়।
জামদানী বোনকে ফকিরি গান শুনিয়ে কান্না একবার থামিয়েছে। সে মনে হয় আবার কান্না শুরু করবে। মুখ বাকাচ্ছে। জামদানী গান ধরল—
দিনের নবি মুস্তফায়
রাস্তা দিয়া হাইট্যা যায়
একটা পাখি বইস্যা ছিল গাছেরও ছেমায় গো
গাছেরও ছেমায়…
আষাঢ় মাসের কড়া রোদ উঠেছে। কোথাও ছায়া নেই। রোদে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। রোদ মাথায় নিয়ে জমির আলী খেয়াঘাটে বসে আছে। কাছেই বড় ছাতিম গাছ আছে। ছাতিম গাছের নিচে বসলে ছায়া পাওয়া যায়। সেটা করা যাচ্ছে না। যে ভিক্ষুক আরাম করে গাছের ছায়ায় বসে আছে তাকে কেউ ভিক্ষা দেবে না। যে ভিক্ষুক রোদে-পুড়ে কষ্ট করছে তার প্রতি মানুষের দয়া হবে।
রোদে ভাজা ভাজা হয়ে তেমন লাভ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত জমির আলী মানুষের দয়ার কোনো লক্ষণ দেখছে না। মাঝে মাঝে খারাপ দিন আসে–সারাদিন বসে থেকেও কিছু পাওয়া যায় না। আজ মনে হচ্ছে সে-রকম খারাপ একটা দিন। জমির আলী চিন্তিত বোধ করছে। আধা কেজি চালের পয়সাটা তো উঠা দরকার। বউ চলে যাওয়ায় একটা সুবিধা হয়েছে চালের খরচ কমেছে। এখন আধা কেজি চালে তিনজনের ভালোমতো হয়ে যায়। সব খারাপ জিনিসের মধ্যে আল্লাহপাক ভালো একটা জিনিস ঢুকিয়ে দেন, আবার ভালোর মধ্যে খারাপও ঢুকিয়ে দেন। শুধু মন্দ কিংবা ভালো বলে কিছু তার কাছে নেই।
রোদের কষ্ট ভোলার জন্যে জমির আলী চিন্তা-ভাবনার লাইনে যাবার চেষ্টা করল। কোনো চিন্তা-ভাবনাই পরিষ্কার আসছে না। গরমে সব আউলায়ে যাচ্ছে। জমির আলী আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ঝকঝকে নীল। মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। ছোটখাট একটা মেঘের টুকরা থাকলেও আশায় আশায় রোদে বসে থাকা যেত–এই মেঘের টুকরা এক সময় বড় হবে। রোদের পাছায় লাথি মেরে রোদ দূর করবে। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় নামবে ঝুম বৃষ্টি।
গরম কাটান দিতে গরম লাগে। আগুন গরম এক কাপ চা খেলে গরম কাটবে। জমির আলী মজিদের চায়ের স্টলের দিকে রওনা হলো। এক সময় মজিদ তার বন্ধু মানুষ ছিল। এক সঙ্গে মাটি কেটেছে। এখন চায়ের স্টল দিয়ে ভদ্রলোক হয়ে গেছে। কাপড়-চোপড় পরে ভদ্রলোকের মতো, কথাবার্তাও বলে ভদ্রলোকের মতো। দোকানে সে একটা সাইনবোর্ডও টানিয়েছে বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না। তারপরেও জমির আলী তার চায়ের স্টলে চা খেতে গেলে সে পয়সা নেয় না। তবে মুখটা গম্ভীর করে রাখে।
মজিদ চায়ের কাপ জমির আলীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, তোমার স্ত্রীর কোনো সন্ধান পেয়েছ? চেহারা ছবি ভালো মেয়ে হারায়ে গেলে খারাপ পাড়ায় দাখিল হয়। ঘণ্টায় দশ টেকা হিসাবে ভাড়া খাটে।
জমির আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মজিদ তার বন্ধু মানুষ। বন্ধু মানুষ হয়ে বন্ধুর স্ত্রীকে নিয়ে এ ধরনের কথা কী করে বলে? তার কাছে চা খেতে আসাই উচিত না। হাতের চায়ের কাপের গরম চা মজিদের উপর ঢেলে। দিলে ভালো হতো। সেটা উচিত হবে না। একজন মন্দ হলেই যে আরেকজনের মন্দ হতে হবে তা না। জমির আলী চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, তোমার ভাবির খবর পেয়েছি। (সবই মিথ্যা কথা। মান রাখার জন্যে মিথ্যা বলা।) সে সুসং দুর্গাপুরে তার বোনের বাড়িতে আছে। তারা বিরাট বড়লোক। বাজারে টিনের ঘর আছে তিনটা। তারা তোমার ভাবিকে খুবই পেয়ার করে বলে আসতে দেয় না।
মজিদ বিরস গলায় বলল, আসতে না দিলে তোমারই গিয়া নিয়া আসা উচিত। বড়লোকের কায়-কারবার ভিন্ন। দেখা গেল তোমার স্ত্রীর সাথে লটরপটর শুরু কইরা দিছে। কিছুই বলা যায় না, তারে বিবাহও কইরা ফেলতে পারে।
জমির আলী চা শেষ না করেই উঠে পড়ল। বসল আগের জায়গায়। সকালের দিকে কিছু পাওয়া যায় নি। এখন যদি পাওয়া যায়! জমির আলী ঠিক করেছে একটা টাকাও যদি পাওয়া যায় সে টাকাটা দিয়ে আসবে মজিদকে। চায়ের দাম। মজিদকে বলবে–ফকির জমির আলী দয়ার চা খায় না।
সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে। দুপুরের গাড়ি চলে আসার সময় হয়ে এসেছে। এখন জমির আলী যাবে রেলস্টেশনে। যদি পাওয়া যায় তাহলে কুলির কাজ করবে। যাত্রীদের ব্যাগ-সুটকেস নামাবে। আজকাল যাত্রীরাও চালাক হয়ে গেছে। খালি হাতে ঘুরাফিরা করে। ব্রিফকেস হাতে নিয়ে নেমে যায়। দুনিয়াটা চলে যাচ্ছে চালাকের হাতে। বিরাট আফসোস!
শুধু যে কুলির কাজের জন্যে জমির আলী স্টেশনে যায় তাও না। তার মনে। আশা কোনো একদিন সে দেখবে আসমানীর মা ট্রেন থেকে নামছে। তখন জমির আলী কাছে এগিয়ে যাবে, কিছুই হয় নি এমন ভাব ধরে বলবে–কেমন আছ বউ? এদিকে খবর সবই মঙ্গল। কোনো চিন্তা করবা না। বউকে নিয়ে বাড়িতে রওনা হবার আগে আগে রেলস্টেশনের টি-স্টলে টোস্ট বিস্কিট দিয়ে এক কাপ চা খাওয়াবে। এরা চা-টা ভালো বানায়। আসমানীর মার সঙ্গে সে অতি ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করবে। কেন সে কাউকে না বলে বাড়ি থেকে চলে গেল, কোথায় গিয়েছিল–এইসব কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। কী দরকার? ফিরে এসেছে এই যথেষ্ট। আল্লাহপাকের দরবারে হাজার শুকুর।
দুপুরের ট্রেনে কোনো যাত্রী নামল না। এটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। একটা এত বড় ট্রেন–এলো, চলে গেল–একজন যাত্রীও নামল না। এরকম ঘটনা কি আগে কখনো ঘটেছে? মনে হয় ঘটে নাই। স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে। স্টেশনমাস্টারের এইসব হিসাব থাকে। জমির আলী এগিয়ে গেল। কোনো যাত্রী ট্রেন থেকে নামে নি এমন ঘটনা আগে ঘটেছে কি-না তা না জেনে গেলে মনে একটা খুঁতখুঁত থাকবে। জেনে যাওয়াই ভালো।
স্টেশনমাস্টার ধমক দিয়ে জমির আলীকে বিদায় করলেন। গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে বললেন–যা ভাগ, এক থাপ্পর খাবি।
জমির আলী বিস্মিত হয়ে বলল, থাপ্পর খাওনের মতো অপরাধ কী করলাম? মনের মধ্যে একটা জিজ্ঞাসা ছিল…
আবার কথা বলে! ভাগ!
জমির আলীর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কোনো কারণ ছাড়াই মানুষ এত খারাপ ব্যবহার কী জন্যে করে? ভালো ব্যাবহার করার জন্যে তো টাকা খরচ করা লাগে না। মুখের মিষ্ট কথা নিঃখরচা জিনিস। এক লাখ মিষ্ট কথার দাম শূন্য। জমির আলীর মন এতই খারাপ হলো যে মন খারাপ ভাব কাটাবার জন্যে মিষ্ট কথার সন্ধানে বের হলো। একটা তিক্ত কথা কাটান দিতে একটা মিষ্ট কথা লাগে। তিক্ত কথা কাটান না দেয়া পর্যন্ত মনে অশান্তি থাকবে। কী দরকার মন অশান্ত রেখে! জমির আলী ইয়াকুব সাহেবের সন্ধানে বের হলো।
ইয়াকুব সাহেব কী একটা এনজিওর কাজ নিয়ে এসেছেন। থানা কমপ্লেক্সের পাশে টিনের একচালা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকেন। অতি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। মধুর ব্যবহার। রমিজ আলীর ধারণা এই মানুষটা শুধু মধুর ব্যবহারের কারণে বেহেশতে যাবে।
খাওয়া-দাওয়ার পর ইয়াকুব সাহেব কিছুক্ষণ ঘুমান। জমির আলী ঠিক করে ফেলল সে যদি গিয়ে দেখে ইয়াকুব সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন তাহলেও চলে আসবে না। ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করবে। দুটা মিষ্ট কথা শুনে মনটা ঠিক করবে।
ইয়াকুব সাহেব জেগেই ছিলেন। বারান্দায় রাখা টানা বেঞ্চের এক মাথায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। জমির আলীকে দেখে তিনি হাসিমুখে বললেন, ভিক্ষুক সাহেবের খবর কী? রোজগারপাতি কিছু হয়েছে?
জমির আলীর মন ভালো হয়ে গেল। একে বলে ভদ্রলোক। শরিফ খানদান। জমির আলী বলল, স্যারের শরীরের অবস্থা কী?
অবস্থা ভালোই, তোমার খবর কী? বউ ফিরেছে?
জে-না।
কোথায় আছে খোঁজ-খবর কিছু করেছ?
বাপের বাড়িতে যায় নাই, সে খবর পেয়েছি। মনে হয় সুসং দুর্গাপুরে আছে। তার এক বোনের বিবাহ হয়েছিল সুসং দুর্গাপুরে। আমার বিশ্বাস সেইখানেই আছে।
চলে যাও। বউ নিয়ে আস।
বেকায়দায় পড়ে গেছি স্যার। ঘরে ছোট আবু। কার কাছে রাখি!
তোমার বাচ্চাটা আছে কেমন? কী যেন তার নাম–পয়সা না?
জে স্যার, আপনার দেখি সবই ইয়াদ থাকে।
জমির আলী, দুপুরের খাওয়া হয়েছে? না হয়ে থাকলে অল্প কিছু ভাততরকারি আছে। খেয়ে নাও। খাবে?
জে স্যার।
যাওয়ার সময় থালাবাসন ধুয়ে যেও।
জে আচ্ছা।
জমির আলী মনে মনে বলল, হে আল্লাহপাক! তোমার দরবারে দরখাস্ত করলাম–ইয়াকুব সাহেবরে তুমি বেহেশত নসিব করবে। তাকে বেহশত নসিব না করলে আমি তোমার বেহেশতে ঢুকব না। এইটা আমার ওয়াদা।
জমির আলী যে বেহেশতে যাবে এ বিষয়ে সে নিশ্চিন্ত। কারণ সে স্বপ্নে একবার নবিজিকে দেখেছে। যারা নবিজিকে স্বপ্নে দেখে তাদের বেহেশত নসিব হয়। মুনশি মোল্লার কথা।
খাওয়া-দাওয়ার পর রান্নাঘরেই জমির আলী কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। ভাত ঘুমের মতো আরামের ঘুম আল্লাহপাক তৈরি করেন নাই। ভরপেট খাওয়ার পর বিসমিল্লাহ বলে শুয়ে পড়া। পেট যত ভরা থাকবে ঘুম হবে তত আরামের। ইয়াকুব আলী যদিও বলেছেন–অল্প ভাত তরকারি আছে। ঘটনা ভিন্ন। সব কিছুই পরিমাণ মতো ছিল। ডাল টকে গিয়েছিল, এতে স্বাদ বরং বেড়েছে।
ঘুমের মধ্যে জমির আলী ভালো একটা স্বপ্ন দেখল। আসমানীর মা ফিরে এসেছে। ট্রেন থেকে নামার সময় সে গলা বাড়িয়ে চিৎকার করছে–কুলি! কুলি! এইখানে কুলি আছে? আমার অনেক মাল-সামান। জমির আলী এগিয়ে গেল। আছিয়া তাকে চিনতে পারল না। আলীশান এক ট্রাঙ্ক তার মাথায় তুলে দিল। মাথায় ট্রাঙ্ক, এক হাতে স্যুটকেস, এক হাতে বিরাট এক পুটলি নিয়ে জমির আলী যাচ্ছে। পেছনে পেছনে আছিয়া আসছে। স্বপ্ন বলেই এতগুলি মালসামান নিয়ে এত সহজে হাঁটা যাচ্ছে। জমির আলী বলল, বউ তোমার খবর কী? অমনি আছিয়া রেগে গিয়ে বলল, ঐ ব্যাটা মাডি লাউগরা, তুই আমারে বউ ডাকস কোন সাহসে? লাথ মাইরা তোর কোমর ভাঙব। জমির আলী হাসতে হাসতে বলল, লাথ মার তো! দেখি তোমার ঠ্যাঙে কত জোর! আছিয়া সত্যি সত্যি লাথ মারার জন্যে এগিয়ে এসে জিভে কামড় দিয়ে বলল, ও আল্লা! আপনে? বিরাট অন্যায় করেছি, মাপ দেন। জমির আলী দরাজ গলায় বলল, স্বামী যেমন স্ত্রীর উপর অন্যায় করতে পারে, স্ত্রীও পারে। এতে দোষ হয় না। তারপর বউ বলো—ট্রাঙ্কে কইরা কী আনছ? আছিয়া বলল, টেকা আনছি। ট্রাঙ্ক ভরতি টেকা। আইজ থাইক্যা আপনের ভিক্ষা বন্ধ। ট্রাঙ্ক খুইল্যা টেকা বাইর করবেন আর খরচ করবেন।
স্বপ্নের এই পর্যায়ে জমির আলীর ঘুম ভেঙে যায়। তার মনটা হয় উদাস। স্বপ্নে আছিয়াকে খুবই সুন্দর লাগছিল। কানে ছিল স্বর্ণের দুল। এই দুল জোড়া আসমানীর অসুখের সময় বিক্রি করতে হয়েছে। দুল আর কিনে দেয়া হয় নি। বিবাহিত মেয়েদের গায়ে স্বর্ণের ছোঁয়া না থাকলে দোষ লাগে। এক আনা সোনা হলেও গায়ে রাখতে হয়। সেটা করা সম্ভব হয় নি বলেই আছিয়ার গায়ে দোষ লেগে গেছে। সে সংসার ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েদের যেমন স্বর্ণ পুরুষদের তেমন আকিক পাথর। নবিজি নিজে আকিক পাথর পরতেন।
জমির আলী বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার মুখে মুখে। বাড়িতে পা দিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। সব ঠিক-ঠাক আছে। কলসি ভর্তি পানি আছে। উঠান পরিষ্কার। চুলার কাছে শুকনা খড়ি সাজানো। অজু করার জন্যে জলচৌকির কাছে বদনা ভর্তি পানি। উঠানের খুঁটির সঙ্গে সাদা রঙের একটা মুরগি বাঁধা।
জমির আলী বিস্মিত গলায় বলল, এই মুরগি কার?
আসমানী বলল, আমরার মুরগি। ছদগা পাইছি। বাপজান, তুমি আস্তে কথা বলো, পয়সা হবে ঘুমাইছে।
বাবার সাড়া পেয়ে জামদানী গামছা হাতে বের হয়ে এসেছে। সে বাবার হাতে গামছা দিতে দিতে লজ্জিত গলায় বলল, পোলাও দিয়া মুরগির সালুন। খাইতে মনে চায় বাপজান।
জমির আলী দরাজ গলায় বলল, মনে চাইলে খাবি। আইজ রাইতেই খাবি। এইটা কোনো বিষয় না।
সত্যই?
অবশ্যই সত্য। জমির আলী ফকির হইলেও তার কথার দাম রাজা-বাদশার কথার দামের সমান। পোলাও কোর্মা আইজ রাইতেই হবে।
পোলাও-এর চাউল, ঘি গরম মশল্লা কই পাইবা?
এইগুলা নিয়া তোর চিন্তা করনের প্রয়োজন নাই। এইগুলা আমার বিষয়। মেয়েছেলে করব সংসার, পুরুষ করব চিন্তা–এইটা জগতের নিয়ম। এখন কথা বাড়াইস না। মাগরেবের ওয়াক্ত চইল্যা যাইতেছে। মাগরেবের ওয়াক্ত অতি অল্প সময়ের জন্যে থাকে। যদি দেখস গায়ের পশম দেখা যাইতেছে না তাহলে বুঝবি ওয়াক্ত শেষ হয়েছে।
সত্যি সত্যি পোলাও-কোরমা রান্না হয়েছে। দুই বোন নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। জমির আলী পয়সাকে কোলে নিয়ে পাশেই বসে আছে। আনন্দিত চোখে মেয়ে দুটির খাওয়া দেখছে। সে নিজে খেতে বসে নি। পোলাও-এর পরিমাণ কম। তিনজন খেলে কম পড়বে। শুধু দুই বোন যদি খায় আরাম করে খেতে পারবে। আসমানী বলল, বাপজান, তুমি খাইবা না?
জমির আলী বলল, না। আমার শইল জুইত নাই। শইল ঠিক করনের জন্যে উপাস দিব। শইল ঠিক করনের জন্যে উপাসের উপরে কোনো ওষুধ নাই। পোলাও-কোরমা খাইতে কেমন হইছে?
আসমানী বলল, অইত্যাধিক ভালো হইছে।
কই আমার মা জামদানী তো কিছু বলে না। ও জামি, খাদ্য কেমন হইছে?
জামদানীর মুখ ভর্তি খাবার। তার কথা বলার উপায় নেই। মুখে খাবার না থাকলেও সে কথা বলতে পারত না। খুব আনন্দের সময় সে কথা বলতে পারে না, তার চোখ দিয়ে শুধু পানি পড়ে। জমির বলল, আরাম কইরা খাও গো কইন্যারা। খাওয়া একটা ইবাদত। যত আরাম কইরা খাইবা ইবাদত তত শক্ত হইব। আল্লাহ সোয়াব দিয়া ভাসাইয়া দিব।
আসমানী বলল, তুমি কিছু খাইবা না এইটা কেমন কথা? এক মুঠ হইলেও খাও। দেই মুখে তুইল্যা?
জমির আলী উদাস গলায় বলল, দে।
আসমানী বাবার মুখে এক মুঠ খাবার তুলে দিল।
কন্যাদের সঙ্গে নিয়ে এটাই ছিল জমির আলীর শেষ খাওয়া। পরদিনই সে স্ত্রীর সন্ধানে দুর্গাপুর চলে যায়। সেখানে খবর পায় আছিয়া, আরো দুটা মেয়ের সঙ্গে বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। জমির আলীও রাতের অন্ধকারে বর্ডার পার হয়। সেও নিখোঁজ হয়ে যায়।
জমির আলীর চেহারায় সুফি সুফি ভাব
জমির আলীর চেহারায় সুফি সুফি ভাব চলে এসেছে। দাড়ি অনেক লম্বা হয়েছে। দাড়ির সঙ্গে চুলও লম্বা হয়েছে। মুখ ভর্তি দাড়ি, ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুল। দেখেই মনে হয় সাধক মানুষ। তাকে সবাই ডাকছে সাধুজী।
জমির আলী আছে জেলে। প্রথম ছিল বারাসতের জেলে, সেখান থেকে এসেছে আলীপুরে। তার দুই বছরের কয়েদ হয়েছে। জেলখানায় লম্বা চুল দাড়ি রাখা নিষেধ। সে বিশেষ বিবেচনায় মাফ পেয়েছে। সাধু সন্ত মানুষ হিসেবে সবাই তাকে বিশেষ খাতির করে। তার ডিউটি রসুই খানায়। প্রথম কিছুদিন সে হেড বাবুর্চির অ্যাসিসটেন্ট ছিল। এখন সে-ই মূল বাবুর্চি। তার কাজে সবাই সন্তুষ্ট। সন্ধ্যাবেলায় শেষ গুণতির পর কয়েদিদের ভেতর যে আসর বসে সেই আসরে তাকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। সে গাঁজা সিগারেট কিছুই খায় না। অতি উচ্চশ্রেণীর ভাবের কথা বলে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ভাবের কথা শুনতে অন্যদের ভালোই লাগে।
জেলখানায় জমির আলীর কয়েকজন অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুও তৈরি হয়েছে। এদের একজনের নাম বলরাম। খুনের মামলায় যাবজ্জীবন হয়েছে। তের বছর পার হয়েছে। আর মাত্র দুই আড়াই বছর কাটিয়ে দিতে পারলে জেলখাটা শেষ হবে। জেলের যাবজ্জীবন মানে আঠারো বছর। ভালো আচার-ব্যবহারের জন্যে কিছু মাফ পাওয়া যায়। বলরাম তাকে গোপনে বলেছে জেল থেকে বের হয়ে সে তার স্ত্রীকে খুন করবে। সব কাজই তিনবার করতে হয়। দানে দানে তিনদান। জগতের এই নিয়ম। আগে খুন করেছে দুটা। প্রথমটায় কেউ কিছু ধরতে পারে নি। সাজা হয়েছে দ্বিতীয়টার জন্যে। সে আশা করছে তৃতীয়টাও কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। তৃতীয় কর্মটি সমাধা করতে পারলে দানে দানে তিনদানের ঝামেলা মিটবে।
বলরাম জমির আলীর অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বলরাম বলেছে জমির আলীর স্ত্রীকে খুঁজে বের করা মাত্র দশ দিনের মামলা। কোনো একটা খারাপ পাড়ায় সে আছে। কোথায় আছে পাত্তা লাগানো কোনো ব্যাপারই না। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে দুজন এক সঙ্গেই ছাড়া পাবে। জেল থেকে বের হয়েই বলরামের প্রথম কাজ হবে বন্ধু পত্নীকে খুঁজে বের করা। দ্বিতীয় কাজ নিজের স্ত্রীকে খুন করা। বলরাম এই বিষয়ে ওয়াদাবদ্ধ। সে পরিষ্কার বলেছে, সাধুজী এটা তুমি আমার উপরে ছেড়ে দাও। দশ দিনে যদি পাত্তা বের করতে না পারি বাটখারা দিয়ে মেপে আড়াইশ গ্রাম কাচা গু খাব।
যে লোক এমন কঠিন প্রতিজ্ঞা করতে পারে তার উপর ভরসা করা যায়। জমির আলী ভরসা করে আছে এবং মোটামুটি নিশ্চিন্ত আছে। তার তিনকন্যাকে নিয়ে যে দুঃশ্চিন্তা তাও বলরাম বহুলাংশে দূর করেছে। বলরামের বিশেষ ক্ষমতা আছে তার নাম নখ-দর্পণ। বুড়ো আঙুলের নখে তিমির তেল মাখিয়ে সে যদি এক ধ্যানে সে-দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে নখ আয়নার মতো হয়ে যায়। যাকে দেখতে ইচ্ছা করে তাকেই আয়নায় দেখা যায়। জেলের সবাই যদিও বলে এটা বলরামের ভাওতাবাজি। টাকা কামাবার ফন্দি। (এক একবার নখদর্পণে বলরামকে এক প্যাকেট সিগারেট কিংবা দুই পুরিয়া গাজা দিতে হয়। তারপরেও প্রায়ই কয়েদিরা তার কাছে আসে নখদর্পণে তাদের পরিবার পরিজনদের খবর নেয়। জমির আলীর কাছ থেকে বলরাম কিছুই নেয় না। জমির আলী অন্যদের মতো বলরামকে অবিশ্বাসও করে না। বানিয়ে বানিয়ে একটা লোক তার কাছে শুধু শুধু মিথ্যা বলবে কেন?
জমির আলী যখনই তিন কন্যার বিষয়ে জানতে চায় তখনি বলরাম ধ্যানে বসে এবং অতি অল্পসময়ে ফল পাওয়া যায়।
দুইজনরে দেখতেছি। আরেকজন গেল কই?
দাদা, কোন দুইজন?
বড় দুইজন।
বুঝেছি আসমানী আর জামদানী। সর্বনাশ হয়েছে, ছোটটাকে কই রেখেছে? বড় দুই বোন করতেছে কী?
বুঝতেছি না–ছবি স্পষ্ট না।
দাদা, আরেকটু নজর করে দেখেন।
এখন দেখা যাইতেছে।
পরিষ্কার?
আয়নার মতো পরিষ্কার।
দুই বোন করতেছে কী?
একজনের হাতে একটা নারিকেল।
বুঝেছি–সরকারবাড়ির ছেলের বউ দিয়েছে। অতি ভালো মহিলা। প্রায়ই। এটা সেটা দেয়। আল্লাহ এই মহিলাকে বেহেশত নসিব করুক। দাদা, ছোটটারে দেখতেছেন?
না।
ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম। পয়সারে তারা কার কাছে দিল?
পেয়েছি। ছোটটাকে পেয়েছি।
কোথায় আছে?
শুয়ে আছে। হাত-পা নাড়তেছে।
দুইবোন কি আশেপাশে নাই?
থাকলেও ধরা পড়তেছে না।
ছোটজন কোথায় শুয়ে আছে? খাটে না উঠানে?
ধরতে পারতেছি না।
শরীর স্বাস্থ্য কি ঠিক আছে?
ঠিক আছে। হাসিখুশি। হাত-পা নাড়তেছে। অতিরিক্ত নাড়তেছে।
কারেক্ট ধরেছেন দাদা। জন্মের পর থেকে ছোটটার হাত-পা নাড়ার অভ্যাস। অতিরিক্ত চঞ্চল হয়েছে। দুঃশ্চিন্তা এই জন্যেই বেশি।
দেখা বন্ধ করে দেই, মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।
আচ্ছা বন্ধ করেন। আপনার অশেষ মেহেরবানী। বড় দুইজনের শরীর স্বাস্থ্য কেমন দেখেছেন?
ভালো। তবে একজনের মনটা মনে হলো সামান্য খারাপ।
বুঝেছি আর বলতে হবে না। মেজো জন। এ অল্পতেই মন খারাপ করে। সে আবার পোলাও খাওয়ার যম। দিন রাত পোলাও পোলাও করে। তিন মেয়ে আর তার মাকে নিয়ে আপনার বাড়ি থেকে বেড়ায়ে যাব ঠিক করেছি। বাকি আল্লাপাকের ইচ্ছা।
বলরাম যে শুধু নখদর্পণের মাধ্যমেই তাকে সাহায্য করছে তা-না। দেশে চিঠি পাঠাবার ব্যাপারেও সাহায্য করে। মাসে দুটা চিঠি জেল থেকে পাঠাবার নিয়ম আছে। চিঠি লিখে ঠিকানাসহ জেল অফিসে জমা দিতে হয়। জেলের রাইটার চিঠি পড়ে পাঠাবার যোগ্য বিবেচনা করলে চিঠি পাঠায়। সেইসব চিঠি–কি কখনো প্রাপকের কাছে পৌঁছে না। বলরামের ব্যবস্থা ভিন্ন, সে চিঠি পাচার করে দেয়। তার মাধ্যমে প্রতি মাসে দুটা করে চিঠি জমির আলী দেশে পাঠাচ্ছে। একটা চিঠি যাচ্ছে তিন মেয়ের কাছে। আরেকটা যাচ্ছে ইয়াকুব সাহেবের কাছে। ইয়াকুব সাহেবের কাছে সে খোলাখুলি সব বৃত্তান্ত লিখছে। উনি ভদ্রলোক এবং জ্ঞানী মানুষ। উনার কাছে কিছু লিখলে তিনি ঢোল পিটিয়ে প্রচার করবেন না। মেয়েদের কাছে মিথ্যা করে লিখতে হচ্ছে। বাবা জেলে আছে–এই ব্যাপারটা তারা নিতে পারবে না। ভাববে চুরি-ডাকাতি করে জেলে গেছে। তাদের কাছে মিথ্যা বলাই ভালো। নিজের মেয়েদের কাছে মিথ্যা বলার। কারণে বিরাট পাপ হচ্ছে। রোজহাশরে বিরাট বিপদে পড়বে। ভরসা একটাই নবিজিকে স্বপ্নে দেখেছে। নবিজি নিশ্চয়ই সাফায়াত করে কোনোরকমে তাকে পার করে নিয়ে যাবেন। প্রতি চিঠিতেই সে মেয়েদেরকে লিখছে—
ও আমার আদরের তিন মা ময়না সোনা, হলদী পক্ষী। পর সমাচার আমি ভালো আছি। তোমার মায়ের সন্ধান উড়া উড়া পাইয়াছি। নিশ্চিত পাই নাই। যেহেতু নবি করিমের নামে ওয়াদা করিয়াছি তোমার মাকে না নিয়া ফিরিব না সেহেতু কিঞ্চিত বিলম্ব হইতেছে। তবে দুঃশ্চিন্তা করিও না, অবশ্যই তোমার মাতাকে সঙ্গে নিয়া ফিরিব। তোমাদের কাছে এই আমার ওয়াদা। তোমাদের আল্লাহপাকের কাছে সোপর্দ করিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত আছি। অবশ্যই আল্লাহপাক তোমাদের দেখভালের ব্যবস্থা নিবেন। তিনি বড়ই দয়াময় বলিয়াই তাহার নাম রহমান রহিম। সর্বঅবস্থায় সর্ববিষয়ে আল্লাহপাকের উপর ভরসা রাখিবে। মাঝে মাঝে আমাকে পত্র দিবে। কীভাবে পত্র দিবে তাহা বলিয়া দিতেছি। এনজিও ইয়াকুব সাহেবকে গিয়া বলিবে–পিতার নিকট পত্র দিতে চাই। এই বার্তা বলিতে চাই। তখন তিনি বাকি ব্যবস্থা করিবেন। আমার ঠিকানা উনার নিকট আছে।
দোয়াগো
তোমাদের পিতা জমির আলী
ইয়াকুব সাহেবের কাছে সে বিস্তারিত লিখছে। কীভাবে জেলে ঢুকে গেল সেই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। কোনো কিছুই বাদ দেয় নাই। সম্পূর্ণ বিনা কারণে তার যে দীর্ঘদিনের জেল হয়েছে এই নিয়ে সে কোনো দুঃখ বা ক্ষোভ প্রকাশ করে নাই। কারণ সে জানে সবই আল্লাহপাকের খেলা। তার হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না। এর পেছনেও তাঁর হুকুম আছে। এবং সে নিশ্চিত যে জেলবাসের পিছনে কোনো মঙ্গলও আছে। আল্লাহপাকের প্রতিটি কাজের পিছনে মঙ্গল থাকে। বোকা মানুষ তা বুঝতে পারে না। জমির আলী মঙ্গলের ব্যাপারটা এখনই বুঝতে পারছে না, তবে কিছুদিনের মধ্যে সে অবশ্যই বুঝতে পারবে। সর্বশেষ চিঠিতে সে ইয়াকুব সাহেবকে লিখল—
জনাব ইয়াকুব সাহেব,
পর সমাচার এই যে আমি আমার তিন কন্যার দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আপনার হাতে দিয়া দিলাম। উপরে আল্লাহপাক, নিচে আপনি। আল্লাহপাক উসিলা বিনা কাজ করেন না। আপনি উসিলা। জনাব, মেয়ে তিনটির জন্যে বড় মনকষ্টে আছি। সর্বক্ষণ তাহাদের কথা মনে হয় এবং কলিজায় ব্যথা পাই। এখন আপনি নাদানের ভরসা। আমি আপনার পাক কদম চুম্বন করি। আপনি দয়া না করিলে আমার তিন আদরিণীর বড়ই বিপদ।
আমি যে জেলে আছি, কয়েদ খাটিতেছি–এই সংবাদ আমার কন্যাদের দয়া করিয়া দিবেন না। তাহারা মনে কষ্ট পাইবে। এম্নিতেই তাহারা কষ্টের মধ্যে আছে। তাহাদের কষ্ট আর বৃদ্ধি করতে চাই না। সুখে দুঃখে আমার দিন গুজরান হইতেছে। আমি আল্লাহপাকের খেলার মধ্যে পড়িয়াছি। তাহার খেলা বুঝিবার সাধ্য আমার নাই। রাত্রি নিশাকালে যখন নয়নে নিদ্রা আসে না তখন আল্লাহকে ডাকিয়া বলি, মাবুদে এলাহি, তুমি বান্দাকে নিয়া আর কী খেলা খেলিবে?
ইতি
আপনার গোলাম
জমির আলী
আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়ে আল্লাহ জমির আলীকে নিয়ে আরেকটি খেলা খেললেন। তখন রসুই খানায় রান্না হচ্ছে। বিশাল দুটা পিতলের ডেকচিতে লপসি রান্না হচ্ছে। জমির আলী প্রবল বেগে হাতা ঘুরাচ্ছে। চুলায় গানে আগুন। হাতা ঘুরানো বন্ধ হলে লপসি ধরে যাবে। পোড়া গন্ধ চলে আসবে। পাশের চুলায় হাতা ঘুরাচ্ছে কৃষ্ণ। জব্বলপুরের ছেলে। জমির আলীর বিশেষ ভক্ত। হঠাৎ সে হাতা ঘুরানো বন্ধ করে ভীত গলায় বলল, সাধুজী, ডেগ মে কিয়া। চুচুড়া!
কৃষ্ণ হাতায় করে জিনিসটা তুলল। সিদ্ধ হয়ে সাদা হয়ে যাওয়া একটা মরা চিকা। তার লম্বা লেজ হাতের বাইরে কিলবিল করছে। কৃষ্ণ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, রাম রাম। কিছুক্ষণ আগেই সে এই হাড়ির লাপসির লবণ দেখেছে। তার নাড়িভুড়ি উল্টে বমি আসছে।
হেড বাবুর্চি এবং রসুই মাস্টারকে খবর দেয়া হলো। রসুই মাস্টার ঠাণ্ডা গলায় বলল–এটা কোনো ব্যাপার না। চিকা নর্দমায় ফেলে দাও। চিকা গরমে সিদ্ধ হয়ে গেছে, কাজেই লাপসি নষ্ট হয় নাই। আরো কিছুক্ষণ শক্ত করে জ্বাল দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘটনা যেন প্রকাশ না হয়। ঘটনা যদি প্রকাশ হয়। এইখানে যারা কাজ করছে তাদের প্রত্যেককে সাতদিনের জন্যে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
জমির আলী বলল, ওস্তাদ কাজটা উচিত হবে না।
রসুই মাস্টার ক্ষিপ্ত গলায় বলল, দাড়িওয়ালা বান্দর আমাকে উচিত অনুচিত শিখায়। তোরে আমি মরা ইঁদুর খাওয়ায়ে দিব। খবরদার কেউ যেন কিছু না জানে।
এত সাবধানতার পরেও ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। লপসির সঙ্গে কয়েকটা মরা ইঁদুর আছে এই রকম গুজব দ্রুত রটে গেল। খেতে বসা কয়েদিরা ধুন্ধুমার কাণ্ড লাগিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে পুরো অঞ্চল রণক্ষেত্র। পাগলা ঘণ্টি বাজছে। একজন সেন্ট্রির মাথা ফুটন্ত ডালের কড়াইয়ে ডুবিয়ে দেয়া হলো। বিভৎস অবস্থা। কাঁদুনে গ্যাস, রবার বুলেট, সবশেষে সত্যিকার বুলেটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলো। দেখা গেল মারা গেছে দুজন। দুজনই ডিউটির সেন্ট্রি। আহত হয়েছে আঠারো জন। এই আঠারো জনের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর। চারজনই গুলি খেয়েছে। বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
গোলাগুলিতে জমির আলীর তেমন কিছু হয় নি। ছোটাছুটি করতে গিয়ে উল্টে পড়ে তার শুধু দুটা দাঁত ভেঙ্গেছে। পায়ের একটা নখ উল্টে গেছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হলো না। পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে নির্জন সেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। মিথ্যা গুজব রটিয়ে জেলে রায়ট সৃষ্টি করা, সেন্ট্রি এবং কয়েদি সংঘর্ষে যুক্ত থাকা, সেন্ট্রি হত্যা–এ ধরনের চারটি আলাদা আলাদা মামলায় তার এবং বাবুর্চির হেল্পার কৃষ্ণের সাত বছর করে সাজা হয়ে গেল। বলরামের হলো ফাঁসির হুকুম। সে একাই একজন সেন্ট্রির মাথা ফুটন্ত ডালে চুবিয়ে রেখেছিল। আলীপুর জেল থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো পাটনা জেলে। বলরামের সঙ্গে শেষ দেখার দিন বলরাম নখদর্পণের মাধ্যমে শেষবারের মতো জমিরের তিন মেয়ের খবর দিল। বলরাম স্পষ্ট দেখল–তিনটি মেয়েই ভালো আছে। সুস্থ আছে। বড় মেয়েটির গায়ে লাল রঙের নতুন একটা জামা। সবচে ছোটটির মাথায় সাদা রঙের উলের টুপি।
গরমের সময় মেয়েটার মাথায় উলের টুপি কেন পরিয়ে রেখেছে এই নিয়ে জমির আলী অত্যন্ত চিন্তিত বোধ করল। গরমের মধ্যে গরম টুপি। কী সর্বনাশের কথা। মাথা ঘামবে। শিশুদের মাথা ঘামলে দ্রুত ঠাণ্ডা লাগে। জমির আলী দুঃখিত গলায় বলল, কেউ খুশি হয়ে টুপিটা দিয়েছে। দুইবোন আদর করে টুপি পরিয়ে দিয়েছে। এরাও তো বাচ্চা মানুষ। এরা কি আর জানে কোনটায় শিশুর ক্ষতি হয়। কোনটায় হয় না।
বলরাম জমির আলীকে নানাবিধ সান্ত্বনার কথাও শোনাল। সাত বছর কোনো ব্যাপার না। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। পাটনা জেল জায়গা ভালো। ব্যবস্থাও ভালো। আবহাওয়া অতি মনোরম। নিজের ফাঁসির হুকুমে তাকে মোটেই চিন্তিত মনে হলো না। দানে দানে তিনদান হবার কথা। তিনদান হয়েছে। তার হাত দিয়ে তিনজন চলে গেছে। কপালে লেখা ছিল, লেখা ফলেছে। এতে চিন্তিত হবার কী আছে?
পনের বছর পরের কথা
পনের বছর পরের কথা।
আশ্বিন মাস। স্বাধীন-বাংলা সার্কাস পার্টির মালিক হারুন সরকারের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে, পানি ঢালছে আসমানী। জামদানী এবং পয়সা দুজনই আড়াল থেকে দৃশ্যটা দেখছে। দুজনের মুখেই চাপা হাসি। শুধু আসমানী গম্ভীর হয়ে আছে। গম্ভীর হয়ে থাকলেও তার চোখে হাসি চিকমিক করছে। তিন বোনের হাসি আনন্দের উৎস পানি ঢালার সময় হারুন সরকারের কর্মকাণ্ড। সে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো ক্রমাগত মাথা ডানে বামে দোলাচ্ছে। নিশানা ঠিক করে পানি ডালা যাচ্ছে না।
সার্কাস পার্টির আজ শো আছে। শোর আগে হারুন সরকারের মাথায় যন্ত্রণা হয়, প্রেসার বেড়ে যায়। বুকে চাপ ব্যথা হয়। তখন দীর্ঘ সময় ধরে মাথায় পানি ঢালতে হয়। পানি ঢালার কাজটা সব সময় করে আসমানী। দুলন্ত মাথায় নিশানা ঠিক রেখে পানি ঢালা খুবই কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজ আসমানী
আনন্দ নিয়ে করে। কাজটা মজার। তিন বোনই খুব মজা পায়।
এখন বাজছে পাঁচটা। শো শুরু হবে সন্ধ্যা সাতটায়। কখনো এত আগে থেকে পানি ঢালার প্রয়োজন হয় না। আজ প্রয়োজন পড়েছে, কারণ আজ প্রথম শো। প্রথমটা ধরে গেলে বাকিগুলিও ধরবে। প্রথমটা না ধরলে আর ধরবে না।
সার্কাসের জন্যে জায়গাটা ভালো। ইবাদত নগর। বড় গঞ্জ। সুতার কারখানা আছে, ইটের ভাটা আছে। মনু নদীর পাড়ে গঞ্জ। সেই নদীতে ব্রিজ বানানো হচ্ছে। শত শত মানুষ ব্রিজ বানানোতে লেগে আছে। সাদা চামড়ার কিছু সাহেব সুবাও আছে। এরা তাঁবু খাটিয়ে নদীর পাড়েই থাকে। ভাটি অঞ্চলের সঙ্গেও জায়গাটার যোগ আছে। ভাটি অঞ্চলের মানুষ আমোদ ফুর্তির জন্যে পয়সা খরচ করতে ডরায় না। যাত্রা-সার্কাসে ঘেটু গান এদের খুব পছন্দের জিনিস।
ইবাদত নগরের একটাই সমস্যা দুটা সিনেমা হল আছে। যেখানে সিনেমা হল আছে সেখানে সার্কাসের শো করা কঠিন। হল মালিকরা নানান ঝামেলা করে। যে কদিন সার্কাস চলে সেই কদিন সিনেমায় লোক হয় না। রুটি রুজির ব্যাপার, ওরা সমস্যা করবেই। স্থানীয় ক্ষমতাবান লোকরাও সমস্যা করে। তাদের সমস্যা অন্যরকম। তারা খোজ করে সার্কাসে মেয়ে কী আছে। তারা সার্কাসের মেয়েদের সঙ্গে প্রাইভেট আলাপ করতে চায়। থানাওয়ালাদেরও ব্যাপার আছে। থানাওয়ালাদের শুধু ফ্রি পাস দিলে হয় না। ফ্রি পাসের সাথে টাকাপয়সা দিতে হয়। তাদের খুশি রাখতে হয়। গঞ্জ মানেই গঞ্জের মাস্তান। সার্কাস যতদিন চলে এই মাস্তানরা সার্কাসের দলের সঙ্গেই থাকে। নানান ফদি-টন্দি করে এদেরকে ঠাণ্ডা রাখতে হয়। মদ খাওয়াতে হয়। টাকা-পয়সা দিতে হয়।
নতুন কোনো জায়গায় সার্কাসের দল নিয়ে যাওয়ার পর পর হারুন সরকার ঠিক করে–আর না, এই শেষ। দল ভেঙে দেয়া হবে, যে যার বাড়ি চলে যাবে। সে নিজে চলে যাবে নেত্রকোনায় তার গ্রামের বাড়িতে। দুতিনটা পুকুর কাটিয়ে পাঙ্গাশ মাছের চাষ করবে। আজকাল পাঙ্গাশ মাছের চাষ খুবই লাভজনক। কিংবা শুকনা মরিচের ব্যবসা করবে। সেটাও না পেলে জমি-জিরাত বেচে ছোট কোনো হোটেলে ঘর ভাড়া করে থাকবে। সে একা মানুষ। একটা মানুষের জীবন কাটানো কোনো সমস্যা না।
মাথায় পানি দেয়া শেষ হয়েছে, হারুন হাতের ইশারায় আসমানীকে পানি ঢালতে নিষেধ করল। আসমানী বলল, আপনার মাথার যন্ত্রণা কমেছে? হারুন সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। মেজাজ খারাপ অবস্থায় কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কথা বললে সেই কথা মাথার ভিতরে চলে যায়। মাথার ভিতরে গিয়ে দপদপ করে।
হারুন বলল, যাও, সামনে থেকে যাও। তৈয়বকে পাঠাও।
আসমানী হাতের গামছা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, মাথাটা মোছেন।
হারুন বলল, মাথা মোছার দরকার নাই। আমার কি মাথা ভর্তি চুল আছে যে আধা ঘণ্টা ধরে মাথা ঘষাঘষি করতে হবে? চিন্তায় চিন্তায় মাথার সব চুল পড়ে গেছে। সামনে দাঁড়ায়ে থেকো না, তৈয়বকে পাঠাও। আরেকটা কথা–মাথায় পানি ঢালার সময় লক্ষ করেছি তোমার দুবোন আমাকে দেখায়ে দেখায়ে ফিক ফিক করে হাসাহাসি করতে ছিল। আমি তো জোকারি করতে ছিলাম না। হাসাহাসির কারণ কী? এইরকম যেন না হয়।
আসমানী বলল, আপনি ডাক দিয়ে ধমক দিয়ে দেন।
হারুন বলল, শোর আগে আগে আর্টিস্টকে ধমক দেয়া নিষেধ। এতে আর্টিস্টের মেজাজ খারাপ হয়। মেজাজ খারাপ হলে খেলা খারাপ হয়। দাঁড়ায়ে আছ কেন? তৈয়বকে খবর দিতে বললাম না?
তৈয়ব আলী দলের ম্যানেজার। বেটে খাট মানুষ। বিশাল শরীরের গোলগাল একজন মানুষ। শরীরের তুলনায় মাথাটা ছোট। ঠোট না নড়িয়ে সে কথা বলতে পারে। এই ক্ষমতাটা তার কাজে আসে। কারণ সে শুধু দলের ম্যানেজার না, সে সার্কাসের জোকার। জোকারকে কিছু বিশেষ বিদ্যা জানতে হয়। তৈয়ব আলী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একা আসর জমিয়ে রাখে। অতি সাধারণ কর্মকাণ্ডের মধ্যেও সে এমন কিছু করে যে দর্শকরা হেসে গড়াগড়ি খায়। শো শুরু হয় তাকে দিয়ে। সে হাড় জিরজিরে একটা ঘোড়া নিয়ে উপস্থিত হয়। দর্শকদের ঘোড়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়–এ আমার পরিবার, স্ত্রী, ওয়াইফ। সে কথা বলছে কিন্তু ঠোট নড়ছে না। পাথরের মতো মুখ। দর্শকরা শুরুতেই হকচকিয়ে যায়। ঘোড়াকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবার পর সে ঘোড়ার গায়ে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে, ও আমার স্বপ্নের রানী, আদরের ঘোড়াকুমারী, কেমন আছ গো? তখন ঘোড়া ফোঁস করে উঠে গা ঝাড়া দেয়। তৈয়ব আহত গলায় বলে, ফোস ফোস করতেছ কেন? দর্শকদের হাসি শুরু হয়। হাসি চূড়ান্ত পর্বে যায় যখন সে পকেট থেকে একটা ব্রা বের করে ঘোড়াকে পরানোর চেষ্টা করে।
তৈয়ব এসে হারুন সরকারের সামনে দাঁড়িয়েছে। তার পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখ। সে দাড়িয়েছে মাথা নিচু করে দলের মালিকের চোখে চোখ রেখে সে কখনো কথা বলে না।
হারুন বলল, তৈয়ব, অবস্থা কী?
কীসের অবস্থা?
টিকিট বিক্রির কী অবস্থা?
মোটামুটি।
হারুন বিরক্ত গলায় বলল, মোটামুটি, ভালো, মন্দ–এই জাতীয় কথা আমাকে বলবে না। কত টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে?
টিকিট বিক্রির খবর নেই নাই।
খবর নেও নাই কেন?
টিকিট এখনো বিক্রি হইতেছে এই জন্যে খবর নেই নাই।
থানাওয়ালার কাছে লোক পাঠিয়েছিলে?
হুঁ।
সব ঠিক আছে?
হুঁ।
আর কোনো সমস্যা আছে?
বাজারের মসজিদের ইমাম সাহেব ঝামেলা করতেছে। বলতেছে সার্কাস হতে দিবে না।
উনার সমস্যা কী?
উনি বলেছেন যাত্রা, সার্কাস এইগুলো বেদাতি কাজ কর্ম। নাচ গান হয়। এইগুলো হইতে দিবেন না।
ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম দেখি।
আপনে চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা নিতেছি।
কী ব্যবস্থা?
তৈয়ব বিরস মুখ করে চুপ করে রইল। হারুন রাগী গলায় বলল, কী ব্যবস্থা নিতেছ শুনি।
তৈয়ব বলল, আমি ব্যবস্থা নিতেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।
হারুন নিঃশ্বাস ফেলল। তৈয়বের উপর অবশ্যই ভরসা করা যায়। সে যখন বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে তখন বুঝতেই হবে যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভালো ব্যবস্থা। তৈয়বের মতো জোকার পাওয়া যেমন কঠিন তার মতো ম্যানেজার পাওয়াও কঠিন।
বাজনাদারদের দলকে পাঠায় দেও, একটা চক্কর দিবে। হাতির পিঠে করে পাঠাও।
বাজনাদার পাঠায়েছি। হাতির পিঠে দেই নাই। এরা ভ্যান গাড়িতে করে গেছে।
হাতির পিঠে দাও নাই কেন? হাতি দেখলে সবাই বুঝত আমাদের দল ভালো। পুতু পুতু দুধ-ভাত দল না। হাতি ঘোড়া আছে। সব কিছুর পাবলিসিটি লাগে।
তৈয়ব চুপ করে রইল।
খাম্বার মতো দাঁড়ায়ে থাকবা না, কথা বলো। হাতি পুন্দের চিপায় লুকায়ে রাখলা কোন হিসাবে?
হাতির শরীর ভালো না।
হারুন চমকে উঠে বলল, বলো কী! কী হয়েছে?
খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সর্বনাশ!
হারুনের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। হাতি তার নিজের না। হাতি পোষার মতো বড় দল তারটা না। হাতি ভাড়া করা। বায়নার টাকা ছাড়াও প্রতি শোতে তিনশ টাকা ভাড়া দিতে হয়। হাতির কিছু হলে হাতির মালিক জহির উদ্দিন তাকে ছাড়বে না। হাতির ভাড়া বাবদ জহির উদ্দিনের দশ হাজার টাকা পাওনা হয়েছে। পাওনা টাকার জন্যে যে-কোনোদিন লোক পাঠাবে। তখন কী উপায় হবে কে জানে।
তৈয়ব ঠাণ্ডা গলায় বলল, চিন্তা করবেন না।
হারুন রাগী গলায় বলল, বেকুবের মতো কথা বলবে না। বেকুবের মতো কথা আমার পছন্দ না। হাতি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আমি চিন্তা করব না? আনন্দে নাচব! ব্যান্ড মাস্টারকে ডাক দাও। বাজনা বাজাক, আমি ড্যান্স দেই।
আমি ব্যবস্থা নিতেছি।
তুমি কী ব্যবস্থা নিবে? তুমি কি হাতির ডাক্তার? সব সময় ফাজিলের মতো কথা। যাও, সামনে থেকে যাও।
আপনি দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়েন।
ওরেব্বাসরে! তুমি তো শুধু হাতির ডাক্তার না, তুমি দেখি আবার মানুষেরও ডাক্তার। যাও যাও, সামনে থেকে যাও।
হারুনের মাথার দুপাশে দপদপ করছে। আবারো মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছে না। দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে থাকার উপদেশটা খারাপ না। ঘুম হবে না, কিন্তু ঝিমভাব আসবে। ঝিমভাবের কারণে মাথার যন্ত্রণা কমে যাবে। হারুন মনে মনে বিড়বিড় করল–আল্লাহপাক, আজকের দিনটা পার করে দাও। আর না, সব ছেড়ে ছুড়ে দিব। প্রয়োজনে মওলানা ডাকিয়ে তওবা করব। মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্ব করে আসব। মদিনা শরীফে গিয়ে নবিজির মাজার জিয়ারত করব। আজকের দিনটা পার করে দাও মওলা।
প্রবল হাসির শব্দ। মনে হচ্ছে এক সঙ্গে শতশত মানুষ হা-হা করছে। হাসির শব্দে তাঁবুর তিরপল খুলে মাথায় পড়ে গেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হারুন বিছানায় উঠে বসল। মাথার উপর তাঁবু পড়ে নি। সব ঠিকঠাক আছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার ঘুম না ভাঙিয়েই শো শুরু করে দিয়েছে। হাসির শব্দের উৎস জোকারের জোকারি। এখন নিশ্চয়ই ঘোড়া এবং তৈয়বের কথাবার্তা হচ্ছে। ঘোড়াকে ব্রা পরানোর চেষ্টা চলছে। যেভাবে হাসির শব্দ আসছে শো অবশ্যই জমে গেছে। ঘোড়ার খেলার পরই হবে পাখির খেলা। হালকা জিনিসের পরপরই ভারী কোনো কিছু দেয়া যায় না। পাখির খেলা সবসময় জমে না। মাঝে-মাঝে খুব জমে যায়, আবার মাঝে-মাঝে দর্শকরা চেঁচিয়ে উঠে–রন কর। বন কর। ঐ পক্ষীওয়ালা, বাড়িত যা। মাঝে মাঝে হাত তালিতে কান ফাটার উপক্রম হয়। আজ কী হবে কে জানে!
হারুন বিছানা থেকে নামল। তাঁবুর পেছন দিয়ে বের হয়ে দর্শকের দিক দিয়ে ঢুকল। দর্শক কেমন হয়েছে দেখা দরকার। পাখির খেলা জমে কি-না সেটাও দেখা দরকার। পাখির খেলা জমে গেলে বাকি খেলা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা নেই। শেষ আইটেম দড়ির খেলা। যার শেষ ভালো তার সব ভালো। দড়ির খেলাটা মারাত্মক। স্বাধীন বাংলা সার্কাসের আসল খেলা। তিন বোন দশ মিনিট ধরে খেলা দেখায়। এই দশ মিনিট দর্শকরা প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকে। আঠারো ফুট উপরে দড়ি টানানো। তিন বোন প্রথমে দড়ির উপর দিয়ে সাবধানে হেঁটে যায়। তাদের দেখেই মনে হয় তারা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে খুব ভয় পাচ্ছে। এখনি পড়ে যাবে এখনি পড়ে যাবে ভাব। ভয় পাওয়ার কথা। দড়ির নিচে কোনো নায়লনের নেট নেই। একবার পড়লে অবশ্যই মৃত্যু। আগে নেট থাকত। দেখা গেল নিচে নেট বিছানো থাকলে দর্শকরা মজা পাচ্ছে না। কারণ তারা জানে দড়ির উপর থেকে পড়ে গেলে কোনো ক্ষতি নেই, ব্যাথা পাবে না। জালে আটকে যাবে। যেই নায়লনের নেট সরিয়ে দেয়া হলো অমনি খেলা জমে গেল। সার্কাসে মানুষ বিপদজনক খেলা দেখতে আসে। নিচে নায়লনের শক্ত নেট ফিট করে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটায় কোনো বিপদ নেই।
বিপদজনক অবস্থায় দড়ির উপর দিয়ে অতি সাবধানে হেঁটে যাওয়া দেখেই দর্শকরা হতভম্ব হয়। যে দড়ির উপর হেঁটে যাচ্ছে তার জন্যে খানিকটা মায়াও হয়। মেয়েগুলি দড়ির এক প্রান্তে চলে এলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তখন শুরু হয়। আসল খেলা। মেয়ে তিনটি দড়ির উপর দৌড়াতে শুরু করে। লাফালাফি করছে, দৌড়াচ্ছে, হাসছে। সেই সঙ্গে বাজছে তুমুল বাজনা। দর্শকরা হৃদপিণ্ড গলার কাছে নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের টেনশান আর সহ্য হয় না। খেলা শেষ হলে তারা বাঁচে। সার্কাস পার্টির জন্যে এরকম একটা আইটেমই যথেষ্ট। সেখানে স্বাধীন বাংলা সার্কাসের চার পাঁচটা ভালো আইটেম আছে। জাদুকর প্রফেসর মতিন আছে। যে তার সার্টের পকেট থেকে জ্বলন্ত আগুন বের করে সেই আগুনে সিগারেট ধরায়। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ে কান দিয়ে। মুখে সিগারেট টানছে, ভুমভুম করে দুকান দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। ডিম থেকে পাখি বের করে সেই পাখিকে কাঠের বাক্সে রেখে ফু দিতেই পাখি হয়ে যায় খরগোস।
হারুন দর্শকদের পেছনের সারির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। দর্শক সমাগম ভালো। আজ প্রথম শো, অনেকেই পাশ নিয়ে ঢুকেছে, তারপরেও বলতে হবে দর্শক সমাগম ভালো। অনেক মহিলা এসেছে। মহিলা দর্শক আল্লাহর নেয়ামতের মতো। এরা পুরুষদের মতো বাড়িতে গিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকবে না। পাড়া বেড়াতে বের হবে। এর তার সঙ্গে গল্প করবে। যা দেখেছে তার চেয়েও বেশি বলবে। হারুন মহিলা গুনতে শুরু করেছে। আহারে, এক বেচারি কিছুই দেখতে পারছে না। তার বাচ্চাটা বড়ই বিরক্ত করছে। খুন খুন করে কাঁদছে। এটা একদিক দিয়ে ভালো। বাচ্চার মা আবারো আসবে। উপস্থিত থেকেও যে জিনিস দেখা যায় না তার মায়া বড়ই কঠিন মায়া।
পাখির খেলা শুরু হয়েছে। খাঁচায় ছটা টিয়া পাখি নিয়ে পাখিওয়ালা ঢুকেছে। পাখিওয়ালার নাম খসরু। তার চেয়ে রোগা মানুষ বাংলাদেশে দ্বিতীয় কেউ আছে কি-না সন্দেহ। যখন স্টেজে দাঁড়ায় তখন মনে হয় আরবি অক্ষর আলীফ দাঁড়িয়ে আছে। খসরু পাতিলের তলার মতো কালো। মাথার সমস্ত চুল পেকে যাওয়ায় মেন্দি লাগিয়ে সে চুল রঙ করেছে। এখন তার মাথা ভর্তি লাল চুল। লাল এবং কালোর কিস্তুত চেহারা। এটা একদিক দিয়ে ভালো, সার্কাসের লোকজনের চেহারা যত কিম্ভুত হবে তত ভালো।
হারুন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার প্রথমেই মনে হলো খসরুর পোশাকটা ঠিক হয় নাই। সাধারণ শার্ট প্যান্ট পরে ঢুকেছে। প্যান্টটা ময়লা। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। পাখিওয়ালাকে পোশাক কিনে দিতে হবে। সে টিয়াপাখির খেলা দেখায়, তার পোশাক হবে টিয়া পাখির মতো। সবুজ প্যান্ট, সবুজ শার্ট। মাথায় হলুদ টুপি। দূর থেকে দেখে তাকে যেন মনে হয় লম্বা একটা টিয়া পাখি।
দর্শকমণ্ডলী! নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী। আমি পাখিওয়ালা। আমার নাম খসরু। টিয়া খসরু। আমি ছয়টা টিয়া পাখি নিয়ে এসেছি। খাঁচার ভিতরে আছে বলে দূর থেকে আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। দিলাম খাচা খুলে।
খাঁচা খোলা হলো। ছয়টা পাখি নিমিষের মধ্যে খাঁচা থেকে বের হয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল। টিয়া খসরু শূন্য খাচা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যান্ড বাদকের দল কিছুক্ষণ তুমুল বাজনা বাজাল। বাজনা থামার পর খসরু বলল–খাচা খুলে দিলে খাঁচার পাখি উড়ে যায়। আর ফিরে আসে না। দেখি এদের কী অবস্থা! আয় আয়–সবুজ পক্ষী ঘরে আয়।
খসরুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পাখি উড়ে উড়ে এসে খাঁচায় ঢুকতে লাগল। খসরু পাখি গুনছে–এক-দুই-তিন-চার…
দর্শকদের তালি পড়তে শুরু করেছে। তালিরও একটা ব্যাপার আছে। দর্শকদের মধ্যে সার্কাসের নিজস্ব কিছু লোক আছে। বাবুর্চি আছে, বাবুর্চির হেল্পাররা আছে। তাদের কাজ হলো প্রতিটা আইটেমের শেষে তালি শুরু করা। একজন শুরু করলে দশজন শুরু করে। সার্কাস জমে যায়। দৈ জমার জন্যে দৈএর বীজ দিতে হয়। সার্কাস জমার জন্যে দিতে হয় হাততালির বীজ।
টিয়া খসরু আবার কথা বলা শুরু করেছে। তার গলার আওয়াজ ভালো। এত দূর থেকেও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।
দর্শকমণ্ডলী! নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, স্বামীস্ত্রী, লাইলী-মজনু অর্থাৎ প্রেমিক-প্রেমিকা… আপনারা খাওয়া-খাদ্য নিয়া মারামারি দেখেছেন। খাওয়া-খাদ্য নিয়া মানুষ মারামারি করে, জন্তু-জানোয়ার মারামারি করে। এক হাড়ি নিয়া দুই কুত্তার টানাটানি দেখেন নাই? অবশ্যই দেখেছেন। অখন দেখবেন দুই পাখির খাদ্য নিয়া টানাটানির খেলা।
দুটা টিয়া পাখি পাতলা একটা টোস্ট বিসকিটের দুপ্রান্ত ধরে উড়ছে। স্থির হয়ে উড়ছে, আবার চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে উড়ছে। দেখার মতো দৃশ্য। হাততালি শুরু হয়েছে। হাততালির সঙ্গে শিস দেয়ার শব্দ আসছে। একজন মহিলা মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে পাশের আরেক মহিলার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, বুবু দেখছ, কী আচানক!
পাশের মহিলা বলল, এইগুলা কিছু না–ট্রেনিং। ট্রেনিং দিয়া বানাইছে। ট্রেনিং দিলে পশু-পক্ষী পারে না এমন কাম নাই।
হারুন আগ্রহ নিয়ে মহিলাদের কথা শুনছে। কত ধরনের মানুষ কত ধরনের কথা বলে। কেউ কেউ জ্ঞানী, তাদের কাছে কোনো খেলাই ভালো লাগে না। আবার কিছু কিছু লোক আছে যা দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়। এরা মুগ্ধ হবার জন্যেই আসে। এরাই প্রকৃত দর্শক। এদের খেলা দেখিয়ে আরাম আছে। এদের জন্যেই সার্কাস।
ও বুবু দেখ দেখ–কারবার দেখ!
পক্ষী খাওয়া-খাদ্য নিয়া ঝাপ্টা ঝাল্টি করে, এইগুলান কত দেখছি।
হারুন মনে মনে বলল, দূর হারামজাদী, এই জিনিস তুই তোর জন্মে দেখস নাই। তোর ভাগ্য ভালো তুই স্বাধীন বাংলা সার্কাসে ঢুকছস।
টিয়া খসরু এখন শেষ খেলা দেখাচ্ছে। সে হাত সোজা করে রেখেছে। ছটা পাখি তার হাতে বসা। এমনভাবে বসে আছে যেন এরা জীবন্ত পাখি না, এরা পুতুল। খসরু পাখিদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের খেলা দেখে দর্শকরা খুবই মজা পেয়েছেন। ইনাদের সালাম দাও। ডানা তুলে সালাম দাও।
পাখিগুলির প্রত্যেকটি তাদের বাম দিকের ডানা খানিকটা তুলল। একটা ডান দিকেরটা তুলে ফেলেছিল, অন্যদের দেখে ভুল সংশোধন করল। দর্শকরা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।
খসরু বলল, এখন তোমরা ইস্কুলের ছাত্র। পড়া পার নাই। হোমওয়ার্ক কর নাই। মাস্টার শাস্তির হুকুম দিয়েছেন। এক ঠ্যাং-এ দাঁড়ানোর শাস্তি। দেখি এক ঠ্যাং-এ দাঁড়াও।
পাখি ছটাই এক ঠ্যাং-এ দাঁড়াল।
তুমুল তালি পড়ছে। শিস বাজছে। সার্কাস জমে গেছে।
পাখির আইটেম মোটামুটি দুর্বল আইটেম। এই আইটেমেই যখন পার পেয়ে গেছে অন্যগুলো উড়াল দিয়ে যাবে। খসরু ভালো দেখিয়েছে। তাকে সবুজ একটা পোশাক বানিয়ে দিতেই হবে। পপলিনের সবুজ কাপড় পাওয়া গেলে কালই দরজির দোকানে বানাতে দেয়া হবে। হারুন তাঁবু থেকে বের হলো। অজু করে দুরাকাত শোকরানা নামাজ পড়তে হবে। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা কী তার খোঁজ নেয়া দরকার। ভালো কাজ-কর্মের পরে ভালো খাওয়াদাওয়া দরকার। রাতে খিচুড়ি করতে বলা হয়েছিল। চাল-ডাল আর শজির খিচুড়ি। এখন মনে হচ্ছে সঙ্গে মাংস থাকা দরকার। খিচুড়ির সঙ্গে ঝাল গরুর মাংস।
হাতির খোঁজও নেয়া দরকার। হাতি খাওয়া-দাওয়া কি শুরু করেছে?
গোপনে হাত জোড় করে হাতিকে বলতে হবে, ভুল-ত্রুটি কিছু হলে ক্ষমা করে দাও। খাওয়া-দাওয়া কর। তুমি মারা পড়লে, আমি গরিব মানুষ, আমি জানে মারা পড়ব। আমার পুরা দল মারা পড়বে। হারুন মোটামুটি নিশ্চিত হাতি মানুষের কথা বোঝে। এবং সমস্ত পশু-পাখির মধ্যে হাতির অন্তরেই মায়া বেশি।
হারুন নামাজে দাঁড়াবার আগে হাতির ঘরে যাওয়া ঠিক করল।
পর্দা ঘেরা জায়গায় হাতিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাতি শুয়ে আছে। হাতির পাশে জামদানী বসে আছে। সে হাতির গুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যটা হারুনের ভালো লাগল। জামদানী নামের এই মেয়েটার অন্তরেও মহব্বত আছে। মহব্বত ছাড়া কিছু হয় না। সার্কাসের মতো বড় একটা দল এক সঙ্গে রাখতে হলে সবার জন্যে সবার মহব্বত থাকতে হবে। মানুষ মায়া করবে পশুর জন্যে, পশু মায়া করবে মানুষের জন্যে। সবাই বাধা থাকবে মায়ার শিকলে।
হারুন রাগি গলায় বলল, (নকল রাগ। আসমানী, জামদানী, পয়সা–এই তিন মেয়ের উপর সে কখনো রাগ করে না। কিন্তু ভাব দেখায় সারাক্ষণ রেগে আছে।) তুমি এইখানে কী কর? শো টাইমে সবসময় তৈরি থাকতে হয়। তুমি তো খেলার ড্রেসও এখনো পর নাই।
জামদানী কিছু বলল না। চুপ করে রইল।
শো টাইমে নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে। মনে মনে ইয়া মুকাদ্দিমু, ইয়া মুকাদ্দিমু এইটা জপবে। ইয়া মুকাদ্দিমুর অর্থ হলো–হে অগ্রসরকারী। তোমাদের খেলাটা রিস্কের খেলা। এই খেলায় মন স্থির রাখার জন্যে আল্লাখোদার নাম নিতে হয়। হাতির কাছে কী করতেছিলা?
কিছু না।
মেয়েছেলের হাতির ঘরে যাওয়া ঠিক না। তিনটা জায়গা আছে মেয়েছেলের জন্যে নিষিদ্ধ। পানের বরজ, হাতিশালা, আরেকটা জায়গার নাম মনে আসতেছে না। মনে আসলে বলব। নিষিদ্ধ কী জন্যে?
আরে কী যন্ত্রণা! নিষিদ্ধ কী জন্যে আমি জানি নাকি? আমি তো নিষিদ্ধ করি নাই। কথা বাড়াবা না। যাও, ঘরে যাও। দুই মিনিটের মধ্যে খেলার ড্রেসে তোমাকে দেখতে চাই।
জামদানী ক্ষীণ গলায় বলল, হাতিটার কী হয়েছে আমি জানি।
হারুন বিরক্ত গলায় বলল, ফাইজলামি কথা আমার সঙ্গে বলবা না। আমি ফাইজলামি কথা একেবারেই পছন্দ করি না। তুমি হাতির ডাক্তার না। তুমি দড়ি খেলার খেলোয়াড়। তোমার কাজ দড়ির উপরে। হাতির শুড় হাতানী তোমার কাজ না। এই জগতে সব মানুষের আলাদা আলাদা কাজ দেয়া আছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজ ঠিকমতো করবে। তাতে সংসার ঠিকমতো চলবে। বুঝেছ?
জি।
ঠিকমতো বুঝেছ? না এক কান দিয়ে ঢুকায়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দিয়েছ?
ঠিকমতো বুঝেছি।
ঠিকমতো বুঝলে ভালো। আবার বেশি বুঝে ফেলবা না। বেশি বুঝে ফেললে খারাপ। তোমার বড় বোন আসমানী, সে সময় সময় বেশি বুঝে। আমি খবর পেয়েছি সে বাবুর্চিকে গিয়ে বলেছে সে তার তিন বোনের জন্যে আলাদা রান্না করবে। তিনজনের জিনিসপত্র তারে যেন আলাদা করে দিয়ে দেয়া হয়। এইসব কী ফাইজলামি? সার্কাসের দল হলো একটা সংসার। সংসারে দুই-তিন জায়গায় পাক হয় না। এক জায়গায় পাক হয়। বুঝেছ?
জি।
ঠিকমতো বুঝেছ?
জি।
যাও, ঘরে যাও। দুই মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে থাক। দোয়াটা যে। বলেছিলাম মনে আছে?
জি মনে আছে।
বলো দেখি।
জামদানী ভীত গলায় বলল, মনে নাই।
দোয়াটা হলো ইয়া মুকাদ্দিমু। যাও, জপতে জপতে যাও।
জামদানী চলে গেল। হারুন হাতির সামনে বসল। হাতি তাকিয়ে আছে তার দিকে। এত বড় একটা জানোয়ার অথচ কী পুতি পুতি চোখ। অথচ পেঁচার মতো ছোট পাখির কী বিরাট দুই চোখ? হারুন বলল, কীরে ব্যাটা, খাওয়া বন্ধ কী জন্যে? রাগ করেছ? বলেই মনে হলো ভুল হয়েছে। ব্যাটা হবে না। এটা মাদী হাতি। সার্কাসে কখনো মর্দ হাতি রাখা হয় না। সব সময় মাদী হাতি রাখা হয়। মর্দ হাতি সময় সময় মাথা গরম করে, তখন তাদের সামলানো কঠিন। মাদী হাতি কখনো মাথা গরম করে না।
হারুন বসে বসেই এক পা এগুলো। নরম গলায় বলল, তোকে ব্যাটা বলেছি বলে মনে কষ্ট পাস নাই তো? আদর করে ব্যাটা বলেছি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস কী জন্যে? তোর কী হয়েছে বল দেখি। কেউ কিছু বলেছে? তোর যদি স্পেশাল কিছু খেতে ইচ্ছা করে তাহলে বল–ব্যবস্থা করি। তেঁতুল খাবি? এক কেজি তেঁতুল এনে দেই। হারুন ভয়ে ভয়ে হাত বাড়াল। সে সার্কাস দলের মালিক। জন্তু-জানোয়ার নিয়েই তার কাজ। তারপরেও সে খুবই ভীতু ধরনের মানুষ। হাতির দিকে হাত বাড়াতে তার ভয় ভয় লাগছে।
হাতির গায়ে হাত লাগার আগেই হাতি শব্দ করে নড়ে উঠল। হারুন লাফ দিয়ে সরে গেল। সাহস দেখানোর কোনো দরকার নেই।
হারুন শোকরানা নামাজ অতি দ্রুত শেষ করল। তিন মেয়ের দড়ির খেলার সময় সে উপস্থিত থাকবে। আজ পর্যন্ত এমন কোনো দিন যায় নি যে তিন মেয়ে দড়ির খেলা দেখাচ্ছে আর সে সেখানে উপস্থিত নেই। মেয়ে তিনটাকে সে নিজে খেলা শিখিয়েছে। প্রথম যখন তিনবোন এলো তখন ছোটটার বয়স তিন বছর। তিনজনের একজনকে রাগ করে ধমক দিলে তিনজন মিলে একসঙ্গে কান্নাকাটি শুরু করে দিত। দেখে রাগও লাগত, আবার মায়াও লাগত। একজনের জ্বর হয়েছে কিছু খাবে না, বাকি দুজনও খাবে না। একজনকে নতুন কাপড় কিনে দিলে সে পরবে না। তিনজনকেই কাপড় কিনে দিতে হবে। মেয়েগুলিকে নিয়ে হারুনকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কষ্ট বৃথা যায় নাই। মানুষের কোনো কষ্টই বৃথা যায় না।
সার্কাসের দল টিকিয়ে রাখতে হবে মেয়ে তিনটার জন্যে। দল ভেঙে দিলে মেয়ে তিনটা যাবে কোথায়? এই তিন কন্যার যাবার জায়গা নেই।
রাত এগারোটা। হারুন সরকারের ঘরের দরজা বন্ধ। ঘরের ভেতর সে আছে আর আছে বাবুর্চির এসিসট্যান্ট কালু। হারুন সরকার পা ছড়িয়ে বসেছে। কালু পা টিপে দিচ্ছে। খুব আয়োজন করে পা টিপা হচ্ছে। একটা বাটিতে সরিষার তেল নেয়া হয়েছে। আরেকটা বাটিতে পানি। প্রথমে সরিষার তেল দিয়ে ডলা দেয়া হচ্ছে। সেখানেই পানি দিয়ে আবারো ডলা হচ্ছে।
হারুন সরকারের পায়ে সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে হাড়ির ভেতর যন্ত্রণা হয়। ভোতা ধরনের ব্যথা। কোনো কোনো দিন ভোতা ব্যথাটা শেষপর্যন্ত ভোতাই থাকে। কিন্তু মাঝে মধ্যে ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠে। আজ ব্যথা এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে, তবে তা তীব্র ব্যথায় মোড় নিতে পারে। হারুন সরকার ভীত ভঙ্গিতে বসে আছে। ব্যথার গতি বোঝার চেষ্টা করছে। কালুর হাতের কাছে দড়ি আছে। ব্যথা তীব্র হয়ে গেলে দড়ি দিয়ে শক্ত করে পা পেঁচিয়ে বাঁধতে হবে। হারুনের হাতে কালার গ্লাস। গ্লাসে কেরু কোম্পানির জিন। কাসার গ্লাসে কেরু কোম্পানির জিন খাওয়া হারুন শিখেছে তার ওস্তাদ মনু মিয়ার কাছে। মনু মিয়া জিনের সঙ্গে এক দুই বিচি তেঁতুল দিয়ে দিত। জিনিসটা হতো ভয়ঙ্কর। আজ তেঁতুল পাওয়া যায় নি। তেঁতুল ছাড়া জিন খেতে পানশা পানশা লাগছে। নেশা হবে বলে মনে হচ্ছে না। নেশা না হলে সমস্যা আছে। পায়ের ব্যথা সহ্য করা যাবে না।
কালু।
জি।
আজকের শো কেমন হয়েছে?
ফাটাফাটি হইছে। যারা দেখছে মরনের আগের দিনও তারার মনে থাকব।
আইটেম ভালো হয়েছে কোনটা?
সব আইটেম মারাত্মক হইছে। এ বলে আমারে দেখ, সে বলে আমারে দেখ।
তারপরেও তো উনিশ-বিশ আছে।
কালু গম্ভীর গলায় বলল, সবই বিশ। উনিশের কারবার আমরা করি না।
হারুনের মন এমনিতেই ভালো ছিল, কালুর কথায় মন আরো ভালো হলো। হারুনের কেন জানি মনে হচ্ছে ব্যথাটা আজ খারাপের দিকে যাবে না। পায়ে দড়ি বাঁধার প্রয়োজন পড়বে না।
খেলা খুব জমেছিল?
কালু গম্ভীর গলায় বলল, মারাত্মক। বিলাতি সাহেবের চউক উঠে গেছিল মাথার চান্দিতে।
হারুন আগ্রহ নিয়ে বলল, বিলাতি সাহেব ছিল না কি?
ছিল, দুইটা ছিল। ব্রিজ বানাইতেছে তার ইনজিনিয়ার। এর মধ্যে একজন বাংলা কথা পরিষ্কার বলতে পারে। সে আইসা হামকি ধামকি।
হামাকি ধামকি কী জন্যে?
বলে কী, দড়ির ডেনজারাস খেলা দেখাও? প্রটেকশন নাই। নিচে কেউ নাই। একসিডেন্ট হবে। মানুষ মারা যাবে। আমি মনে মনে বলি–যা ব্যাটা লালমুখা। মানুষ মারা গেলে আমরার যাবে। তোর বাপের কী?
আমি তো কিছু জানি না। এই ঘটনা কখন ঘটল?
শো শেষ হওনের পরে। ম্যানেজার সাহেবের সাথে কথা বলেছে। তোমরা শো করতে পারবে না। স্টপ। এইসব হাবিজাবি বলতে ছিল।
কই আমাকে তো ম্যানেজার কিছু বলল না।
সব কথা আপনের কানে তোলা হয় না। ম্যানেজার পেটের মধ্যে রেখে দেয়। পেট থেকে বাইর কইরা দুএকটা কথা বলে, বাকিগুলা ভাত-তরকারির সাথে হজম কইরা ফেলে।
তাই না-কি?
অবশ্যই। আমরার ম্যানেজারের পেট শক্ত। পেটে যেই জিনিস যায় সেইটাই হজম। আলীশান একটা খবর ম্যানেজারের কাছে আছে। ম্যানেজার আপনেরে দেয় নাই। দিব কি দিব না, তার নাই ঠিক।
কী খবর?
কালু চুপ করে গভীর মনোনিবেশে পা টিপছে। আলীশান খবর হুট করে বলে ফেললে খবরের মান থাকে না। হারুন বিরক্ত হয়ে বলল, খবরটা কী?
বগা চাচার ইন্তেকাল হয়েছে!
বগা চাচাটা কে?
জহির উদ্দিন সাবেরে সবেই ডাকে বগা চাচা। পাতলা পুতলা শইল, এই কারণে।
জহির উদ্দিনটা কে? ঠিক মতো জবাব দে। কথা পেঁচাইস না। কথা পেঁচাইলে লাথ দিয়া বিছনা থাইক্যা ফালায়ে দিব।
কালু আহত গলায় বলল, জহির উদ্দিন সাব হাতির মালিক। তারে আপনে নামে চিনবেন না সেইটা ক্যামনে বুঝব। লাথ মাইরা ফেলতে চাইলে ফেলেন। আমরা গরীব। আমরার জন্ম হইছে লাথ খাওনের জন্যে।
চুপচাপ তেল মালিশ কর। কথা বন্ধ।
কালু পায়ে তেল মালিশ করে যাচ্ছে। হারুন এমন ভঙ্গিতে বসে আছে যেন সে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। চারপাশে কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। জহির উদ্দিন মারা গেছে এরচে আনন্দের সংবাদ আর কী হতে পারে। লটারিতে লাখ টাকা পাওয়ার আনন্দের মতো আনন্দ। হাতির মালিক মারা গেছে। হাতি এখন আর কাউকে ফেরত দিতে হবে না। পাওনা টাকাও দিতে হবে না। স্বাধীন বাংলা সার্কাস পার্টি এখন একটা হাতির মালিক।
কালু বলল, হাতির মালিক তো স্যার এখন আমরা।
হারুন বলল, আমরা হাতির মালিক হব কী জন্যে? জহির উদ্দিন সাবের ওয়ারিশানরা হাতির মালিক। কোর্টের কাগজপত্র নিয়া ওয়ারিশান আসলে হাতি ফিরত দিব।
ম্যানেজার সাব ভিন্ন কথা বলেছে।
কী ভিন্ন কথা?
ম্যানেজার সাব বলেছেন হাতি খরিদের বায়না দলিল গত মাসে করা হয়েছে। জাহির উদ্দিন সাব মাসে মাসে টেকা উসল হবে এই কড়ারে হাতি বেচে দিয়েছেন।
হারুন অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, চিন্তাভাবনার মধ্যে থাকি। পায়ে যন্ত্রণা। এইসব কারণে আসল কথা মনে থাকে না। হাতি যে আমরা খরিদ করে নিয়েছি এই কথাটা ভুলে গেছি। খরিদ অবশ্যই করেছি। কাগজপত্র ম্যানেজারের কাছে আছে। টাকা-পয়সাও যতদূর মনে হয় দেওয়া হয়ে গেছে। দেখি ম্যানেজারকে জিজ্ঞাস করি। অল্প কিছু যদি বাকি থাকে দিয়ে দেওয়া দরকার। ঋণ রাখা আমার পছন্দ না। ঠিক আছে তুমি যাও। আজ মনে হয় ব্যথা উঠবে না। ম্যানেজাররে পাঠাও! আমার গ্লাস খালি। গ্লাসে জিনিস দিয়ে যাও। তেঁতুলের জোগাড় দেখবা। এই জিনিস যদি আমারে তেঁতুল ছাড়া খাইতে হয় তাইলে তোমার খবর আছে। কানে ধইরা তাঁবুর চাইর দিকে তোমারে চক্কর দেওয়াব। বুঝেছ?
জি বুঝেছি।
ম্যানেজাররে পাঠাও। পা ছেছড়াইতে ছেছড়াইতে যাবা না। বন্দুকের গুলির মতো যাও।
কালু বিষণ্ণ মুখে বের হয়ে গেল। হারুন তেঁতুল বিহীন জিনের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বুঝল তার নেশা হয়েছে। জিনের নেশা হুট করে উঠে, তাই হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে তার যে জগৎ ছিল এখন সে জগৎ নাই। এখনকার জগৎ আন্দময় জগৎ। হঠাৎ হাতির মালিকানা পেয়ে যাওয়া একটা কারণ হতে পারে।
তৈয়ব এসে বলল, আমারে ডেকেছেন?
হারুন বিরক্ত গলায় বলল, না ডাকলে তুমি আস না? তুমি নবাব সিরাজউদ্দৌলা হয়েছ?
তৈয়ব মেঝেতে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখল। হারুন গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, জহির সাব ইন্তেকাল করেছেন–এই খবর কবে পেয়েছ?
গতকাল।
গতকাল খবর পেয়েছ, আমাকে দেও নাই কেন? না-কি ভুলে গেলা স্বাধীন বাংলা সার্কাসের মালিক আসলে কে? তুমি তো ভেবে বসে আছ তুমিই মালিক। মনে রাখবা তুমি দুই পয়সা দামের ম্যানেজার। এক মিনিটের নোটিশে পাছায় লাথি মেরে তোমারে রাস্তায় ফেলে দিতে পারি। পারি কি-না বলো।
জে পারেন।
এখন বলো এত বড় একটা সংবাদ লুকায়ে রেখেছ কেন?
তৈয়ব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। হারুন কড়া গলায় বলল, ফোস ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়বা না। বলো, কী ব্যাপার?
তৈয়ব শান্ত গলায় বলল, উনার মৃত্যুসংবাদ প্রচার করার আগে হাতিটা যে আমরা আগেই খরিদ করেছি এইটা প্রচার করা দরকার। তা না হলে সবেই ভাববে হাতির মালিক মারা গেছে আর আমরা হাতি মেরে দিয়েছি।
হারুন কিছু না বলে পরপর কয়েক দফা জিনের গ্লাসে চুমুক দিল। ম্যানেজারের প্রতি এই মুহূর্তে অত্যন্ত প্রসন্ন বোধ করছে হারুন। প্রসন্ন ভাবটা সে গোপন রাখবে কী রাখবে না বুঝতে পারছে না। বড় একটা দল চালাতে হলে অনেক কিছু ভাবতে হয়। বড় দল চালানোর কিছু কঠিন নিয়মকানুন আছে। একটা প্রধান নিয়ম হলো দলের কারো উপর খুশি হলে খুশি ভাব গোপন রাখতে হবে। যার উপর খুশি তাকে তা কখনো জানানো যাবে না।
তৈয়ব বলল, আমি যাই।
হারুন বলল, ঘটনা তো কিছুই শুনলাম না, যাই যাই করছ কেন?
হাতির অবস্থা ভালো না। পশু ডাক্তারের সন্ধানে যাব। সদরে একজন ভেটেনারি সার্জন আছে। তাকে নিয়ে আসব।
আচ্ছা যাও। একটা জিনিস শুধু খেয়াল রাখবা, আমি তোমার উপর বেজার। যে-কোনো সময় লাথি দিয়ে তোমাকে দল থেকে বের করে দিব। আমার এখানে কারো চাকরিই পার্মানেন্ট না। আমি যে কাউকে এক সেকেন্ডের নোটিশে দল থেকে বের করে দিতে পারি। নিজেকেও পারি। আমিই সার্কাস দলের মালিক। আমিই নিজেকে দল থেকে বের করে দিলাম। ভালো না?
জি ভালো।
জামদানী মেয়েটাকে আমার কাছে পাঠাও। হাতির বিষয়ে সে কী যেন কথা বলেছিল, কথাটা শুনি।
ওরা ঘুমায়ে পড়েছে।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে পাঠাও। দেশের যেমন বাদশা থাকে–সার্কাস দলেরও বাদশা থাকে। বাদশার হুকুম শুনতে হয়।
তৈয়ব বের হয়ে গেল। হারুন মাথায় ছোট্ট একটা চক্কর অনুভব করল। নেশা জমে গেছে। শরীর হালকা লাগছে। মনে ফুর্তির ভাব প্রবল হচ্ছে। এই সময়টা খারাপ। এখন যদি দুঃখের কোনো কথা মনে পড়ে তাহলে ফুর্তির বদলে মন ভরে যাবে দুঃখে। তখন টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকবে। নেশা খুব খারাপ জিনিস। শুরু হলো আনন্দের জন্যে, শেষ হলো দুঃখে। ভেউ ভেউ কান্না। চোখের পানি নাকের সর্দিতে মাখামাখি। সর্বশেষ ঘর ভাসিয়ে বমি। বমির উপর শুয়ে থাকা।
জামদানী ঘরে ঢুকল। সে কিছু বলার আগেই হারুন আনন্দিত গলায় বলল–কী খবর কী খবর কী খবর?
নেশা ভালোমতো ধরেছে। নেশার নিয়ম হলো ভালোমতো ধরলে সব বাক্য তিনবার চারবার করে বলা হয়। তারপরেও মনে হয় ঠিকমতো বলা হলো না। কিছু যেন বাকি থেকে গেল।
জামদানী বলল, কী জন্যে ডেকেছেন?
হারুন বলল, খুব জরুরি একটা কাজে ডেকেছি। জরুরি কাজটা কী ভুলে গেছি। দাঁড়ায়ে আছে কেন, বসো।
জামদানী বসল। হারুন আগ্রহ নিয়ে বলল, নেশা করলে কী হয় জানো? অল্প নেশা করলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে। নেশা একটু বেশি হয়ে গেলে স্মৃতিশক্তি ধুপ করে পড়ে যায়। আমারটা ধুপ করে পড়ে গেছে। ও আচ্ছা! মনে পড়েছে–তুমি বলেছিলে হাতির কী অসুখ হয়েছে তুমি জানো। সাপের অসুখের বিষয়ে যে জানে তাকে বলে সর্পরাজ। তোমার টাইটেল দিলাম হস্তিরানী। হা হা হা।
হারুন হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থায় চলে গেল। হাসি থেকে তার হেঁচকি উঠে গেল। হেঁচকির ফাঁকে ফাঁকে বলল, বলো দেখি হস্তিরানী, আমার হাতির অসুখটা কী?
জামদানী শান্ত গলায় বলল, হাতিটার সন্তান হবে, প্রসব ব্যথা উঠেছে।
হারুন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কী বললা?
জামদানী বলল, হাতিটার সন্তান হবে।
হারুন বলল, উল্টা পাল্টা কথা বলে তুমি আমার নেশা কাটায়ে দিয়েছ। অনেক কষ্টের নেশা, তৈরি করতে সময় লাগে। যাও, ঘুমাতে যাও। একটা কথা মনে আসল আর বলে ফেললা–এটা ঠিক না। তুমি হাতির লেডি ডাক্তার না। যাও আমার সামনে থেকে।
হারুন অনেকদিন পর মনের আনন্দে নেশা করল। জিনের পুরো বোতল শেষ করার পর লুকিয়ে রাখা ভদকার একটা বোতল বের করা হলো। একা একা মদ্যপান করা যায় না। এখন হারুনের সঙ্গী কালু। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কালুকে হারুনের বন্ধুর মতো লাগছে। সে যে বাবুর্চির অ্যাসিসটেন্ট, তার প্রধান কাজ চুলায় লাকড়ি দেয়া, খড়ি ফাড়া–এটা আর মনে হচ্ছে না। বরং হারুনের মনে হচ্ছে কালু যথেষ্ট জ্ঞানী একজন মানুষ। তার সঙ্গে সুখ দুঃখের কথা যেমন আলাপ করা যায় তেমনি জটিল সমস্যার সমাধানও চাওয়া যায়। হারুন কালুর পিঠে হাত রেখে বলল, জহির সাহেবের মৃত্যুতে বড় কষ্ট পেয়েছি। কালু বলল, কষ্ট পাওয়ার কথা। কতদিনের পুরনো চিনা জানা লোক।
হারুন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউ নাই, একটা লোক ফুট করে মরে গেল।
কালু বলল, এটা খারাপ না। দুঃখ করার কেউ নাই।
হারুন বলল, দুঃখ করার একেবারে কেউ না থাকাটাও ঠিক না। এক দুইজন থাকবে, মৃত্যুর পরে ভেউ ভেউ করে কাঁদবে।
কালু বলল, অবশ্যই।
হারুন বলল, আমারও তো জহির সাবের মতোই অবস্থা। তারও কেউ ছিল না। আমারও কেউ নাই। সেও ছিল হাতির মালিক। আমিও হাতির মালিক। এখন ইচ্ছা করতেছে ঘর-সংসার করি। বয়সটা হয়ে গেছে সমস্যা পাঁচপঞ্চাশ।
কালু বলল, পাঁচপঞ্চাশ কোনো বয়সই না।
হারুন বলল, জামদানীর মতো একটা মেয়ে পাওয়া গেলে ভালো হতো। খুবই ভালো একটা মেয়ে। মাথায় সামান্য গণ্ডগোল আছে। এটা থাকবেই। সব ভালো মানুষের মাথায় সামান্য গণ্ডগোল থাকে।
কালু বলল, অতি সত্য কথা। একমাত্র আপনাকে দেখলাম–অতি ভালোমানুষ কিন্তু মাথা পরিষ্কার। মাথায় কোনো গণ্ডগোল নাই।
মাথায় গণ্ডগোল নাই তোমাকে কে বলল! গণ্ডগোল অবশ্যই আছে। গণ্ডগোল না থাকলে নিজের মেয়ের মতো যাকে বড় করেছি তাকে বিয়ে করতে চাই। ছিঃ ছিঃ, ভাবতেও লজ্জা।
কালু বলল, আরেক গ্লাস খান, তাহলে লজ্জাটা কমে যাবে।
দাও, আরেক গ্লাস। আজ বমি না হওয়া পর্যন্ত খাব। যা থাকে কপালে।
হারুন তার কথা রাখল, বমি করে ঘর ভাসিয়ে না দেয়া পর্যন্ত ক্রমাগত খেয়ে গেল। রাত তিনটায় সে এবং কালু যখন নিজেদের বমির উপর অর্ধচেতন হয়ে পড়ে আছে তখন খবর এলো–হাতির একটা মেয়ে বাচ্চা হয়েছে। হারুন খবরটার গুরুত্ব কিছুই বুঝল না। মাথা তুলে খবরটা শুনে আবারো বমির উপর শুয়ে পড়ল।
তিনজনই বোরকা পরেছে
তিনজনই বোরকা পরেছে।
পয়সার খুব মজা লাগছে। সে সবাইকে দেখছে, তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে। এখন মনের আনন্দে ঘোরাফেরা করা যায়। কেউ বুঝবে না সে কে। তবে ইবাদত নগর ছছাট জায়গা। ছোট জায়গায় বোরকা পরা তিনজন হাঁটাহাঁটি করছে এটা চোখে পড়বেই। চোখে পড়লেও সমস্যা হবে না। কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করবে না, আপনারা কে? তারা যে সার্কাসের মেয়ে এটা কি বুঝবে? বুদ্ধি থাকলে বুঝবে।
জামদানী বলল, আমার দম বন্ধ লাগে।
পয়সা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। দমবন্ধ লাগার কথায় হাসির কিছু নেই। পয়সার সমস্যা হলো যখন তার মন ভালো থাকে তখন যে-কোনো কথায় সে হাসে। আজ তার মন ভালো। মন ভালো হবার প্রধান কারণ–হাতি তার বাচ্চার কাছে কাউকেই ঘেঁসতে দিচ্ছে না। শুধু পয়সার ব্যাপারে কিছু বলছে না। পুরো সার্কাসের দলে পয়সা একমাত্র মেয়ে যাকে হাতি তার বাচ্চার কাছে যেতে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, হাতিটার সঙ্গে পয়সার ঘনিষ্ঠতাই সবচে কম।
আসমানী বলল, পয়সা, হাসি বন্ধ কর। খামাখা হাসি।
পয়সা বলল, খামাখা হাসি না। জাম বুবুর দমবন্ধ এই জন্যে হাসি।
পয়সা জামদানীকে সংক্ষেপ করে ডাকে জাম বুবু। জামের সঙ্গে মিলিয়ে আসমানীকে ডাকে আম বুবু। সবকিছুর একটা নাম দিয়ে দেয়ার প্রবণতা পয়সার আছে। হাতির বাচ্চার নাম সে দিয়েছে এলং। জামদানীর সঙ্গে এই নাম নিয়ে কথা কাটাকাটিও হয়েছে। জামদানী বলেছে, এলং আবার কী নাম? বাচ্চাটা এত সুন্দর। সুন্দর একটা নাম দে। পয়সা মুখ বাঁকা করে বলেছে–সুন্দর নাম তুমি দাও। আমি এরে ডাকব এলং।
জামদানীর মেজাজ খারাপ হয়েছে, কারণ সে জানে যত সুন্দর নামই দেয়া হোক শেষপর্যন্ত পয়সার দেয়া নামই স্থায়ী হয়ে যাবে। এত সুন্দর একটা বাচ্চাকে সবাই এলং এলং ডাকবে। পয়সা যে নাম দেয় সেটাই শেষপর্যন্ত স্থায়ী হয়ে যায়। সার্কাস দলের ম্যানেজার তৈয়বের নাম সে দিয়েছে কুতুকুতু। দলের সবাই ম্যানেজারকে এখন আড়ালে কুতুকুতুই ডাকে। পাখিওয়ালা খসরুর নাম হয়েছে হাগারু।
বোরকা পরে তিনবোন কোথায় যাবে এখনো ঠিক করা হয় নি। খুব বেশিদূর যাবে এরকম মনে হয় না। এরা সার্কাসের তাঁবুর আশেপাশেই ঘোরাফেরা করবে। সার্কাস দলের মানুষদের এই নিয়ম। এক তাঁবুর নিচে দিনের পর দিন থাকার কারণে তাদের নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়। পুতো দল ছাড়া বের হয়ে এরা স্বস্তি বোধ করে না। যেখানেই যাক দৃষ্টিসীমার ভেতর সার্কাসের তাঁবু থাকতে হবে।
আসমানী বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়। চল এলং-কে দেখে তারপর যাই। একটা মজা করব।
জামদানী বলল, কী মজা?
আসমানী বলল, এখন তো আমরা বোরকা পরা। মুখের পর্দা ফেলে দিলে হাতি দেখতে পারবে না কে কোন জন। দেখি তারপরেও সে পয়সাকে চিনতে পারে কি-না।
পয়সা বলল, পারবে।
জামদানী বলল, পারবে না, একশ টাকা বাজি।
পয়সা বলল, পঞ্চাশ টাকা বাজি।
জামদানী বলল, পঞ্চাশ টাকা না, একশ টাকা। সাহস থাকলে একশ টাকা বাজি ধর।
আমার কাছে একশ টাকা নাই। আমার কাছে যা আছে আমি সেটাই তো বাজিতে ধরব।
আচ্ছা যা, পঞ্চাশ টাকাই বাজি।
তাহলে আম বুবুর কাছে পঞ্চাশ টাকা জমা রাখ।
জমা রাখার দরকার কী?
পয়সা বলল, আমি একবার তোমার কাছে বিশ টাকা জিতেছিলাম, তুমি আমাকে সেই টাকা দাও নাই।
এইবার তুই যদি বাজিতে জিতিস তাহলে ঐ বিশ টাকাও দিয়ে দেব। আর যদি হারিস তাহলে কোনোদিনও ঐ বিশ টাকার কথা তুলতে পারবি না।
আচ্ছা যাও তুলব না।
জামদানী বাজিতে হেরে গেল। হাতি আসমানী জামদানী কাউকেই কাছে। আসতে দিচ্ছে না অথচ পয়সাকে কিছুই বলছে না। পয়সা তীক্ষ গলায় ডাকল–এলং, ঐ এলং। হাতির বাচ্চা হাতির চারপায়ের মাঝখানে লুকিয়ে আছে। সেখান থেকে শুড় বের করে পয়সাকে ছুঁয়ে দিল। পয়সা হেসে ভেঙে পড়েছে। পয়সার সঙ্গে সঙ্গে দুবোনও হাসছে।
তিনজনের হাসির শব্দ হারুন সরকারের মাথায় তীরের ফলার মতো বিধছে। সে চিৎকার করে বলল, হাসি বন্ধ। যদিও সে চিৎকার করছে কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনোই আওয়াজ বের হলো না। তার অবস্থা খুবই খারাপ। যন্ত্রণায় মাথা ছিড়ে পড়ে যাচ্ছে। রাতে সে বমির উপর পড়েছিল। এখন বমি নেই। কালু সব পরিষ্কার করেছে। ভেজা গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে দিয়েছে। এখনো হারুন সরকারের মাথায় ভেজা গামছা। শীতে শরীর কাঁপছে। জ্বর আসার লক্ষণ।
এই অবস্থায় মাথায় ভেজা গামছা রাখা ঠিক না। ভেজা গামছার কারণে মাথার যন্ত্রণাটা সামান্য কম লাগে বলে গামছা সরানো যাচ্ছে না। গায়ে চাদর দিয়ে দিলে শীতের কাঁপুনি বন্ধ হতো। দিয়ে দিবে কে? কালু গেছে ডাক্তার আনতে। হারুন সরকার চাপা গলায় ডাকল, কালু, কালু! সে জানে কালু আশেপাশে নেই। তারপরেও তাকে ডাকার কারণ গলার স্বর ফিরে এসেছে কিনা তা পরীক্ষা করা। গলার স্বর ফিরে নি। ফ্যাসফাস আওয়াজ বের হচ্ছে। কেউ যে তাকে দেখতে আসবে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। যখন-তখন তার ঘরে ঢোকা নিষেধ আছে।
মেয়ে তিনটা এখনো হাসছে। হাতির বাচ্চা দেখে হাসছে এটা বোঝা যাচ্ছে। বাচ্চাটা এখনো দেখা হলো না। সবাই দেখেছে অথচ হাতির মালিক সে-ই দেখে নি– এটা বিরাট একটা আফসোসের ব্যাপার। হাতির বাচ্চা এবং হাতির মা এই দুজনকে নিয়ে কোনো একটা খেলা বের করতে হবে। বল ছোড়াছুড়ি খেলা। মা-হাতি একটা বল ছুড়ে মারল তার বাচ্চার দিকে, বাচ্চা সেই বল ফেরত পাঠাল। লাল রঙের বিরাট একটা বল লাগবে। সেই বল খুব ভারী হলেও হবে না। আবার হালকা হলেও হবে না। হাতি অতি বুদ্ধিমান প্রাণী, যেকোনো খেলা সে অতি দ্রুত শিখে ফেলে। কেউ কেউ আবার নিজে নিজেও খেলা বের করে।
হারুন সরকার কল্পনায় দেখছে–হাতি এবং হাতির বাচ্চা লাল বল ছোড়াছুড়ির খেলা খেলছে। এই কল্পনা করাটা ঠিক হয় নি। কড়া লাল রঙ এখন মাথার ভেতর ঢুকে দপদপ করছে। হারুন সরকার কল্পনায় বলের রঙ লাল থেকে নীল করল। তাতে লাভ হলো না। রঙ বদলাল না। বরং আরো গাঢ় হলো। মাথার উপর রাখা ভেজা গামছা শুকিয়ে গেছে। আবারো ভিজিয়ে মাথার উপর দেয়া দরকার। কে দেবে? কালু হারামজাদা সেই যে গিয়েছে আর আসার নাম নেই। ডাক্তার আনতে হিন্দুস্থান চলে গেছে কি-না কে জানে। একটা শান্তি হয়েছে। মেয়ে তিনটার হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে না। কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে না। হারুন সরকার আবার ডাকল, কালু, কালু! কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। আগে ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ হতো। এখন সে আওয়াজও নেই। মৃত্যুর আগে আগে মানুষের জবান বন্ধ হয়। তারও কি জবান বন্ধ হয়ে গেছে! সে মারা যাচ্ছে না তো? সে দুরুদে শেফা পড়ার চেষ্টা করল। শেফা’ শব্দের অর্থ আরোগ্য। এই দুরুদ পাঠে রোগমুক্তি ঘটে।
দুরুদটা হারুন সরকারের জানা আছে। এখন মনে আসছে না। প্রথম শব্দটা মনে হলেই বাকি সবটা মনে হবে। প্রথম শব্দটাই মনে পড়ছে না। আল্লাহুম্মা দিয়ে কি শুরু হয়েছে? আল্লাহুম্মার পরে কী? সাল্লিআলা?
তিন কন্যা চলে এসেছে মনু নদীর পাড়ে। সেখানে বিরাট কর্মযজ্ঞ। একই সঙ্গে নদী শাসন হচ্ছে। বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ড শুভেচ্ছা সেতুর জন্যে পাইলিং করা হচ্ছে। নদীর চরে গােটা পঁচিশেক নানান আকৃতির নানান বর্ণের তাঁবু। মাটিকাটা শ্রমিকদের জন্যে লম্বা টিনশেডঝকঝকে নতুন টিনে আলো ঝলমল করছে। কয়েকটা দৈত্যাকৃতি ক্রেন। ক্রেন চলাচল করে রেললাইনের উপর দিয়ে। ওয়ার্কশপ থেকে নদীর পাড় পর্যন্ত রেললাইন বসানো হয়েছে। বিপুল কর্মকাণ্ড দেখতে ভালো লাগে। দূর দূরান্ত থেকে শুধুমাত্র ব্রিজ বানানো দেখার জন্যে লোকজন আসছে।
পয়সা মুগ্ধ গলায় বলল, কী অবস্থা! জাম বুবু দেখ দেখ, রেললাইন বসায়ে ফেলেছে। রেললাইনের উপরে এইগুলান কী?
জামদানী বলল, আমি কি জানি? তুই যতটুক জানিস, আমি ততটুকই জানি।
ধুরুম ধারুম শব্দ কীসের?
জানি না।
জাম বুবু দেখ, চায়ের দোকান বসেছে। বুবু আস, চা খাই।
তারা খুব আনন্দ করে চা খেল। পয়সা বলল, চল একটা নৌকা ভাড়া করে যেখানে পিলার বসাচ্ছে ঐখানে যাই।
আসমানী বলল, কোনো দরকার নাই।
পয়সা বলল, দরকার আছে।
আসমানী বলল, কী দরকার?
আমার কাছে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। এইটাই দরকার। বুবু, স্পিড বোটগুলো দেখেছ কত সুন্দর! সুন্দর না?
জামদানী বলল, হুঁ সুন্দর।
পয়সা বলল, দেখে মনে হচ্ছে বিরাট মজার সার্কাস।
আসমানী বলল, উল্টা-পাল্টা কথা বলিস না তো পয়সা। সার্কাস আর ব্রিজ তৈরি এক জিনিস?
আমার কাছে এক জিনিস। চল নৌকা ভাড়া করি।
আসমানী বলল, না।
পয়সা বলল, তোমরা না গেলে আমি একা যাব।
সাহস থাকলে যা একা।
তোমরা কি ভেবেছ আমার সাহস নেই? তোমাদের ছাড়া একা যেতে পারব না? আমি কিন্তু যেতে পারব।
জামদানী বলল, পঞ্চাশ টাকা বাজি, যেতে পারবি না।
পয়সা গটগট করে এগোচ্ছে। একবারও পেছনের দিকে তাকাচ্ছে না। জামদানী ভীত গলায় বলল, বুবু, ও সত্যি সত্যি চলে যাবে না তো?
আসমানী বলল, না, ও নদীর পাড় পর্যন্ত যাবে। নৌকার মাঝিদের সঙ্গে কথা বলবে। ভাব করবে যেন সত্যি সত্যি নৌকায় উঠছে।
যদি সত্যি সত্যি যায়?
গেলে যাবে। একা একা নৌকা নিয়ে নদীর মাঝখান পর্যন্ত যাওয়ার সাহস থাকা তো ভালোই।
জামদানী বলল, চল আমরাও যাই।
না।
আমরা কী করব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকব?
হুঁ। আয় এক কাজ করি, চায়ের দোকানটার আড়ালে চলে যাই। যেন পয়সা আমাদের না দেখতে পায়। যেন ভাবে আমরা তাকে ফেলে চলে গেছি।
দুই বোন চায়ের দোকানের আড়ালে চলে গেল।
পয়সার খুব ইচ্ছা করছে পেছনে তাকিয়ে দেখতে তার দুই বোন কী করছে, কিন্তু সে তাকাচ্ছে না। সে ঠিক করে ফেলেছে নৌকা ভাড়া পাওয়া গেলে মাঝ নদী পর্যন্ত যাবে। তার দুই বোন ভয়ে আধমরা হয়ে যাবে। মোটামুটি মজার একটা ব্যাপার। তারা তিন বোন দড়ির উপর ভয়ঙ্কর খেলা দেখায়। তখন তাদের খুব সাহসী মনে হয়। আসলে তারা তিনজনই খুব ভীতু। এক খাট ছাড়া তিনজন ঘুমোতে পারে না। সেই ঘুম নিয়েও সমস্যা–মাঝখানে কে শোবে? যারা দুই পাশে শোয় তাদের সারাক্ষণ ভূতের ভয় করে। এই বুঝি খাটের নিচ থেকে মরা মানুষের হাত ছুঁয়ে দিল।
তিনজনের কেউই সাঁতার জানে না, কাজেই পানিকেও খুব ভয়। নৌকায় উঠলেই তাদের মনে হয় এই বুঝি বড় একটা ঢেউ এসে নৌকা কাত করে দিল। সেখানে একা একা মাঝ নদী পর্যন্ত যাওয়াটা খুব সাহসী কাজ। অনেকদিন থেকেই পয়সার ইচ্ছা সে সাহসী কোনো কাজ করে। সুযোগটা পাওয়া গেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
পাড় থেকে মাঝ নদী পর্যন্ত যাবার নৌকা পাওয়া যাচ্ছে। ভাড়াও বেশি না। রিজার্ভ নৌকায় গেলে বিশ টাকা ভাড়া। দলের সঙ্গে গেলে দু টাকা। খেয়াপারানি নৌকাও আছে। তার ভাড়া এক টাকা। এপাড় থেকে ওপাড়ে গেলে মাঝনদীতে ব্রিজ বানানোর কর্মকাণ্ড দেখা যায়।
একটা সমস্যা অবশ্যি আছে। মাঝে মাঝে স্পিডবোট অতি দ্রুত আসা যাওয়া করছে। তখন বিরাট ঢেউ উঠছে। ছোট ছোট নৌকাগুলি এমনভাবে দুলছে দেখে মনে হয় এই বুঝি ডুবে গেল।
দেশী নৌকার ঘাট ছেড়ে পয়সা এখন এগোচ্ছে স্পিডবোটগুলির দিকে। কাছ থেকে দেখবে এই তার পরিকল্পনা। পয়সা ঠিক করে রেখেছে স্পিডবোটগুলির কাছে গিয়ে সে একবার পেছন দিকে তাকাবে।
হ্যালো মিস!
পয়সা ভয়ঙ্কর চমকে গেল। বিদেশী এক সাহেব পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ এত নীল যে মনে হচ্ছে নীল রঙ চোখ থেকে গড়িয়ে এখনি নিচে পড়ে যাবে।
সাহেব পরিষ্কার বাংলায় বলল, সার্কাসে আপনার দড়ির খেলা মনোহর হয়েছে।
আশ্চর্য, বোরকা পরা অবস্থায় এই সাহেব তাকে চিনল কীভাবে? সাহেবও কি হাতির মতো? পয়সা বোরকার পর্দা সরিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল–আপনি কী করে আমাকে চিনলেন?
তিনটা বোরকা পরা মেয়ে হাঁটে। দূর থেকে দেখে চিনেছি।
আপনি এত সুন্দর বাংলা কার কাছে শিখেছেন?
আমি তিন বছর এই দেশে আছি। আমি সবার সঙ্গে খুব বেশি কথা বলি। এই জন্যে সুন্দর বাংলা বলি। আমি গ্রাম্য বাংলাও বলতে পারি।
বলুন তো শুনি।
ভাত খাইচুইন–এর অর্থ ভাত খেয়েছেন? ময়মনসিংহের ভাষা।
আপনি এখানে কী করেন?
আমি নদী শাসন করি।
নদী কি দুষ্ট ছেলে যে নদী শাসন করবেন?
নদী দুষ্ট ছেলে না। নদী দুষ্ট মেয়ে। বড়ই খেয়ালি। তাকে সব সময় শাসনে রাখতে হয়।
কীভাবে শাসন করেন। বেত দিয়ে মারেন? না-কি ধমক দেন?
সাহেব হাসছে। হাসির শব্দ এতই জোরালো যে অনেক দূরের লোকজনও মাথা ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। পয়সা খুবই মজা পাচ্ছে। একজন সাহেবের সঙ্গে কথা বলছে–মজাটা এই জন্যে না, মজা লাগছে এই কারণে যে তার দুই বোন দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে নিশ্চয়ই চমকাচ্ছে। ভয়ে অস্থির হচ্ছে। তারা আরো বেশি ঘাবড়ে যাবে যদি সে এই সাহেবের সঙ্গে স্পিডবোটে করে একটা চক্কর দিয়ে আসে।
আমার নাম নি পোর্টার।
বলেই সাহেব হাত বাড়াল। হাত যে হ্যান্ডশেক করার জন্যে বাড়ানো হয়েছে এটা বুঝতে পয়সার কিছুক্ষণ সময় লাগল। ছেলেরা ছেলেরা হ্যান্ডশেক করে কিন্তু ছেলে এবং মেয়েও কি হ্যান্ডশেক করে? পয়সা খুবই অস্বস্তি এবং লজ্জার সঙ্গে হাত বাড়াল। অস্বস্তির সঙ্গে মজার ভাবটাও তার মধ্যে আছে। দেখুক তার দুই বোন। দেখে আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাক।
তোমার নাম কী?
আমার নাম পয়সা।
পয়সা মানে কী?
আপনি এত সুন্দর বাংলা জানেন, পয়সার অর্থ জানেন না?
না।
না জানলে অন্যকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবেন, আমি বলব না।
আচ্ছা আমি জেনে নেব। তুমি কি নদীর মাঝখানে যে পাইলিং হচ্ছে সেটা দেখতে যাবে? স্পিডবোটে করে একটা চক্কর দিয়ে আনব?
হ্যাঁ যাব।
তোমার দুই বোনও কি যাবে? আমার ধারণা স্পিডবোটে করে গেলে ওরাও খুব মজা পাবে।
ওরা যাবে কি-না জানি না। গেলেও অন্যদিন যাবে। আজ আমি একা যাব।
নি পোর্টার খুশি খুশি গলায় বলল, এ দেশের মেয়েরা অপরিচিত পুরুষ মানুষের সঙ্গে এত কথা বলে না। তুমি যে বলছো তাতে আমি অবাক হয়েছি।
পয়সা বলল, আমি সার্কাসের মেয়ে। সার্কাসের মেয়েরা অনেক কিছু পারে যা অন্যরা পারে না।
আসমানী এবং জামদানী অবাক হয়ে দেখল তাদের সবচে ছোট বোন লালমুখ এক বিদেশীর সঙ্গে গটগট করে স্পিডবোটে গিয়ে উঠল। স্পিডবোট চলে যাচ্ছে মাঝনদীতে। লাল মুখটাই স্পিডবোট চালাচ্ছে। সে নানান রকম কায়দা-কানুন করছে। স্পিডবোটকে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। ডানে নিচ্ছে বায়ে নিচ্ছে।
জামদানী ফিসফিস করে বলল, এইসব কী হচ্ছে?
আসমানী জবাব দিল না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এক্ষুণি ফেরা দরকার। মাগরেবের পরে পরেই শো শুরু হবে। শো শুরু হবার আগেই যদি তিন বোন উপস্থিত না থাকে তাহলে হুলস্থূল হয়ে যাবে।
স্বাধীন বাংলা সার্কাস পার্টির জন্যে আজ মহা শুভ দিন। সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। লাইনে এখনো অনেকে আছে। এদের ঢুকাতে হলে আলাদা করে চাটাই বিছাতে হবে। বিশিষ্ট দ্রলোকেরাও এসেছেন। এসডিও সাহেবের ছেলেমেয়েরা এসেছে। সিও রেভি তাঁর স্ত্রী এবং দুই শালিকে নিয়ে এসেছেন। থানার ওসি সাহেবের স্ত্রী তার কয়েকজন বান্ধবী নিয়ে এসেছেন। এরা সবাই পাস নিয়ে সার্কাস দেখবেন। সবচে ভাললা চেয়ারগুলিতে বসবেন। খেলার মাঝখানে তাদের ঠাণ্ডা কোক-ফান্টা খাওয়াতে হবে। তারপরেও এই ধরনের মানুষ যত আসে তত ভালো, সার্কাসের নাম ফাটে।
শো শুরুর টাইম হয়ে গেছে। তুমুল শব্দে বাদ্য বাজনা বাজছে। বাজনার শব্দ সরাসরি হারুন সরকারের মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার কাছে মনে হচ্ছে মাথা ছিড়ে পড়ে যাবে।
কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার দেখে গেছেন। ডাক্তার শুকনা গলায় বলেছেনহাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। মনে হয় রেসপিরেটরি ট্রাকে ইনফেকশন। সোজা বাংলায় নিউমোনিয়া।
হারুন সরকার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আমি হাসপাতালে যাব না। ওষুধপত্র যা দেওয়ার দেন। গলায় প্রচণ্ড ব্যথা। গলার ব্যথাটা কমান।
গলায় ব্যথা সকালে ছিল না। সকালে গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিকালের পর থেকে গলায় আওয়াজ ফিরে এসেছে। কিন্তু ব্যথা প্রচণ্ড। হারুন সরকারের ধারণা মাথার যন্ত্রণাটাই নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। এখন এসেছে গলায় গলা থেকে নামবে বুকে। বুক থেকে পেটে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, নিউ জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিলাম। ইনশাল্লাহ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফল পাবেন।
হারুন সরকার বলল, আমি চব্বিশ ঘণ্টা বাঁচব না। তার আগেই ঘটনা ঘটে যাবে।
এটা হারুন সরকারের কথার কথা না। সন্ধ্যার পর থেকে তার এরকম মনে হচ্ছে।
শো শুরু হয়ে গেছে। হারুন সরকার একা শুয়ে আছে। শো-র সময় সবাইকে শো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। রোগীর পাশে বসে থাকার মতো বাড়তি কেউ তখন থাকে না।
হারুন সরকারের খুবই একা লাগছে এবং ভয় ভয় করছে। ভয়ের কারণ অতি বিচিত্র। তার কাছে মনে হচ্ছে খাটের নিচে কেউ একজন হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। যে বসে আছে সে মানুষের মতো হলেও মানুষ না। তার গা-ভর্তি ললাম। হাতের আঙুল পাঁচটা না। শুয়োপোকার পায়ের মতো অসংখ্য আঙুল। শুয়োপোকার পা যেমন কিলবিল করে, তার আঙুলগুলিও কিলবিল করছে। লোকটা ঘাপটি মেরে বসে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। সে হারুন সরকারকে তার কিলবিল আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেবে। কাজটা সে কখন করবে তা-ও হারুন সরকার জানে, যখন ঘরে কেউ থাকবে না এবং যখন হারুন সরকার চোখ বন্ধ করে থাকবে। এই ভয়েই হারুন সরকার চোখ বন্ধ করতে পারছে না। যদিও তাকিয়ে থাকতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। হারুন সরকার হতাশ গলায় ডাকল, তৈয়ব, তৈয়ব!
তৈয়ব স্টেজের মাঝখানে। সে তার ঘোড়া নিয়ে নানাবিদ রসিকতা করছে। দর্শকরা হেসে এ ওর গায়ে গড়াগড়ি করছে। তৈয়ব আজ নতুন একটা আইটেম চেষ্টা করছে। ঘোড়ার ঠোটে লিপস্টিক দেয়া। ঘোড়ার ভেজা ঠোঁটে লিপস্টিক বসছে না এটাই সমস্যা। লিপস্টিক বসলে আরো মজা হতো। তৈয়ব ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরে গাঢ় স্বরে বলছে–ওগো রাগ করে থেকো না গো! তোমার জন্যে ছুনু এনেছি, পাউডার এনেছি, লিপস্টিক এনেছি। আমার দিকে তাকায়ে একটু হাস। লক্ষ্মী সোনামনি।
ঘোড়া ঘোৎ করে একটা শব্দ করল। তাঁবুর সমস্ত লোক একসঙ্গে হেসে উঠল।
পয়সা সাজঘরে কাপড় বদলাচ্ছে। তাদের ডাক আসতে এখনো অনেক। দেরি। এত আগে কাপড় পরে বসে থাকতে তার ভালো লাগে না। আজ বাধ্য হয়ে পরছে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা। কারণ নদীর ঘাট থেকে ফেরার পর তার দুই বোন তার সঙ্গে কথা বলছে না। কোনো কথাই বলছে না। কথা না বলার মতো বড় কোনো অপরাধ তো সে করে নি। একজন বিদেশীর সঙ্গে স্পিডবোটে করে নদীতে কয়েকটা চক্কর দিয়েছে।
পয়সা পায়ে ফেট্টি বাঁধতে বাঁধতে বলল, তৈয়ব চাচাকে দেখে মনেই হয় তিনি এত মজা করতে পারেন। কী গম্ভীর মানুষ! দেখলেই ভয় লাগে। তাই জাম বুবু?
জামদানী উত্তর দিল না। খানিকটা ঘুরেও বসল, যেন পয়সা তার চোখে চোখ না রাখতে পারে।
পয়সা বলল, তোমরা কেন আমার উপর রাগ করেছ আমি কি জানতে পারি?
আসমানী এবং জামদানী এই প্রশ্নের জবাব দিল না। আসমানী বিরক্ত চোখে তাকাল।
পয়সা বলল, তোমরা আমার সঙ্গে কথা না বললে আমার কিছু যায় আসে না।
আসমানী বলল, কেন যায় আসে না? তুই কি কথা বলার লোক খুঁজে পেয়েছিস?
পয়সা বলল, হ্যাঁ পেয়েছি।
আসমানী বলল, লালমুখ বান্দরটাকে পেয়েছিস?
পয়সা বলল, হ্যাঁ আমি সার্কাসের মেয়ে। আমার জন্যে বান্দরই ভালো। আমি আগামীকাল আবার তাঁর সঙ্গে গল্প করতে যাব।
জামদানী বলল, তোকে দাওয়াত দিয়েছে?
হ্যাঁ।
কোথায়, তাঁবুতে?
হ্যাঁ, তাঁবুতে। উনার সঙ্গে চা খাব। কফি খাব। উনি যদি হাত ধরতে চান–হাত ধরাধরি করব।
জামদানী বলল, হাত ধরাধরি করবি?
হ্যাঁ করব।
আসমানী শান্ত ভঙ্গিতে বোনের কাছে উঠে এলো। প্রচণ্ড শব্দে বোনের গালে চড় বসিয়ে দিল।
পয়সা চড় খাবার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সে টুলের উপর থেকে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ে গেল। সে অবাক হয়েছে। তার বড়বোন তার গায়ে হাত তুলতে পারে এটা সে কোনোদিনও ভাবে নি। মেঝে থেকে উঠে সে আগের জায়গায় বসল। পায়ে ফেট্টি বাধা শেষ করল এবং মনে মনে ঠিক করল আগামীকাল সে অবশ্যই ‘মিস্টার পটর পটর’-এর কাছে যাবে। চা খাবে। কফি খাবে। মিস্টার পটর পটর যদি তার হাত ধরতে চায় সে হাত বাড়িয়ে দেবে। তার হাত এমন কোনো পবিত্র হাত না যে কেউ ধরতে পারবে না।
তিন বোনের ডাক পড়েছে। সার্কাসের শেষ দশ মিনিট। এই দশ মিনিট সবাই যেন দমবন্ধ করে বসে থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। যার শেষ ভালো তার সব ভালো। মানুষ শুরুটা কখনো মনে রাখে না। শেষটা মনে রাখে।
দড়ির উপর উঠেই পয়সা ঠিক করল সে যে রাগ করেছে এটা সে দু’ বোনকে বুঝিয়ে দেবে। দুই বোন দড়িতে পা দিয়েই বুঝবে ছােটজন রেগে আছে। পয়সা দড়িতে পা ফেলবে অন্যভাবে। দড়ির যেভাবে কাঁপার কথা সেই। ভাবে কাঁপবে না। অন্যভাবে কাঁপবে। দড়ির এই বিশেষ কম্পন অন্য কেউ বুঝতে পারবে না, যারা দড়ির উপর আছে তারা বুঝবে।
দড়িতে পা দিয়েই জামদানীর মুখ শুকিয়ে গেল। সে তাকাল আসমানীর দিকে। দড়ির খেলায় তিন বোনের ভেতর জামদানী সবচে’ দুর্বল। দড়ির কম্পনের একটু উনিশ বিশ হলেই সে নার্ভাস হয়ে পড়ে। আসমানী পয়সার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করল। চোখের অনুরােধ। পয়সা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে দু হাত তুলে একটা চক্কর দিয়ে দড়ির দুলুনি ঠিক করে ফেলল। জামদানীর পা কাঁপছিল। তার পা কাঁপা ঠিক হয়ে গেল।
তালিতে তাঁবু ফেটে পড়ছে। আজকের দড়ির খেলা অন্য অনেক দিনের খেলার চেয়েও ভালো হয়েছে। মুহাম্মদ বশির মােল্লা নামের এক মাছের ব্যবসায়ী পয়সার নামে একটা স্বর্ণপদক এবং এক হাজার টাকা পুরস্কার ঘােষণা করেছেন। এই পদক আগামীকাল দেয়া হবে। তালি তালি আবারাে তালি। এই তালি মুহম্মদ বশির মােল্লা নামের মানুষটার জন্যে।
বশির মােল্লাকে মঞ্চে নিয়ে আসা হয়েছে। লুঙ্গি ফতুয়া পরা থলথলে একজন মানুষ। মুখভর্তি পান। পানের রস গড়িয়ে পড়ছে। বশির মােল্লা ফতুয়ায় সেই রস মুছে ফেলছে। পানখাওয়া লাল দাঁত বের করে সে দর্শকদের দিকে হাত নাড়ল। পয়সা বলল-হাদু! বাড়িতে যা। আসমানী এবং জামদানী দু’জনই মুখ কঠিন করে রেখেছে। পয়সার কোনো কথায় তারা হাসবে না। দু’জনেরই হাসি পাচ্ছে। তারা হাসি চেপে রেখেছে। পয়সা বলল, জাম বুবু দেখ কাণ্ড! হাঁদু বাবা হাসছে আর তার ভুঁড়ি কাঁপছে। এমন ভুঁড়ি কাঁপানি হাসি এর আগে দেখেছ?
জামদানী হেসে ফেলল। হাসি ছোঁয়াচে রোগ। জামদানীর সঙ্গে সঙ্গে আসমানীও হাসছে।
হারুন সরকারের সামনে শুকনা মুখে তৈয়ব দাঁড়িয়ে আছে। হারুন সরকারের মনে হচ্ছে খুব জরুরি একটা কথা তৈয়বকে বলা দরকার। জরুরি কথাটা কী সেটাই এখন মনে পড়ছে না। হারুন সরকার খুবই হতাশ বোধ করছে। অথচ কথাটা জরুরি, এখনই বলা দরকার।
তৈয়ব বলল, আপনার অবস্থা তো ভালো না।
কে কী বলছে তা হারুন সরকারের মাথায় ঢুকছে না। সে জরুরি কথাটা মনে করার চেষ্টা করছে। তার ব্যথা আরো বেড়েছে। ঘাড় থেকে ব্যথা নেমে এসেছে বুকে। বুকে চাপ ভাব হচ্ছে। নিঃশ্বাসেও কষ্ট হচ্ছে।
তৈয়ব বলল, আপনাকে তো হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার।
হাসপাতালে যাব না।
এখানে পড়ে থাকলে আপনি মারা যাবেন।
হাসপাতালে গেলেও মারা যাব।
এখানে ভালো হাসপাতাল আছে। আমি খোজ নিয়েছি। মিশনারি হাসপাতাল। চিকিৎসা ভালো।
কথাটা মনে পড়েছে। হারুন কথাটা বলতে যাবে তখনই প্রচণ্ড কাশি শুরু হলো। কাশি যখন শেষ হলো তখন আর কথাটা মনে নেই।
হারুন সরকারকে মিশনারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলো রাত দশটায়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কথাটা তার পুরোপুরি মনে পড়েছে। হাতির বাচ্চাটা তার দেখা হয় নি। তৈয়বকে সে বলতে চেয়েছিল–বাচ্চাটা ঘরে নিয়ে আস, একবার দেখি। এখন আর এইসব কথা মনে করে লাভ নেই। হাসপাতালে হারুন একা। বারান্দায় কালু হাঁটাহাঁটি করছে। কালুকে হাতির কথা বলা অর্থহীন। সে নিশ্চয়ই হাতির বাচ্চাটা হাসপাতালে নিয়ে আসবে না।
মনু নদীর তীরে
মনু নদীর তীরে মাঝারি আকৃতির একটা লঞ্চ বাঁধা আছে। লঞ্চের নাম এমভি সওদাগর।
অন্য লঞ্চগুলির সঙ্গে এই লঞ্চের কিছু অমিল আছে। এর ডেকে সস্তা ধরনের কিছু সোফা বিছানো। সোফাগুলি নোংরা পলিথিন দিয়ে ঢাকা। লঞ্চের ছাদেও সোফা বিছানো। সোফার সঙ্গে বিশাল আকৃতির দুটি কোলবালিশসহ জাজিম বিছানো। হলুদ রঙের ত্রিপল দিয়ে সোফা জাজিম সবই ঢাকা। লঞ্চের জানালাগুলি কটকটে সবুজ রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা। সারেং-এর জানালার ঠিক নিচে ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা প্রাইভেট। ইংরেজি বানানটা ভুল। সেখানে লেখা–PRIVAT।
লঞ্চ মালিকের নাম বশির মোল্লা। এটা তার লাইনের লঞ্চ। তার যখন ফুর্তি করার ইচ্ছা হয় তখন তিনি লাইনের একটা লঞ্চে প্রাইভেট সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দলবল নিয়ে বের হয়ে পড়েন। দ্রলোকের বয়স পাঁচপঞ্চাশ। জীবনের বড় একটা অংশ ফুর্তিতে কাটিয়েছেন। চেহারায় ফুর্তির স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে।
ইবাদত নগরে তিনি এসেছিলেন মনু নদীর ব্রিজ বানানো দেখতে। লোকমুখে শুনেছিলেন দেখার মতো দৃশ্য। বিরাট হুলস্থূল। স্বচক্ষে দেখে তিনি মর্মাহত। নদীতে পাইলিং করা হচ্ছে। ধুমধাম ধুপুস ধাপুস শব্দ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মাথা ধরে গেল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন–শুয়োরের বাচ্চারা কী শুরু করেছে? তার নির্দেশে লঞ্চ অতি দ্রুত সরিয়ে এমন জায়গায় নেয়া হলো যেখানে শব্দ আসে না। সেটা আরেক যন্ত্রণা। লোকালয়ের বাইরের এক জায়গা। গাছগাছালিতে ভরা নদীর পাড়। রাজ্যের পাখি গাছে গাছে কিচমিচ করছে। এদের ক্যাচক্যাচানি পাইলিং-এর শব্দের মতোই যন্ত্রণাদায়ক। পাখিদের ক্যাচক্যাচানি বন্ধ করার জন্যে তাঁর নির্দেশে কয়েকবার ফাঁকা ফায়ার করা হয়েছে।
বশির মোল্লার লাইসেন্স করা দুটি বন্দুক আছে। একটা বিলাতি উইন্ডসর কোম্পানির। আরেকটা জার্মানির দুনলা বন্দুক। বিনা লাইসেন্সের একটা পিস্তলও আছে। পিস্তলটা থাকে তাঁর বালিশের নিচে।
ইবাদত নগরে এসে তিনি ভয়ঙ্কর বিরক্ত হয়েছিলেন। সার্কাস দেখার পর বিরক্তি পুরোপুরি চলে গেছে। সার্কাসের তিনটি মেয়েকেই তার পছন্দ হয়েছে। সবচে বেশি পছন্দ হয়েছে ছোটটিকে। মেয়েটির বিষয়ে কী করা যায় সেটা ঠিক করার জন্যে তিনি সার্কাস কোম্পানির ম্যানেজারকে খবর পাঠিয়েছেন। ম্যানেজার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। এটা ভালো লক্ষণ। বশির মোল্লা মোটামুটি নিশ্চিত যে ধানাই-পানাই করে বেশি সময় নষ্ট করতে হবে না। অল্প সময়েই কার্যোদ্ধার হবে। তিনি জীবনে নানান ধরনের মেয়ের সঙ্গে ফুর্তি-ফার্তা করেছেন। সার্কাসের কোনো মেয়ের সঙ্গে করা হয় নাই। দড়ির উপর যে মেয়ে নাচানাচি করে সে আর দশটা মেয়ের মতো হবে না এটা নিশ্চিত। ফুর্তির নতুন বিষয় মাথায় আসার পর থেকে বশির মোল্লার ভালো লাগছে। পাখির ক্যাচক্যাচানিও এখন আর তত খারাপ লাগছে না। সার্কাস বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটা চিন্তা তাঁর মাথায় চলে এসেছে। তিনি তাঁর শরীরে উত্তেজনা অনুভব করছেন।
আপনে সার্কাসের ম্যানেজার?
জি।
ঘোড়া নিয়া রঙ তামাশা আপনে করেন?
জি।
সত্য সত্যই কি ঘোড়াকে বিবাহ করেছেন? আপনার শরীর থেকে ঘোড়ার গন্ধ আসতেছে। রাগ করেছেন না-কি? আমিও একটু রঙ তামাশা করলাম।
আপনি আমাকে কী জন্যে খবর দিয়ে এনেছেন বললে ভালো হয়।
বলব, এত ব্যস্ত কেন?
আমার মালিক অসুস্থ, উনারে দেখতে যাব।
আপনি তো ডাক্তার না। আপনার দেখা না-দেখা সমান। আপনার নাম কী?
তৈয়ব আলী।
ও আচ্ছা, আপনি মুসলমান? আপনার হিন্দু হিন্দু চেহারা। আপনি মনে হয় গো-মাংস খান না। যারা গো-মাংস খায় না তাদের চেহারার মধ্যে হিন্দু হিন্দু ভাব চলে আসে। আপনি গো-মাংস খান?
খাই।
আরো বেশি করে খাবেন। মদ্যপান করেন?
জি-না।
মদ্যপান করেন না কী জন্যে? ধর্মীয় কারণে?
অভ্যাস নাই।
অভ্যাস না থাকলে অভ্যাস করতে হয়। জন্ম থেকে কেউ অভ্যাস নিয়া আসে না। মেয়েছেলের সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার অভ্যাস আমাদের থাকে না। পরে অভ্যাস হয়। তাদের বিছানায় নিয়ে যাই। আমার কাছে বিদেশী হুইস্কি আছে। নেন, আধা গ্লাস খান। মদ যারা খায় তাদের মধ্যে দ্রুত ভাব ভালোবাসা হয়। আপনের সঙ্গে দ্রুত ভাব ভালোবাসা হওয়া দরকার।
কেন?
আপনার সার্কাসটা আমি কিনে নিতে চাই। নগদ টাকায় কিনব। আমার যৌবনের সামান্য অভাব আছে, টাকার অভাব নাই। ভাটি অঞ্চলে আমার সাতটা জলমহাল আছে। সিজনে দৈনিক মাছ বিক্রি বাবদ লাখ টাকা মুনাফা থাকে।
সার্কাস আমার না। আমার মালিকের। সার্কাস কিনতে চাইলে মালিকের সাথে কথা বলবেন।
ব্যবসা নিয়া আমি বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলি না। এক দুইজনের সঙ্গে কথা বলি। আপনের সঙ্গে বললাম আপনি আপনার মালিকের সঙ্গে কথা বলবেন।
কী কথা বলব?
আরে যন্ত্রণা, এতক্ষণ ভেরভের করে কী বললাম? আমি সার্কাস কিনে নিব। আপনি দালালি করবেন। দালালির টাকা পাবেন।
আমার মালিক সার্কাস বেচবে না।
অবশ্যই বেচবে। কেন বেচবে না? ভালো দাম দিলেই বেচবে। ধরেন আপনার একটা শার্ট আছে। শার্টের দাম ২০০ টাকা। আমি যদি বলি আমি দুই হাজার টাকা দিব, আপনার পুরনো শার্ট আমার কাছে বেচে দেন। আপনি বেচবেন না?
আমার শখের শার্ট হলে আমি বেচব না।
তখন আমি বলব আমি বিশ হাজার টাকা দিব। দুইশ টাকা দামের শার্ট, আমি দিব বিশ হাজার টাকা। এখন তো বেচবেন? ব্যবসা বাণিজ্যের লাইনে কথা বলেন। ভাবের লাইনে না। ব্যবসা বাণিজ্যে ভাব চলে না।
সার্কাসের দল দিয়ে আপনি কী করবেন?
কী করব সেটা আমার বিবেচনা। আমার নিজের একটা যাত্রার দল আছে। নাম সুন্দরী অপেরা। তারা নিজের মনে সারা দেশে পাট গায়। কী টাকা পায়, কী না পায় এটা নিয়ে আমি ভাবি না। যাত্রা দল আমি যেভাবে কিনেছি সার্কাসও সেইভাবে কিনব। যাত্রার দল কেন কিনেছিলাম বলব?
বলুন।
সুন্দরী অপেরার একটা পালা দেখে মন উদাস হয়েছিল। যে মেয়েটা নায়িকার বোন করেছিল সে ছিল সাক্ষাৎ বিউটি। তার নাম হেনা। মাঝে মাঝে আমার মন যদি উদাস হয় তখন খবর দিয়া যাত্রার দল নিজের কাছে নিয়া আসি। হেনারে বলি, পাট গাইয়া শোনাও। সে পাট গায়।
সার্কাস কিনতে চাচ্ছেন কেন? সার্কাসের কাউকে মনে ধরেছে?
দড়ির খেলা যে দেখায়েছে এদের প্রত্যেকটারে মনে ধরেছে। বিশেষ করে ছোটটারে। আচ্ছা ছোট মেয়েটার নাম নাকি পয়সা, এটা কি সত্য?
হ্যাঁ সত্য।
পয়সা যার নাম সে তো থাকবে আমার সাথে। টাকা পয়সা বশির মোল্লার কাছে না থাকলে কার কাছে থাকবে বলেন?
স্যার, আজ আমি উঠি।
উঠতে চাইলে উঠেন। আপনের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি এই জন্যে সামান্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে।
বশির মোল্লা বালিশের নিচে থেকে একশ টাকার একটা বান্ডিল বের করল। এমনভাবে বের করল যেন পিস্তলটা দেখা যায়। তৈয়ব শুকনা গলায় বলল, আমাকে কিছু দিতে হবে না।
বশির মোল্লা বিরক্ত গলায় বলল, আমারে না কথাটা বলবেন না। না শুনতে আমার ভালো লাগে না। এইখানে দশ হাজার টাকা আছে। টাকাটা রাখেন। সন্ধ্যাকালে আবার আপনার সাথে দেখা হবে।
আবার দেখা হবে কেন?
পয়সা মেয়েটারে মেডেল দিব ডিক্লেয়ার দিয়েছি। মেডেল দিব না? স্বর্ণকারের দোকানে লোক চলে গেছে। দুই ভরি ওজনের মেডেল। মেডেলের সাথে টাকার পরিমাণ আগে বলেছিলাম এক হাজার, এখন এটারে বাড়ায়ে করেছি দশ হাজার। এক হাজার টাকা দিলে বশির মোল্লার মান থাকে না। আপনের নামটা ভুলে গেছি। আপনার কী যেন নাম?
তৈয়ব।
পাখির ক্যাচক্যাচানি শুনতেছেন?
কীসের ক্যাচক্যাচানি?
পাখির।
জি শুনতেছি।
ক্যাচক্যাচ শব্দটা এক্কেবারে মাথার ভিতরে ঢুকে। এরা এমন ত্যক্ত করে। ঐ, পাখির ক্যাচক্যাচানি থামাও।
বশির মোল্লার কথা শেষ হবার আগেই লঞ্চের ছাদ থেকে দোনলা বন্দুকের আওয়াজ হলো। তৈয়ব বুঝতে পারছে বন্দুকের শব্দ পাখিদের শুনানোর জন্যে না। তাকে শুনানোর জন্যে।
হারুন সরকার হাসপাতালের বিছানায় পা গুটিয়ে বসে আছে। তার মাথা ঘুরছে, শরীর এলোমেলো লাগছে। মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহূর্তে সে মাথা ঘুরে বিছানায় পড়ে যাবে। সেই পড়াই হবে শেষ পড়া। আর উঠা যাবে না। মৃত্যু হবে নিতান্তই অপরিচিত ফিনাইলের গন্ধ মাখা বিছানায়। তারপরও হারুন সরকার চেষ্টা করছে মুখ হাসি হাসি রাখার। ভাবটা এরকম যেন সে ভালো আছে। বেশ ভালো। এরকম ভাব দেখানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, কারণ সে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেয়ার চেষ্টায় আছে। সারাদিন ফিনাইলের গন্ধের মধ্যে পড়ে থাকতে হবে। সন্ধ্যার পর জিনের বোতল নিয়ে বসা যাবে না–এটা ভেবেই তার শরীরে ছটফটানি চলে আসছে। তার মন বলছে বেশি করে তেঁতুল দিয়ে দুগ্লাস জিন খেলেই শরীরে চনমনে ভাব চলে আসবে।
ডাক্তারের সঙ্গে সকালবেলা হারুন সরকার রিলিজ নিয়ে কথা বলেছে। ডাক্তার হতভম্ব মুখ করে বলেছে–আপনি রিলিজ নিতে চান? আপনি জানেন আপনার প্রেসার কত? পালস রেট কত? চোখ গাঢ় হলুদ হয়ে আছে। আমার ধারণা আপনার খারাপ ধরনের জন্ডিস হয়েছে।
হারুন সরকার মিনমিন করে বলেছে, হাসপাতালে থাকলে শরীর আরো বেশি খারাপ করবে।
কেন?
হারুন সরকার চুপ করে গেল। ডাক্তার এবং পুলিশ এই দুই জাতির কাছে তারা যা বলে সেটাই শুদ্ধ। এদের সঙ্গে তর্কে যাওয়া বৃথা। এখন এক মাত্র ভরসা তৈয়ব। একমাত্র সে-ই পারবে তাকে এই জেলখানা থেকে বের করে নিয়ে যেতে।
বসে আছেন কেন? শুয়ে থাকুন। রেস্ট নিন।
হারুন সরকার ডাক্তারের কথা শুনল না। বসে রইল। রাগে মুখের ভেতর ফেনা জমে যাচ্ছে। ফেনার স্বাদ তিক্ত। লক্ষণ ভালো না। মৃত্যুর আগে আগে মুখের ভেতরে তিতা ভাব চলে আসে। রসগোল্লা খেলেও মনে হয় রসে ডুবানো তিতা করলা খাওয়া হচ্ছে।
তৈয়বের উপর প্রচণ্ড রাগ লাগছে। ছাগলটা কখন আসবে? হারুন সরকারের মৃত্যুর পরে আসবে জানাজা পড়াতে। এইসব অকর্মণ্য ছাগলগুলিকে লাথি মেরে বার্মা পাঠিয়ে দেয়া দরকার। মিলিটারিদের গুতা খেয়ে মরুক। হারুন সরকার মনে মনে ঠিক করে ফেলল তৈয়ব যদি দুপুরের খাওয়ার আগে না আসে তাহলে স্বাধীন বাংলা সার্কাসের চাকরি তার শেষ। প্রয়োজনে হারুন সরকার হাট থেকে একটা বুড়া ভেড়া কিনে আনবে। ভেড়াকে ম্যানেজারের চাকরি দেবে কিন্তু তৈয়বকে রাখবে না। তৈয়বের দিন শেষ।
দুপুরের খাওয়ার সময় শেষ হলো, তৈয়ব এলো না। হারুন সরকার সময় আরেকটু বাড়াল–আছর ওয়াক্তে এলেও চাকরি থাকবে। তৈয়ব এলো আছর পার করে। হারুন সরকার বলল, এতক্ষণ ‘…’ ছিড়ছিলা? থাপপড় দিয়ে তোমার দাঁত যদি না ফেলি।
তৈয়ব শান্ত গলায় বলল, আপনার শরীর তো খারাপ। জ্বর বেড়েছে।
হারুন সরকার তুই তুকারিতে চলে গেল। চাপা গলায় ক্রুদ্ধ গর্জন করল, খবর্দার, গায়ে হাত দিবি না।
শুয়ে থাকেন। বসে আছেন কেন?
আবার কথা বলে।
এই রকম করতেছেন কেন?
সন্ধ্যার আগে আমাকে হাসপাতাল থেকে বের করার ব্যবস্থা কর।
আচ্ছা করতেছি। আপনি শান্ত হন।
হারুন সরকারের রাগ সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। এতক্ষণ তিনি যে রাগারাগি করছিলেন তার জন্যে খানিকটা লজ্জাও লাগল। হুট করে এতটা রাগ করা ঠিক হয় নি। তৈয়ব ছেলে ভালো।
তৈয়ব!
জি।
আমারে বের করার ব্যবস্থা কর।
জি করতেছি।
আজ রাতটা এখানে থাকলে আমি মারা যাব। অবশ্য এখানে না থাকলেও মারা যাব। তখন মরব নিজের বিছানায়।
আপনার শরীর কিন্তু বেশি খারাপ।
শরীর খারাপ হোক বা ভালো হোক, তুমি তেঁতুলের জোগাড় দেখ।
কী বললেন?
প্রশ্ন করবা না। যা বলব মাথা হেট করে শুনবা এবং সেই মতে কাজ করবা। খাম্বার মতো দাঁড়ায়ে আছ কেন? আমার রিলিজের কী ব্যবস্থা করলা?
করতেছি।
হারুন সরকার ক্ষুব্ধ গলায় বলল, আমি সকাল থেকে ছটফট করতেছি, তুমি আসলা সন্ধ্যা পার করে। আমি যে একটা মানুষ এই বোধটা তো তোমাদের মধ্যে নাই। কেউ তো আমারে দেখতেও আসল না। আর কেউ আসুক না আসুক জামদানীর তো আসা উচিত ছিল। এই মেয়েটাকে আমি অত্যাধিক স্নেহ করি।
আমি সবাইকে আসতে নিষেধ করেছি।
কেন?
আসলেই আপনি কথা বলবেন। আপনার বিশ্রাম হবে না।
আমার দিকে তোমার দেখি বড়ই দরদ। শোন তৈয়ব, মায়ের চেয়ে যদি অন্য কারোর প্রতি বেশি দরদ হয় তারে বলে ভান। ভান কি জানো?
না।
ভান হলো শয়তান। তুমি অবশ্যই শয়তান।
জি আচ্ছা। দেখি আপনের রিলিজের ব্যবস্থা করি।
তেঁতুল লাগবে। আজ কিন্তু তেঁতুল ছাড়া হবে না। আরেকটা কথা–জামদানীরে নিষেধ করবা সে যেন আগামী সাতদিন আমার সামনে না আসে। আমি তার উপর বেজার হয়েছি। তাদের তিন বোনুরেই এই কথা বলবা। তাদের তিনজনের উপরই আমি বেজার হয়েছি। এদেরকে আমি অত্যাধিক স্নেহ করতাম। এখন অত্যাধিক ঘৃণা করি। আমার সবই বেশি বেশি। আমার স্নেহ যেমন বেশি, ঘৃণাও বেশি। আমার মধ্যে মাঝামাঝি বলে কিছু নাই। অমাবস্যাপূর্ণিমায় জন্ম নিলে এই জিনিস হয়। তাদের মাঝামাঝি কিছু থাকে না। আমার জন্ম পূর্ণিমার রাতে। তারিখটা এখন মনে পড়তেছে না। পেটে মাল পড়লে মনে পড়বে। তখন তোমারে বলব।
জি আচ্ছা।
তৈয়বের সঙ্গে কথা বলে হারুন সরকার হাপিয়ে গিয়েছে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু তার শরীরটা এখন আগের চেয়ে ভালো লাগছে। মাথা ঘুরানো বন্ধ হয়েছে। তলপেট থেকে ধাক্কার মতো কী যেন উপরের দিকে আসত। সেটাও বন্ধ। শুধু বুক ধুকপুক করছে। শব্দ করে করছে। মনে হচ্ছে কেউ তার জামার নিচে বসে ডুগডুগি তবলা বাজাচ্ছে। যে বাজাচ্ছে সে প্লেয়ার ভালো। বিশ্রাম নেয়ার জন্যে এক মুহূর্তের জন্যও থামছে না। বাজিয়েই যাচ্ছে। তেরে কেটে তাক তাক। তেরে কেটে তাক তাক।
আসমানীরা তিন বোন স্পিড বোটে বসে আছে। নি পোর্টার স্পিড বোট চালাচ্ছে। তিন বোনই খুব মজা পাচ্ছে। বাঁক নেবার সময় স্পিড বোট কাত হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে এই বুঝি উল্টে পড়ল পানিতে। মজাটা তখন খুব বাড়ছে। আসমানী এবং জামদানী প্রথমে বিদেশী সাহেবের কাছে কিছুতেই আসতে রাজি হয় নি। কিন্তু পয়সা যাবেই। তার একটাই কথা–তাকে চা খাবার দাওয়াত করা হয়েছে। সে বলেছে যাবে। এখন আর কিছুতেই না বলা সম্ভব না। এটা সে করতে পারবে না।
জামদানী বলল, করতে পারবে না কেন?
পয়সা কঠিন মুখ করে বলল, কারণ আমি বলেছি যাব।
আসমানী বলল এটা তো কোনো কঠিন প্রতিজ্ঞা না, যে যাব বললে যেতেই হবে।
পয়সা বলল, আমার জন্যে এটা কঠিন প্রতিজ্ঞা।
আসমানী বলল, তোর জন্যে কঠিন প্রতিজ্ঞা হবে কেন? তুই কি ঐ লালমুখা বান্দরের প্রেমে পড়েছিস?
পয়সা বলল, হ্যাঁ আমি প্রেমে পড়েছি। আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তার চাদমুখ না দেখতে পেলে আমি মরে যাব।
তামাশা করছিস কেন?
আমি তামাশা করছি না। তোমরা তামাশা করছ। আমাকে আটকে রাখছ। আমি দশ মিনিটের জন্যে যাব। এক কাপ চা খেয়ে চলে আসব।
ঠিক আছে তাহলে আমরাও যাব।
পয়সা বলল, বেড়াতে যাবার জন্যে যদি যেতে চাও তাহলে অবশ্যই যাবে। কিন্তু আমাকে পাহারা দেবার জন্যে যেতে পারবে না।
আসমানী বলল, তুই কি পাহারার উর্ধ্বে?
পয়সা বলল, হ্যাঁ।
জামদানী বলল, তুই কিন্তু তোর জন্যে বিরাট বিপদ ডেকে আনছিস। খাল কেটে বিদেশী কুমীর আনছিস।
পয়সা ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ভালো করছি।
আসমানী এবং জামদানী মেজাজ খারাপ করে বোনের সঙ্গে গেল। যাবার পথে দুজনের কেউই একটা কথাও বলল না।
নি পোর্টারের তাঁবুর ভেতর ঢোকার দশ মিনিটের মাথায় তিনজনেরই মেজাজ ভালো হয়ে গেল। কারণ নি পোর্টার তাদের জন্যে ভালো চমকের ব্যবস্থা রেখেছিল। সে তার ভিডিও ক্যামেরায় দড়ির উপর তিন বোনের ছোটাছুটির পুরোটাই ভিডিও করে রেখেছিল। লং শট, ক্লোজআপ সবই আছে। দর্শকদের রিএকশান আছে। পয়সা যে মাঝে মধ্যেই পড়ে যাবার ভঙ্গি করছে। আবার দড়ি থেকে লাফিয়ে উঠে নিজেকে ঠিক করছে তাও আছে।
ভিডিও দেখে তিনবোনই অবাক। তাদের নিজেদের খেলাটা যে এত সুন্দর এত মজার তা তারা কল্পনাও করে নি। পয়সা বলল, আমি আবার দেখব। নি পোর্টার হাসি মুখে বলল, অবশ্যই। পুরোটা আবার দেখা হলো। দ্বিতীয়বার দেখার সময় তিন বোনের আরো মজা লাগল। পয়সার আরো একবার দেখতে ইচ্ছা করছে কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারছে না।
তিন বোনের জন্য গিফট র্যাপে মোড়া তিন প্যাকেট চকলেট ছিল। আর তিনটা সেন্টের শিশি। শিশির রঙ গাঢ় নীল। আর শিশিটা এমন অদ্ভুত সুন্দর। দেখে মনে হয় নীল রঙের তিন মেয়ে কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পয়সার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল–তারা তিন বোন পুরস্কার হিসেবে সোনা-রুপার মেডেল পেয়েছে, টাকা পেয়েছে; কিন্তু এত সুন্দর উপহার তাদেরকে কেউ দেয় নি।
স্পিড বোট নিয়ে ঘোরার সময়ও মজা কম হলো না। এক সময় সাহেব বলল, তোমরা কেউ স্পিড বোট চালাবে? হাল ধরে থাকলেই হবে। আর কিছু করতে হবে না।
পয়সা বলল, আমি চালাব।
আসমানী বলল, না না, তুই উল্টে ফেলবি।
উল্টে ফেললে ফেলব কিন্তু আমি চালাবই।
পয়সা কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই স্পিড বোট চালাল। তখন জামদানী বলল, আমিও চালাব।
আসমানীও বাদ রইল না।
পয়সার শরীর ঝনঝন করছে। কিছুতেই সে বুঝে উঠতে পারছে না তার এত আনন্দ হচ্ছে কেন? খুব বেশি আনন্দ হলে তার শরীর টলমল করতে থাকে। তখন খুব সমস্যা হয়। দড়ির উপর ঠিকঠাক পা পড়ে না। ব্যালেন্সে খুব অসুবিধা হয়। আজ অবশ্যই অসুবিধা হবে। এবং আরেকটা ব্যাপারও হবে–রাতে এক ফোটা ঘুম হবে না। পয়সার এই ব্যাপারটা মাঝে মাঝেই হয়। সারারাত এক ফোটা ঘুম আসে না।
হারুন সরকারের মনে হচ্ছে তার শরীর পুরোপুরি সেরে গেছে। দুর্বল ভাবটা আছে, বুকের ধুকধুকানিও আছে। তার পরেও শরীর যে পুরোপুরি সেরেছে এই বিষয়ে সে নিশ্চিত। কারণ সিগারেটে টান দিতে ভালো লাগছে। জিনের গ্লাসে চুমুক দিতেও ভালো লাগছে। বমি আসছে না। শরীর সেরেছে কী সারে নি তার আসল পরীক্ষা সিগারেটে। শরীর খারাপ থাকলে সিগারেটে টান দেয়া যায় না। সে তো ভালোই টানছে। হারুন সরকার তেঁতুল মিশানো জিনের গ্লাসে লম্বা টান দিয়ে গাঢ় স্বরে ডাকল, তৈয়ব!
তৈয়ব বলল, জি।
কাছে আছ তো?
জি, কাছে আছি।
শো শুরু করে দিয়ে আবার চলে আসবে।
জি চলে আসব। কিন্তু আপনে একটু ধীরে খান। আপনার শরীর ঠিক হয়। নাই।
শরীর ঠিক আছে। আমার শরীর আমি বুঝব না, তুমি বুঝবে? শরীর নিয়া কোনো কথা বলব না। টিকিট বিক্রির অবস্থা কী?
আজও সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।
হারুন সরকার তৃপ্তি নিয়ে বলল, হাতির বাচ্চাটার জন্মের পর থেকে আমাদের ভাগ্য ফিরে গেছে।
হতে পারে।
হতে পারে টারে কিছু না। ঘটনা এটাই। হাতির বাচ্চারে একটা রূপার ঘণ্টা বানায়ে দিবে। ঘণ্টা গলায় ঝুলবে।
জি আচ্ছা।
কালকের মধ্যে ঘণ্টা বানাতে হবে। ঘণ্টা আমি নিজের হাতে পরায়ে দিব।
জি আচ্ছা।
আমি হাতির বাচ্চাটা এখনো দেখি নাই। এটা একটা আফসোস। কাল দেখবেন।
অবশ্যই কাল দেখব। নিজের হাতে গলায় ঘন্টা পরায়ে দেব।
এখন যাই। শো টাইম হয়ে গেছে।
আর দশটা মিনিট বসো। গ্লাসটা শেষ করি। নতুন এক গ্লাস বানায়ে হাতে ধরায়ে দিয়ে যাও।
তৈয়ব দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আবার বসল। হারুন সরকার বলল–চারদিন পার করে দিলাম এখনো কোনো ভেজাল হয় নাই। বিরাট আশ্চর্য ঘটনা। ঠিক না?
ঠিক। তবে ছোট্ট ভেজাল বোধহয় হবে।
কী ভেজাল?
বশির মোল্লা বলে এক লোক মনে হয় ঝামেলা করবে। সহজ ঝামেলা না। জটিল ঝামেলা। সে সার্কাস কিনে নিতে চায়।
কোনখানের ফাজিল?
ভাটি অঞ্চলের। সে আমাকে দালাল ধরেছে। দালালি বাবদ দশ হাজার টাকাও দিয়েছে।
বলো কী?
আমি খোঁজ নিয়েছি–লোক ভয়ঙ্কর।
সার্কাস কিনতে চায় কেন?
মেয়ে তিনটার জন্যে কিনতে চায়। সার্কাসের যে মালিক সে মেয়ে তিনটারও মালিক, আর কিছু না।
হারুন সরকার চিন্তিত গলায় বলল, আমার তো নেশা কেটে যাওয়া ধরেছে। এটা তুমি কী বললা?
তৈয়ব কিছু বলল না। হারুন বলল, সমস্যার সমাধান কী?
তৈয়ব চুপ করেই রইল। হারুন সরকার বলল, ঐ লোকের নাম কী? বশির মোল্লা।
তাকে বলো যে সার্কাস আমি বেচে দিব। কিন্তু দাম এক কোটি টাকা। তখন বাপ বাপ করে দৌড় দিয়ে পালায়ে যাবে।
তৈয়ব বলল, পালাবে না। সে এই টাকা খরচ করবে। আমি নিশ্চিত।
হারুন সরকার চিন্তিত গলায় বলল, এখন করা যায় কী?
ঘণ্টা পড়ে গেছে। শো শুরু হবে। তৈয়ব আলী ওঠে দাঁড়াল।
রাত দুটা বাজে। পয়সা পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে আছে। স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে। এখন আর ঘুম আসছে না। স্বপ্নটা তেমন অদ্ভুত না। তার জন্যে সাধারণ স্বপ্ন। সে প্রায়ই দেখে। তবে আজকের স্বপ্নটা একটু অন্যরকম। সে দেখেছে দড়ির খেলা হচ্ছে, হঠাৎ ব্যালেন্স হারিয়ে সে দড়ি থেকে পড়ে গেল। শাঁ শাঁ শব্দ হচ্ছে, সে নিচে নামছে নিচে নামছে। চারদিক থেকে চিৎকার–বাঁচাও বাঁচাও। এই পর্যন্ত স্বাভাবিক স্বপ্ন। পয়সা নিয়মিতই এই স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্নের পরের অংশটা অস্বাভাবিক। স্বপ্নের মধ্যে সে শুনল ভট ভট শব্দ হচ্ছে। নিচে তাকিয়ে দেখে বিশাল সমুদ্র। সে পড়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। ভট ভট শব্দটা স্পিড বোটের। তাকে বাঁচানোর জন্যে নি পোর্টার স্পিড বোট নিয়ে ছুটে আসছে।
পয়সার স্বপ্ন এই পর্যন্ত। সে বাঁচল না-কি সমুদ্রে তলিয়ে গেল সেটা আর দেখা হলো না।
পয়সা।
হুঁ।
কী হয়েছে?
পয়সা জবাব দিল না। আসমানী বলল, তুই কাঁদছিস কেন?
পয়সা গালে হাত দিয়ে দেখল গাল ভেজা। তার চোখ দিয়ে যে পানি পড়ছে এটা সে নিজেও জানে না। একটা ব্যাপার শুধু জানে তার খুব একলা লাগছে। যেন সে এখন আর তিন বোনের একজন না। সে আলাদা।
আপা।
কী?
কাল সকালে আমি কিন্তু ঐ বিদেশী সাহেবের কাছে বেড়াতে যাব।
ঠিক আছে তোকে নিয়ে যাব।
তোমরা যাবে না আপা, আমি একা যাব।
আসমানী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা, তোর যদি ভালো লাগে তুই একাই যাবি।
তাঁবুর বাইরে পায়ের আওয়াজ
তাঁবুর বাইরে পায়ের আওয়াজ। কে আসবে এত ভোরে? ভিক্ষুকশ্রেণীর ছেলেপুলে আগে এরকম আসত। তাঁবুর পাশে ঘুরঘুর করত। ফেলে দেয়া বিয়ারের ক্যান, কোকের ক্যান নিয়ে যেত। এমন কি সিগারেটের খালি প্যাকেটের প্রতিও তাদের আগ্রহ। ইদানীং সিকিউরিটি টাইট হয়েছে। বিদেশীদের তাঁবুর পাশে কাউকে আসতে দেয়া হয় না। তাহলে এত ভোরে কে আসবে? রহমত উল্লাহ বাবুর্চি মগ ভরতি গরম কফি নিয়ে এসে ঘুম ভাঙায়। সেই সময়ও হয় নি। ঘড়িতে বাজছে সাতটা। বাবুর্চির আসার সময় ঠিক আটটায়। নি পোর্টার বলল, Who is there? কে?
পয়সা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি।
নি পোর্টার তৎক্ষণাৎ তাঁবুর বাইরে এসে চিন্তিত গলায় বলল, তুমি? Is anything wrong? কোনো বিপদ হয়েছে?
পয়সা বলল, না।
এসো, ভেতরে এসো।
পয়সা তাঁবুর ভেতর ঢুকল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খুবই অস্বস্তি লাগছিল। সবাই কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছিল। তাঁবুর ভেতর ঢুকে সেই অস্বস্তি পুরোপুরি কেটে গেল। সার্কাসের মেয়ে এমনিতেই তাঁবুর ভেতর স্বস্তি বোধ করে। তাদের জীবনই কাটে তাঁবুতে। তার উপর এই তাবুটা নি পোর্টারের। অন্য কারোর না।
মিস কয়েন, ভোরবেলা তোমাকে দেখে বিস্ময় পেয়েছি।
পয়সা বলল, আমি ভোরবেলা হাঁটতে বের হয়েছিলাম। তখন ভাবলাম আপনার তাঁবুর পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন দেখে যাই আপনি কী করছেন।
নি পোর্টার বলল, তোমার অন্য দুবোন কোথায়? ওরা তোমার সঙ্গে হাঁটতে বের হয় নি?
না।
মিস কয়েন, তুমি যে এই ভোরবেলা হাঁটতে বের হয়েছ এটা ঠিক না। তোমাদের দেশের মেয়েরা এত ভোরে একা একা হাঁটতে বের হয় না।
আমি আমাদের দেশের অন্য মেয়েদের মতো না। আমি আলাদা।
তুমি আলাদা কেন?
আমি সার্কাসের মেয়ে এই জন্যে আমি আলাদা।
নি পোর্টার বলল, আচ্ছা তাহলে আমার ত্রুটি হয়েছে। তুমি সকালে মর্নিংওয়াক করতে বের হয়েছিলে। হঠাৎ মনে হলো–বিদেশী সাহেবের সঙ্গে কফি খাব। তখন চলে এসেছ।
হ্যাঁ তাই।
কফি খাবার জন্যে আটটা বাজা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কফি আসবে আটটায়। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবে?
পয়সা জবাব দিল না। সে তার মাথায় প্যাচানো নীল রঙের স্কার্ফটা খুলে ফেলল। আঁকি দিয়ে মাথার চুল ঠিক করল। তার খুবই অদ্ভুত লাগছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে এই তাবুটাই তার ঘরবাড়ি।
মিস কয়েন, আমার মনে হয় তুমি আমাকে কিছু বলতে এসেছ। যা বলতে এসেছ বলে ফেল।
পয়সা বলল, আপনার চোখের যে নীল রঙ সেটা সব সময় এক রকম থাকে। কখনো বাড়ে কখনো কমে। এটা কি আপনি জানেন?
তুমি কি এই কথাটাই বলতে এসেছ?
হ্যাঁ।
চোখের নীল রঙ কি তোমার পছন্দ?
না।
তোমার কী রঙ পছন্দ?
কালো।
আচ্ছা বেশ, আমি চোখ কালো করে ফেলব।
পয়সা বিস্মিত হয়ে বলল, কীভাবে?
কালো রঙের কনট্যাক্ট লেন্স পরলেই চোখ কালো হয়ে যাবে। আবার ধর তুমি যদি নীল রঙের কোনো কনট্যাক্ট লেন্স পর তাহলে তোমার চোখ…
পয়সা আগ্রহের সঙ্গে বলল, দিন আমার চোখ নীল করে। দেখি নীল চোখে আমাকে কেমন লাগে।
আমার সঙ্গে কনট্যাক্ট লেন্স নেই। লেন্স লাগানোর জন্যে ঢাকায় যেতে হবে। আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করব।
কবে ব্যবস্থা করবেন?
যত দ্রুত পারি ব্যবস্থা করব। শোন মিস কয়েন, একটু আগে তুমি বলছিলে নীল রঙ তোমার পছন্দ না। এখন আবার বলছ তোমার নিজের চোখ নীল করতে চাও। ব্যাপারটা কী বলো তো?
পয়সা বলল, একটু আগে আমি মিথ্যা কথা বলছিলাম। নীল রঙ আমার পছন্দ।
নি পোর্টার বলল, মিথ্যা কথা দিয়ে দিন শুরু করলে সারা দিন মিথ্যা কথা বলতে হয়, এটা কি তুমি জানো?
না।
এটা হলো আমার দাদিমার কথা। আমার ধারণা কথাটা ঠিক। আমি অনেকবার লক্ষ করেছি যেদিনই আমি সকালে মিথ্যা কথা বলেছি, সেদিন ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্ত আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। এসো মিস কয়েন, একটা চুক্তি করি। তুমি আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে না। যা জিজ্ঞেস করি তার সত্যি জবাব দেবে।
আমি সব সময় সত্যি কথা বলি, শুধু আপনার সঙ্গেই মিথ্যা বলি।
কেন?
আমি জানি না কেন?
আমার ধারণা তুমি জানো।
না, আমি জানি না।
এই তো আবার মিথ্যা কথা বলছ।
পয়সা হেসে ফেলল। কোনো কারণ নেই অথচ তার কী যে আনন্দ লাগছে! একটা বড় সমস্যা হয়েছে তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সাহেবের সামনে কেঁদে ফেলা মোটেই ঠিক হবে না। ব্যাটা একগাদা প্রশ্ন করবে। সত্য কথা বলা হচ্ছে না-কি মিথ্যা বলা হচ্ছে এই নিয়ে ঝামেলা করবে। পয়সার যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে ব্যাটা যাতে কিছু বুঝতে না পারে সেইভাবে মাথার স্কার্ফটা হাতে নিতে হবে। সেই স্কার্ফ মাথায় জড়াবার সময় কৌশল করে এক ফাঁকে চোখ মুছে ফেলতে হবে। সেটা কি সম্ভব হবে।
পয়সা, তুমি কাঁদছ কেন?
কাঁদছি না।
অবশ্যই কাঁদছ। তোমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কেন কাঁদছ?
জানি না কেন কাঁদছি।
অবশ্যই তুমি জানো।
জানলে জানি। আপনার কী?
আমাকে বলবে না?
না, আমি বলব না।
আটটা বেজে গেছে। বাবুর্চি কফি নিয়ে এসেছে। সে এমনভাবে পয়সার দিকে তাকাচ্ছে যেন চোখের সামনে ভূত দেখছে। সার্কাসের একটা মেয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে বসে আছে। ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। এর মানে কী?
নি পোর্টার বলল, রহমত উল্লাহ, তুমি আরেক কাপ কফি নিয়ে এসো। মিস কয়েন আমার সঙ্গে নাশতা করবে সেই ব্যবস্থা কর। আজ আমার সাইটে যেতে দেরি হবে এই খবরটা দিয়ে এসো। আর শোন, তুমি এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছ কেন? কারো দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে খুব অস্বস্তি বোধ করে। এবং এটা অদ্রতা।
রহমত উল্লাহ পয়সার মুখ থেকে চোখ না নামিয়েই বলল, জি স্যার।
পয়সা নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে এখন সহজ এবং স্বাভাবিক। গুট গুট করে গল্প করছে। হাসছে। যেন এই তাবুই তার ঘরবাড়ি। গল্প শেষ করেই সে যেন তাবু গুছাতে শুরু করবে। ময়লা কাপড় ধোয়ার জন্যে আলাদা করবে।
পয়সা বলল, আচ্ছা আপনি কি লক্ষ করেছেন আমরা তিন বোন যখন দড়ির খেলা দেখাই তখন একটা সময় তিন বোন দড়ির মাঝামাঝি চলে আসি এবং কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আমাদের তিন বোনেরই চোখ বন্ধ থাকে।
আমি লক্ষ করি নি।
সার্কাস দেখতে আরেকদিন যখন আসবেন তখন লক্ষ করবেন।
অবশ্যই লক্ষ করব।
আমরা তিন বোন চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি কেন জানতে চান?
হ্যাঁ, জানতে চাই।
আমরা তিন বোন তখন আল্লাহর কাছে একটা প্রার্থনা করি। আমরা আল্লাহকে বলি–আল্লাহপাক, তুমি আমাদের বাবা-মাকে ফিরিয়ে এনে দাও। আবার যেন আমরা এক সঙ্গে হতে পারি।
তোমার বাবা-মা কোথায় গেছেন?
জানি না কোথায় গেছেন। প্রথমে মা চলে গিয়েছিলেন। মাকে ফিরিয়ে আনতে বাবা গিয়েছেন।
তোমরা রোজ দড়িতে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা কর যেন তারা ফিরে আসেন?
রোজ করি না। যেদিন সার্কাসের খেলা থাকে সেদিন করি। আমরা তিন বোন ঠিক করে রেখেছি যত দিন আমরা সার্কাসে খেলা দেখাব ততদিনই দড়ির উপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করব।
তোমাদের ধারণা প্রার্থনায় ফল হবে? হারানো বাবা-মা ফিরে আসবেন?
পয়সা গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলল, অবশ্যই তারা ফিরে আসবে। আমরা তিন বোন তো আল্লাহর কাছে আর কোনো কিছুই চাই না। একটা জিনিসই চাই।
পয়সা।
জি।
তোমার গল্পটা যে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী তা-কি তুমি জানো? আমি মোটামুটি কঠিন মানুষ কিন্তু আমার চোখে পানি এসে গেছে। আমি নিশ্চিত তুমি তোমার বাবা-মাকে ফেরত পাবে।
পয়সা চোখ মুছল। এখন তার চোখ ভর্তি পানি, তবে চোখের পানি নিয়ে এখন সে আর ব্ৰিত না। সে স্কার্ফ দিয়ে চোখ মুছল। নি পোর্টার বলল–তোমাদের মিলন দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছে। সেই দৃশ্য কতই না আনন্দময় হবে!
পয়সা বলল, আমি এখন যাই।
নি পোর্টার বলল, অবশ্যই তুমি এখন যাবে না। আমরা ব্রেকফাস্ট করব, তারপর আমি তোমাকে নিয়ে স্পিডবোটে করে ঘুরতে বের হবো। তোমাকে নিয়ে আমার বিশেষ পরিকল্পনা আছে। আজ তোমার অনেক ছবি তোলা হবে। সেই ছবি আমি দেশের বাড়িতে পাঠাব। আচ্ছা মেয়ে শোন, তুমি দেখি কেঁদেই যাচ্ছ। এত কাঁদছ কেন?
পয়সা বলল, যে যত হাসে তাকে কাঁদতে হয়। আমি খুব বেশি হাসি, এই। জন্যেই আমাকে খুব কাঁদতে হয়। রামসন্যা বলেছেন—
যত হাসি তত কান্না
বলে গেছেন রামসন্যা।
রামসন্যা কে?
আমি জানি না উনি কে। তবে উনার কথা খুব সত্যি হয়।
কথাটা আবার বলো তো, আমি আমার নোটবুকে লিখে রাখি।
পয়সা গম্ভীর গলায় বলল–
যত হাসি তত কান্না
বলে গেছেন রামসন্যা।
হারুন সরকার চোখে স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। অথচ ঘরে আলো আছে। তার চোখে ছানিও পড়ে নি। তাহলে এরকম হচ্ছে কেন? মৃত্যু কি এসে গেছে? খাটের নিচে আজরাঈল বসে আছে ঘাপটি মেরে? খাটের নিচ থেকে আজরাঈল তার ঠাণ্ডা হাত বের করে হারুন সরকারকে ছুঁয়ে দেবে। তখন শীতে শরীর কাঁপতে থাকবে। মৃত্যুর আগে আগে মানুষ হঠাৎ শীতে কাতর হয়। হারুন সরকারের এখনো শীত লাগছে না, তবে শীত লাগার সময় মনে হয় হয়ে গেছে।
হারুন সরকারের সামনে যে দাড়িয়ে আছে সে যে তিন বোনের একজন তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কোন জন? তিনটি বোনের চেহারাই এক রকম। এই জন্যেই কি হারুন সরকার ধরতে পারছে না?
তুমি কে? নাম কী?
জামদানী।
হারুন সরকার বলল, তুমি ভালো আছ?
জামদানী ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আপনার এ কী অবস্থা!
হারুন সরকার বলল, হাসপাতাল থেকে চলে আসা ঠিক হয় নাই। ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমি সারা জীবন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জামদানী তুমি বসো।
জামদানী বিস্মিত হয়ে বলল, আমি তো বসে আছি। আপনার সামনের চেয়ারটায় বসে আছি। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?
হারুন সরকার হতাশ গলায় বলল, সব কিছু ঝাপসা লাগছে। মনে হয় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অনেক কষ্ট করে সার্কাসটা করেছিলাম। সার্কাস ফেলে চলে যাব–এই জন্যেই খারাপ লাগছে। তৈয়বকে পাঠাও। তৈয়বের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
সময় কতটা পার হয়েছে হারুন সরকার বলতে পারছে না। তৈয়ব সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে অন্যদিনের চেয়েও নয়া লাগছে। হারুন সরকার বলল, কেমন আছ তৈয়ব?
তৈয়ব বলল, আপনি কথা বলবেন না। আপনাকে সদর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
মরতে হলে এইখানেই মরব। হাসপাতালে মরব না। শোন তৈয়ব, আমি এখনো হাতির বাচ্চাটাকে দেখি নাই। হাতির বাচ্চাটাকে এখানে নিয়ে আস।
তৈয়ব চলে গেছে। হারুন সরকার হাতির বাচ্চাটার জন্যে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে। আসমানী এবং জামদানী–এই দুই বোন এখন তার সামনে। এদের দুজনকে মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তৃতীয়জন গেল কোথায়? হারুন গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, তোমরা কেমন আছ?
আসমানী এবং জামদানী কেউ কিছু বলল না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। হারুন সরকার বিড়বিড় করে বলল, তোমাদের ছোটবেলায় দড়ির খেলা শিখাবার জন্যে খুব কষ্ট দিয়েছি, তোমরা কিছু মনে রেখ না।
আসমানী বলল, আপনি কথা বলবেন না। আপনি চুপ করে থাকুন।
খুব কষ্ট করে সার্কাসটা গুছিয়েছিলাম। যদি সম্ভব হয় এটাকে টিকিয়ে রাখবে।
হারুন সরকার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনল। সে আগ্রহ নিয়ে বলল, কে কাঁদে?
দুই বোনের কেউ জবাব দিল না। হারুন সরকারের মনে হলো দুই বোনই কাঁদছে। সে কে? সে কেউ না। তার জন্যেও মানুষ কাঁদছে। এরচে আনন্দের। আর কী হতে পারে?
বশির মোল্লা মাছ খেতে পারেন না
বশির মোল্লা মাছ খেতে পারেন না। মাছের গন্ধে তার বমি আসে। শরীর গুলাতে থাকে। মাঝে মধ্যে জোর করে খেয়ে দেখেছেন খাওয়ার পর পর সারা শরীরে চাকা চাকা কী যেন হয়। চুলকানি হয়। সিলেটে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। ডাক্তার বলল, মাছ খাবেন না। মাছে আপনার এলার্জি। বশির মোল্লা বললেন, শরীরে চাকা চাকা হওয়া কি এলার্জি? তাহলে তো আমার মেয়ে-মানুষেও এলার্জি আছে। নতুন কোনো মেয়ে-মানুষের কাছে গেলেও আমার শরীরে চাকা চাকা কী যেন হয়। চুলকানি হয়। সেই চুলকানি কমতে এক-দুই দিন লাগে। শরীরে তিসির তেল মালিশ করতে হয়।
ডাক্তার কিছু বলল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
কেউ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে বশির মোল্লার ভালো লাগে। আবার কেউ ভয় পেয়ে তাকিয়ে থাকলেও ভালো লাগে। বিস্মিত মানুষ এবং ভীত মানুষ–দুই ধরনের মানুষই তার দেখতে ভালো লাগে। কোন ধরনের মানুষ দেখতে বেশি ভালো লাগে এখনো তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি।
সুনামগঞ্জ থেকে একবার এক ফিসারিজের অফিসার জলমহল দেখতে তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। অল্পবয়স্ক রূপবতী স্ত্রী। হাতে ক্যামেরা। যা দেখছে লাফালাফি করে তারই ছবি তুলছে। ফিসারিজ অফিসারের নাম রকিবউদ্দিন। স্ত্রীর সাথে তিনিও লাফালাফি করছেন। স্ত্রীর শাড়ির পাড়ে কাদা লেগেছে। রকিব উদ্দিন নিজেই সাবান দিয়ে শাড়ির পাড় ধুচ্ছেন। তবে স্ত্রীকে নিয়ে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করলেও তালে ঠিকই আছে। এরই মধ্যে এক ফাঁকে ঘুসের টাকাটা দিয়ে দিতে বলেছেন। মাসের এক-দুই তারিখে টাকাটা পৌঁছে দেয়া হয়। এবার তিনি নিজেই হাতে হাতে নিয়ে যাবেন। এবং ফেরার পথে একটা বড় রুই মাছ,
একটা বোয়াল মাছ এবং এক কলসি কৈ মাছ দিয়ে দিতে বলেছে।
বশির মোল্লা বললেন, বিশাল সাইজের পাবদা আছে। কিছু পাবদাও নিয়ে যান।
রকিবউদ্দিন বললেন, পাবদা আমার স্ত্রী খায় না। মাছের ব্যাপারে সে খুব চুজি।
ম্যাডাম না খেলে না খাবেন। আপনি খাবেন। পাবদার সাইজ দেখার মতো। এক একটা এক হাত লম্বা। কিছু দিয়ে দেই?
রকিবউদ্দিন যেন নিতান্তই অনিচ্ছায় বললেন, তাহলে দেন।
বড় মাছ একটা করে দিতে বলেছেন, দুটা করে দিয়ে দিলাম। একটা করে মাছ দেওয়া ঠিক না। অলক্ষণ।
এত মাছ করব কী?
নিজে খাবেন। আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীকে দিবেন।
অত্যন্ত আনন্দিত মুখে রকিবউদ্দিন নৌকায় উঠতে যাবেন, বশির মোল্লা বলল, স্যারের সঙ্গে একটু প্রাইভেট টক ছিল।
রকিবউদ্দিন বললেন, বলুন কী ব্যাপার?
বশির মোল্লা বললেন, স্যারের স্ত্রী মাশাল্লাহ সুন্দরী।
রকিবউদ্দিন চোখ সরু করে তাকালেন। তাঁর মুখের চামড়া সামান্য শক্ত হয়ে গেল। হঠাৎ তাঁর স্ত্রীর প্রসঙ্গ কেন এলো ভদ্রলোক বুঝতে পারছেন না।
বশির মোল্লা গলা নিচু করে বললেন, আমি মনস্থির করেছি আপনাদের দুজনকে আজ রাতে আমার বাংলোবাড়িতে রেখে দেব। দোতলা বাড়ি। জেনারেটর আছে। ফ্যান বাতি সবই চলে। আপনি থাকবেন একতলায়। ম্যাডামকে নিয়ে আমি থাকব দুতলায়।
রকিবউদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, তার মানে? তার মানে কী?
বশির মোল্লা গলা আরো নিচু করে বললেন, মানে তো পরিষ্কার। এরচে পরিষ্কার আর কীভাবে বলি? এরচে পরিষ্কার করে বললে শুনতে খারাপ লাগবে। আমার অবশ্যি বলতে অসুবিধা নাই। আমি মেছুয়া মানুষ। আমি ভালো-মন্দের ধার ধারি না।
রকিবউদ্দিন কঠিন দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তিনি সঙ্গে করে যে দুজন পিয়ন এনেছিলেন, তাদের খুঁজছেন। তবে তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। বশির মোল্লা বললেন, আপনার দুই পিয়নকে সকালে নৌকায় করে মাছ দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।
রকিবউদ্দিন রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আপনি নিজেকে কী ভাবেন? দেশে আইন-কানুন নাই?
বশির মোল্লা বললেন, ভাটি অঞ্চলে আমিই আইন, আমিই কানুন। আমি কী বলি শুনেন। ঝামেলা না করলে আপনের জন্যে ভালো। ঝামেলা করলেও জিনিস একই হবে। মাঝখান থেকে আপনার ক্ষতি। সুনামগঞ্জে খবর যাবে হাওর থেকে ফেরার সময় নৌকাডুবি হয়ে ফিসারিজ অফিসার এবং তার স্ত্রী মারা গেছে। হাওরে নৌকাডুবি কোনো ব্যাপারই না।
রকিবউদ্দিন কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আপনি এইসব কী বলছেন? কী বলছেন?
বশির মোল্লা বললেন আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। আমি, আপনি আর ম্যাডাম এই তিনজন ছাড়া ঘটনা আর কেউ জানবে না। কাতল মাছের নামে ওয়াদা করতেছি। ভাটি অঞ্চলের সবাই জানে বশির মোল্লা যখন মাছের নামে ওয়াদা করে তখন ওয়াদা রাখে।
নৌকা থেকে রকিবউদ্দিনের স্ত্রী হাসি মুখে চেঁচিয়ে বলল, এই তোমরা দুজন গুটুর গুটুর করে কী আলাপ করছ? দুজন একটু ডান দিকে আস। আমি ছবি তুলে রাখি। সুন্দর কম্পোজিশন। এখান থেকে ব্যাকগ্রাউন্ডে হাওরটা এত সুন্দর লাগছে!
বশির মোল্লা বললেন, স্যার, ম্যাডাম আমাদের ডানে সরতে বলেছেন। ছবি তুলতে তুলতে মন ঠিক করেন আমার প্রস্তাবে রাজি না অরাজি।
রকিবউদ্দিন জায়গা থেকে নড়তেও পারছেন না, জবাবও দিতে পারছে না। আতঙ্কিত এবং বিস্মিত চোখে বশির মোল্লার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বশির মোল্লা লক্ষ করল রকিব উদ্দিনের মুখ থেকে অতি দ্রুত বিস্ময় দূর হচ্ছে। আতঙ্ক বাড়ছে। আতঙ্কিত হলে একেক মানুষের চোখ একেক রকম হয়ে যায়। কারো চোখ অক্ষ্মিকোঠারে ঢুকে যায়। আবার কারো চোখে অক্ষ্মিকোঠর থেকে বের হয়ে আসে। রকিবউদ্দিনের চোখ বের হয়ে আসছে। বশির মোল্লা মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছেন। বশির মোল্লা তার জীবনে এত আতঙ্কিত হতে কাউকে দেখেন নি। এখনো কোনো কারণে মন টন খারাপ থাকলে রকিবউদ্দিনের আতঙ্কিত মুখের ছবিটা মনে করার চেষ্টা করেন। তার বড় ভালো লাগে।
আজ বশির মোল্লার মন ভালো। প্রধান কারণ ঠাণ্ডা লেগে সর্দির মতো হয়েছে। সর্দিতে নাক বন্ধ। কোনো কিছুরই ঘ্রাণ পাচ্ছেন না। কাজেই আজ মাছ খেতে পারবেন। গন্ধ কোনো সমস্যা হবে না। বাইন মাছ এনে রান্না করতে বলেছেন। লঞ্চের বাবুর্চি ঝোল ঝোল করে বাইন মাছ খুব ভালো রান্না করে। বাইন মাছের সন্ধানে লোক গেছে।
আরো একটি বিশেষ কারণে বশির মোল্লার মন ভালো সার্কাসের ছোট মেয়েটিকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। দড়ির উপর অনেক দূর থেকে দেখে মেয়েটাকে যত সুন্দর লেগেছে, কাছ থেকে আরো বেশি সুন্দর লেগেছে। সাধারণত উল্টা হয়। দূর থেকে যাদের সুন্দর লাগে, কাছে আর সুন্দর লাগে না। গতকাল মেয়েটার গলায় সোনার মেডেল পরিয়ে হাতে দশ হাজার টাকা দিতে দিতে বললেন তোমার নাম কী গো? মেয়েটা হেসে দিয়ে বলল–নাম তো জানেন। আবার কেন জিজ্ঞেস করছেন? বশির মোল্লা বললেন, প্রত্যেকে তার নিজের নামটা মধুর করে বলে। তুমি কত মধুর করে বলো এটা শোনার জন্যে নাম জিজ্ঞেস করলাম। মেয়েটা তার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শুনবে বলে আশা করে নি। মেয়েটার চোখের উপর দিয়ে বিস্ময় ঝিলিক মেরে গেল। বিস্ময়টা বশির মোল্লার ভালো লাগল। এই মেয়ে আশেপাশে থাকলে তার বিস্মিত চোখ ঘনঘন দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। তিনি এখন তার চারপাশে ভীত চোখ দেখেন। বিস্মিত চোখ দেখেন না।
বশির মোল্লা ঘড়ি দেখলেন। এগারোটা বাজে। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি বাদল হবে বলে মনে হয়। গা ভর্তি ঘামাচি হয়েছে। বৃষ্টিতে না ভিজলে ঘামাচি দূর হবে না। অবশ্যি ঘামাচির একটা উপকারিতা আছে। নখ দিয়ে কেউ যখন ঘামাচি মারে তখন খুবই আরাম লাগে। গা ভর্তি ঘামাচি নিয়ে তিনি বসে আছেন। তাকে ঘিরে তিন বোন বসে আছে। ঘামাচি মারছে। ভাবতেও ভালো লাগছে। পৃথিবীর কোনো মেয়ের সঙ্গে কোনো মেয়ের মিল থাকে না। কাজেই তিন বোন তিনভাবে ঘামাচি মারবে। সবচে ভালো করে যে ঘামাচি মারবে তাকে আধাভরি ওজনের একটা মেডেলও দেয়া হবে। মেডেলে লেখা থাকবে–ঘামাচি রানী।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। বশির মোল্লা বৃষ্টিতে ভেজার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে লঞ্চে নিজের ঘরে বসে রইলেন। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। ঘিয়া রঙের একটা চাদর কোমরের কাছে ফেলে রাখা। ইদানীং তার সমস্যা হয়েছে কাপড় গায়ে রাখতে পারেন না। গা কুটকুট করে। সমস্যাটা আগে গরমের সময় হতো। এখন সারা বছরই হয়। বাইরে ঘোরাঘুরি করা এই কারণেই দ্রুত কমে আসছে। তিনি বেশির ভাগ সময়ই নিজের ঘরে বসে থাকেন। কোমরের কাছে পাতলা চাদর দেয়া থাকে। সব সময় যে থাকে তাও না। বেশির ভাগ সময়ই থাকে না। আজ চাদরে নিজেকে খানিকটা ঢেকে রেখেছেন কারণ সার্কাসের ম্যাজেশিয়ান ব্যাটাকে আসতে বলেছেন। তিনি তার কাছ থেকে ভেতরের সংবাদ কিছু সংগ্রহ করবেন। মোটামুটি ভাবে যা জানার সবই জানা হয়েছে। তারপরেও ভেতরের কিছু খবরাখবর দরকার। তৈয়ব নামের ম্যানেজার অতিরিক্ত চালাক। তার চালাকি সামলে দিতে হলেও ভেতরের কিছু তথ্য দরকার। তৈয়বের পেছনে তিনি সর্বক্ষণের জন্যে একজন লোক লাগিয়ে রেখেছেন। সেই লোক যে খবর দিয়েছে তা বিস্ময়কর। তৈয়ব দুটা সাতটনি ট্রাক ভাড়া করেছে। ট্রাক দুটা রাত একটায় সার্কাসের মাঠে যাবে। দলবল নিয়ে পালিয়ে যাবার মতলব না তো? এদিকে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে আরো সাত দিন সার্কাস চলবে। তৈয়ব কোনো একটা চাল চালার চেষ্টা করছে। চালটা বশির মোল্লা ধরার চেষ্টা করছেন। তিনি রাগ করছেন না, আবার বিরক্তও হচ্ছেন না। বরং মজা লাগছে। বুদ্ধির খেলা খেলতে তাঁর সব সময় ভালো লাগে। সমস্যা একটাই–বুদ্ধির খেলা খেলার মতো মানুষের সঙ্গে তার দেখা আজকাল হয় না।
পৃথিবীতে চার রকমের খেলা আছে—
১. জ্ঞানের খেলা
২. বুদ্ধির খেলা
৩. টাকার খেলা।
৪. সাপের খেলা।
এরমধ্যে সবচে সহজ খেলা টাকার খেলা। এই খেলা নির্ভর করে টাকার পরিমাণের উপর। যার যত বেশি টাকা এই খেলা সে তত ভালো খেলে। সবচে কঠিন খেলা হলো বুদ্ধির খেলা। কঠিন খেলা বলেই এই খেলায় আনন্দও বেশি।
সার্কাসের ম্যাজেশিয়ান মতিন চলে এসেছে। বশির মোল্লা তাকে সরাসরি তার পর্দায় ঢাকা খাস কামরায় ডেকে পাঠালেন। তার কোমরে ফেলে রাখা ঘিয়া রঙের চাদরটা দূরে সরিয়ে দিলেন। মতিন বাবাজি ম্যাজিক দেখিয়ে লোকজনদের চমকে দেয়। তিনিও ব্যাটাকে চমকে দেবেন। ম্যাজিক ছাড়াই চমক। ব্যাটা ঘরে ঢুকেই দেখবে কুচকুচে কালো দুই মনি এক নেংটা বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছে। যে ম্যাজিক দেখিয়ে লোকজনের চোখ কপালে তুলে দেয় তার নিজের চোখ কপালে উঠে যাবে। ম্যাজিশিয়ান মতিনের চোখ সত্যি সত্যি কপালে উঠে গেল। বশির মোল্লা নরম গলায় বললেন–ভাই, কিছু মনে করবেন না। গরম বেশি পড়ছে। এই জন্যে নেংটা হয়ে বসে আছি। বৃষ্টি পড়া অবশ্য শুরু হয়েছে। আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা হলেই গায়ে চাদর দিব। আপনার অসুবিধা হলে নিচে তাকাবেন না। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন। আপনার নাম যেন কী?
প্রফেসর মতিন। যাদু সম্রাট প্রফেসর মতিন।
যাদু সম্রাট কবে হয়েছেন? কেউ বানিয়েছে না নিজে নিজে হয়েছেন? সকালে ঘুম ভাঙার পরে সবাইরে ডেকে বললেন আমি যাদু সম্রাট।
মতিন মেজাজ খারাপ করে তাকিয়ে আছে। লোকটা কেন তাকে ডেকে পাঠিয়েছে, কেনই বা নেংটা হয়ে বসে আছে–কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
যাদু সম্রাট, দাঁড়ায়ে আছেন কেন? বসেন। না-কি নেংটা মানুষের সঙ্গে বসতে অসুবিধা আছে?
মতিন বিরক্ত গলায় বলল, আমার কাজ আছে। কী জন্যে ডেকেছেন বলেন।
বশির মোল্লা ঘিয়া রঙের চাদর দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন–এত টাকা খরচ করে সার্কাসের দলটা কিনলাম। তাদের লোকজন কেমন জানার কাজেই আপনাকে ডেকেছি।
যাদু সম্রাট প্রফেসর মতিনের মুখ হা হয়ে গেল। বশির মোল্লা আড় চোখে মতিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। যাদু সম্রাটের বিস্মিত মুখ দেখতে ভালো লাগছে। মিথ্যা কথাটা এই গাধা ম্যাজিশিয়ান ধরতে পারছে না। সত্যি ভেবে নিয়েছে। বশির মোল্লা হাই তুলতে তুলতে বললেন, সার্কাসের দলটার যে হাত বদল হয়েছে তা জানেন না?
না।
তৈয়ব কিছু বলে নাই?
না। ম্যানেজার সাহেব অবশ্য কখনো কিছু বলেন না। আপনি কি সত্যই স্বাধীন বাংলা সার্কাস কিনেছেন?
হুঁ।
কত টাকা দিয়ে কিনেছেন?
কত টাকা দিয়ে কিনেছি সেটা তোমাকে বলব কেন? তুমি আমার কর্মচারী, এর বেশি কিছু তো না। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ আপনি আপনি করেছি। এখন থেকে আর করব না। আমি আমার কোনো কর্মচারীর সঙ্গে আপনি আপনি করি না। এখনো দাঁড়ায়ে আছ কেন? বসো।
যাদু সম্রাট বসল। বশির মোল্লা গলা নামিয়ে বললেন, সার্কাসের ভেতরের খবর কিছু দাও দেখি।
মতিন শুকনো গলায় বলল, ভেতরের কোন খবর?
মেয়ে তিনটা সম্পর্কে বলো। এরা কি বাইরে ভাড়া খাটে?
মতিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। বশির মোল্লা বললেন, সার্কাসের কোনো লোকের সঙ্গে মেয়েগুলির লটপটি আছে?
মতিন তাকিয়ে আছে। কী বলবে কিছুই তার মাথায় আসছে না। কী অদ্ভুত মানুষ। এই মানুষটা কি সত্যি সত্যি সার্কাস কিনে নিয়েছে?
বশির মোল্লা বললেন, যাদু সম্রাট, তোমার পয়সা গিলে খাওয়ার ম্যাজিকটা কী ভাবে কর? পয়সা হাতের তালুতে লুকায়ে রাখ?
জি।
কীভাবে লুকায়ে রাখ আমাকে শিখায়ে দাও।
একদিনে শিখা যাবে না। পামিং বছরের পর বছর শিখতে হয়। আমি ওস্তাদের কাছে পামিং শিখেছি চার বছর।
তুমি বেকুব মানুষ। তোমার তো সময় বেশি লাগবেই। আমি তো তোমার মতো বেকুব না। আমি তাড়াতাড়ি শিখব। পয়সা কীভাবে লুকায় শিখাও দেখি।
বশির মোল্লা তার থাবার মতো হাত মেলে ধরলেন।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বশির মোল্লা একা একা তার ঘরেই বসা। ঠিক আগের জায়গাতেই বসা। তিনি হাতের তালুতে পয়সা নিয়ে পামিং প্র্যাকটিস করেই যাচ্ছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এর কৌশল এখন তার আয়ত্বে। মাঝে মধ্যে হাতের তালু থেকে পয়সা খসে যাচ্ছে, তবে বেশির ভাগ সময় লেগে থাকছে। পয়সা গিলে খাওয়ার খেলাটা বশির মোল্লা এখন ইচ্ছা করলেই দেখাতে পারবে। তার খেলা যাদু সম্রাট মতিনের মতো ভালো না হলেও খুব খারাপ হবে না।
বশির মোল্লা অপেক্ষা করছেন। তৈয়বের জন্যে অপেক্ষা। তৈয়বকে এখানে আসার জন্যে কোনো খবর পাঠানো হয় নি, তবে সে যে আসবে এটা নিশ্চিত। যাদু সম্রাট মতিন সার্কাস বিক্রির খবর ছড়িয়ে দেবে। তৈয়বের মতো বুদ্ধিমান লোক এই ধরনের গুজবের রহস্য ধরতে পারবে না তা হয় না। সে আসবেই। সে যদি বুদ্ধিমান হয় মেয়ে তিনটাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। বিনয়ী গলায় বলবে–স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তিনবোনকে সঙ্গে আনলাম। স্যার। বলেছিলেন এদের সঙ্গে কথা বলতে চান। আর যদি তৈয়বকে যতটা বুদ্ধিমান মনে করা হয়েছে ততটা বুদ্ধিমান সে না হয় তখন সে কী করবে?
ঘর অন্ধকার। বশির মোল্লা নিবিষ্ট মনে হাতের তালুতে পয়সা লুকানোর প্র্যাকটিস করে যাচ্ছেন।
মাগরেবের আজানের পর পরই তৈয়ব আলী ভিজতে ভিজতে এমভি সওদাগর লঞ্চে উঠে এলো। তার মুখ শান্ত। চলাফেরায় কোনো জড়তা নেই।
বশির মোল্লা আনন্দিত গলায় বললেন, তৈয়ব আস। আস। তোমার জন্যে অপেক্ষা। আমার দিকে তাকায়ে দেখ পুরোপুরি নেংটা হয়ে অপেক্ষা করছি। হা হা হা।
তৈয়ব বশির মোল্লার সামনে বসেছে। তার চোখে-মুখে কোনো বিকার নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে নেংটা পুরুষ মানুষের সামনে বসে তার অভ্যাস আছে।
বশির মোল্লা বললেন, তুমি যে চলে এলে আজ তোমাদের খেলা নাই।
তৈয়ব বলল, আজ একটু দেরিতে শুরু হবে। রাত আটটায়।
রাত আটটায় কেন?
শেষ শো, এই জন্যে রাত আটটা।
মাইকে বলছিল আরো এক সপ্তাহ চলবে।
তৈয়ব বলল, একটা ঝামেলা হয়ে গেল।
বশির মোল্লা আগ্রহী গলায় বললেন, কী ঝামেলা?
আমাদের মালিক হারুন সরকার মারা গেছেন।
বলো কী? কখন মারা গেলেন?
বিকেলে।
উনার ওয়ারিশান কে?
উনি বিবাহ করেন নাই। উনার আত্মীয়স্বজন কেউ নাই।
তাহলে সার্কাসের মালিকানা এখন কার?
তৈয়ব জবাব দিল না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করে সিগারেট ধরাল। বশির মোল্লা বললেন, আমার ধারণা সার্কাস এখন তোমার হাতে। আমার ধারণা কি ঠিক আছে?
তৈয়ব সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, সার্কাস আগে আমিই দেখতাম, এখনো আমি দেখব। তবে সার্কাসের মালিকানা আমার না। হারুন সরকার সার্কাসের মালিকানা তিনবোনকে দিয়ে গেছেন।
বশির মোল্লা বললেন, কেন?
তৈয়ব বলল–কেন সেটাই তো আমি জানি না। হারুন সরকার জানতেন। উনাকে জিজ্ঞেস করে এখন আর জানা যাবে না। তবে মেয়ে তিনটাকে খুব ছোটবেলায় উনি নিয়ে এসেছিলেন। খুবই আদর করতেন।
মেয়েরা জানে যে সার্কাসের মালিকানা তাদের?
না জানে না। এখনো কিছু বলি নাই।
অতি উত্তম কাজ করেছ। সার্কাস যে উনি দিয়ে গেছেন–মুখে মুখে। দিয়েছেন না-কি কাগজপত্র আছে?
স্ট্যাম্প পেপারে দলিল করে দিয়েছেন।
দলিল তোমার কাছে?
জি।
সঙ্গে আছে?
না সঙ্গে নাই।
বশির মোল্লা সিগারেটের জন্য তৈয়বের কাছে হাত বাড়ালেন। তৈয়ব তাকে সিগারেট দিল। বশির মোল্লা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, দলিল ছিড়ে ফেল।
তৈয়ব বলল, এই কাজ তো আমি করব না। আমি যার নুন খেয়েছি মরার আগের দিনও তার গুণ গাইব। আপনি যদি সার্কাস কিনতে চান তাহলে এই তিনবোনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
বশির মোল্লা সিগারেট হাতে একদৃষ্টিতে তৈয়বের দিকে তাকিয়ে আছে। তৈয়ব বলল, আপনি এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন যেন আমার মতো মানুষ আগে দেখেন নাই।
বশির মোল্লা জবাব দিলেন না। চোখ ফিরিয়ে নিলেন না। তৈয়ব বলল, আপনার বিরাট ব্যবসা-বাণিজ্য। অনেক লোকজন আপনার জন্যে খাটে। এদের মধ্যে আমার মতো দুই চারজন অবশ্যই আছে। যারা মালিকের জন্যে জীবন দিয়ে দিবে। আছে না?
হুঁ আছে।
স্যার আমি উঠি?
বশির মোল্লা জবাব দিলেন না। তৈয়ব বলল, মালিকানা বদলের পর আজ প্রথম শো। স্যার যদি সময় হয় চলে আসবেন। আপনার জন্যে একটা পাস নিয়ে এসেছি। তৈয়ব আলী পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাস বের করল। বশির মোল্লা হাত বাড়িয়ে পাস নিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দড়ির খেলা
কিছুক্ষণের মধ্যেই দড়ির খেলা শুরু হবে। তিনবোন গ্রিন রুমে বসে আছে। তিনজনই কাঁদছে। হারুন সরকার কখনো তাদের খুব কাছের মানুষ ছিল না। মানুষটা মারা যাবার পর তাদের কাছে মনে হচ্ছে মানুষটা আসলে খুব কাছের ছিল। সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে তাদের আড়াল করে রেখেছিল। তাদের কখনোই কোনো সমস্যা হয় নি। সার্কাসের মেয়েদের সার্কাসের বাইরেও অনেক। কুৎসিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে হয়। তাদের কখনো হতে হয় নি।
ঘণ্টা বেজে গেছে। এক্ষুণি তাদের স্টেজে ঢুকতে হবে। জামদানী বড় বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, বুব, আজ একসিডেন্ট হবে। আমার পা কাঁপছে। আমি মাটির উপর দাঁড়াতে পারছি না। দড়ির উপর কীভাবে দাঁড়াব? বুবু, ম্যানেজার সাহেবকে বলো— আজকের শোটায় আমরা থাকব না। আজ অবশ্যই একসিডেন্ট হবে। পা পিছলে আমি পড়ব। আমি পড়ে গেলে তোমরাও পড়ে যাবে।
ম্যানেজার তৈয়ব আলী ঘরে ঢুকল।
কঠিন গলায় বলল, দেরি হচ্ছে কেন?
জামদানী বলল, আজ আমার পা কাঁপছে।
তৈয়ব বলল, কোনো ফাজলামি কথা আমি শুনতে চাই না। এক্ষুণি দড়িতে গিয়ে উঠ।
একসিডেন্ট হলে?
একসিডেন্ট হলে হবে। শো শুরু হয়েছে শো বন্ধ হবে না। এক মিনিটের মধ্যেই আমি তিনজনকে দড়ির উপর দেখতে চাই।
তিনবোন দড়ির উপর উঠে এসেছে। তিনজনেরই পা টলমল করছে। সবচে’ বেশি করছে জামদানীর। তৈয়ব আলী তাঁবুর বাইরে এসে সিগারেট ধরাল। সার্কাসের মালিকানা হস্তান্তরের খবর তিনবোনকে এখনো দেয়া হয় নি। শোর শেষে দেয়া হবে। তিন বোনকে সে বলবে তারা যদি চায় তাহলে ম্যানেজারের দায়িত্ব সে পালন করবে। যদি না চায় সে দেশের বাড়িতে চলে যাবে। বিশ্রাম করবে। সার্কাসের ম্যানেজারি খুবই টেনশানের কাজ। এত টেনশন সে নিতে পারছে না।
তাঁবু ভর্তি মানুষ। এরা মুগ্ধ হয়ে দড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তিনবোনের একজন মনে হচ্ছে বারবার দড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছে। একবার তো এমন হলো ছোট মেয়েটা বিদ্যুতের মতো এসে একজনকে ধরল। ছিটকে নিচে পড়া থেকে বাঁচল।
নি পোর্টার হাসিমুখে ভিডিও করছে। আজ সে নিচ্ছে দর্শকদের রিএকশান। আজ তার কাছে মনে হচ্ছে সার্কাসের মেয়ে তিনটির খেলার চেয়েও অনেক মজা দর্শকদের রিএকশন দেখা।
নি পোর্টারের চেয়ারের পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক বলল– ও আল্লা, কইলজা কাঁপতাছে। পইড়া যাইব তো।
নি পোর্টার বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল–আপনি ভয় পাবেন না। ওরা এক্সপার্ট। ওরা দড়ি থেকে পড়বে না। ওরা দড়ি থেকে পড়ে যাবার অভিনয় করছে।
বৃদ্ধ বলল–জনাব, ভয় কাটতাছে না। আমি সমানে দোয়া দুরুদ পড়তেছি। আমি এরার পিতা। এরার মাতাকে সন্ধান করতে করতে এখানে এসেছি। সবচে বড় যে মেয়েটা দেখতেছেন–তার নাম আসমানী বেগম। মেজোটার নাম জামদানী বেগম। সবচে ছোটটার নাম–মোসাম্মত পয়সা কুমারী। জনাব কী করি বলেন, বড় ভয় লাগতাছে।
নি পোর্টার বৃদ্ধের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ দুহাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে।
দর্শকদের ভেতর তুমুল উত্তেজনা। এখন শুরু হয়েছে সবচে ভয়ঙ্কর অংশ–দড়ির উপর দিয়ে ছোটাছুটি করা। সবচে ছোটমেয়েটা একা দড়ির উপর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। এক মাথায় যাচ্ছে। নিমিষের মধ্যে অন্য মাথায় চলে আসছে। সার্কাসের ব্যান্ড তুমুল বাদ্য বাজাচ্ছে।
জমির আলী বিড়বিড় করে বলছে–আম্মাজি। মোসাম্মত পয়সা কুমারী। নাইম্যা আস। আমার বড় ভয় লাগতাছে গো মা।