লিলিয়ান অন্যদিকে তাকিয়ে হাসল। তাহের বলল, আমি কফি নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আমার আসতে খানিকটা দেরি হবে। আমার জন্মদিন উপলক্ষে একটা ভালো হোটেলে আমি তোমাকে নিয়ে খেতে যাব। দুশ্চিন্তাগ্ৰস্ত হবার কোনো কারণ নেই। খাওয়ার শেষে আমি তোমাকে তোমার আপার্টমেন্টে পৌঁছে দেব। তুমি যে এসেছ এতেই আমি খুশি। এর বেশি আমি কিছু আশা করি নি। যা হয়েছে তাই যথেষ্ট। যদিও জানি না–ঘটনা এমন কেন ঘটল। ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। তোমার ইচ্ছা করলে তুমি ব্যাখ্যা করবে। ইচ্ছা না করলে করতে হবে না।
তাহের ঘর ছেড়ে চলে গেল। লিলিয়ান উঠে দরজা বন্ধ করল। টেলিফোন করল তার মাকে। লিলিয়ানের মা আতঙ্ক মেশানো গলায় বললেন, আমি এর মধ্যে তিনবার তোর আপার্টমেন্টে টেলিফোন করেছি। আমরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির।
চিন্তার কিছু নেই মা।
তুই কি গিয়েছিলি কোনো ডাক্তারের কাছে?
হ্যাঁ।
ডাক্তার কী বললেন?
ডাক্তার নতুন কিছু বলে নি। আমি যা জানতাম তাই বলেছেন।
আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারছি না। তুই কী জানতি?
লিলিয়ান হাসল। শব্দ করে হাসল। লিলিয়ানের মা বললেন, কী হলো হাসছিস কেন?
হাসি আসছে তাই হাসছি?
তুই এখন কোথায়?
কেন আমার আপার্টমেন্টে।
না, তুই অন্য কোনো জায়গায়।
কী করে বুঝলে?
আমি জানি। আমার মন বলছে। তুই কি ঐ ছেলেটির কাছে?
হ্যাঁ।
কেন–ঐখানে কেন? কী হচ্ছে লিলিয়ান?
ভয়ের কিছু নেই মা!
অবশ্যই ভয়ের কিছু। তুই কেন ঐ ছেলের কাছে গেলি?
লিলিয়ান খানিকক্ষণ চুপ করে বাইল। ওপাশ থেকে ভদ্রমহিলা বারবার বলতে লাগলেন–হ্যালো হ্যালো।
মা শোন, আমি খুব সম্ভব এই ভদ্রলোককে বিয়ে করব।
কী বলছিস তুই?
আমি এখনো জানি না। ভদ্রলোক এখানে নেই। তিনি কফি কিনতে গিয়েছেন। ফিরে এলেই তাকে বলব।
কী বলবি?
বলব যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। যদি রাজি থাকেন তবেই শুধু আপনার সঙ্গে কফি খাব এবং রাতে ডিনার করতে যাব।
হা ঈশ্বর! মা তুই কী বলছিস? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে মা। আমি নিশ্চিত তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
অস্থির হয়ে না মা। আমার মাথা খারাপ হয় নি। মাথা ঠিক আছে। আর এক্ষুণি তোমাদের চিন্তিত হতে হবে না। হয়তো বিয়েতে ভদ্রলোক রাজি হবেন না। হয়তো বলবেন–তিনি বিবাহিত।
লোকটা বিবাহিত কি-না তাও তুই জানিস না?
না।
হা ঈশ্বর! এসব কী শুনছি।
কথায় কথায় হা ঈশ্বর বলবে না। মা! শুনতে ভালো লাগছে না।
লিলিয়ান লক্ষ্মী মা, তুই দেশে চলে আয়। তোকে পড়াশোনা করতে হবে না।
কাদছ কেন মা? আমি তো ভয়ঙ্কর কিছু করছি না।
তুই তোর পজার চাচার সঙ্গে কথা বল।
আমি এখন কারো সঙ্গে কথা বলব না।
তোর বাবার সঙ্গে কথা বল।
বললাম তো মা, আমি এখন কারো সঙ্গে কথা বলব ন।
হা ঈশ্বর! আমি এ কী শুনছি?
লিলিয়ান শান্ত স্বরে বলল, ঈশ্বরের প্রতি তোমার অবিচল ভক্তি। কাজেই তুমি ধরে নাও–যা হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছার আগোচরে হচ্ছে না।
লিলিয়ান মা লিলিয়ান…
টেলিফোন রাখছি মা। তুমি ভালো থেকে।
লিলিয়ানের মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। লিলিয়ান জানালার পাশে দাঁড়াল। বরফ পড়তে শুরু করেছে–বছরের প্রথম বরফ। ইচ্ছে করছে ববফেব ভেতর ছুটে যেতে। সারা গায়ে বরফ মাখতে। লিলিয়ান খানিকক্ষণ বরফ পড়া দেখল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার জন্যই বোধহয় তার চোখ জ্বালা করছে। সে বাথরুমে ঢুকে চোখে পানি দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল। ফিসফিস কবে বলল, মা রাগ করো না। আমি কী করছি আমি নিজেও জানি না। এর ফল শুভ হবে, কি শুভ হবে না। তাও জানি না। শুধু একটা জিনিস জানি–আমৃত্যু আমাকে অচেনা-অজানা এই ছেলেটির সঙ্গে থাকতে হবে। এর থেকে আমার মুক্তি নেই। কিংবা কে জানে আমার মুক্তি হয়তো বন্ধনের ভেতরই ঘটবে।
দরজায় কলিং বেল বাজছে। লিলিয়ান দরজা খুলে দিল। তাহের মুগ্ধ গলায় বলল, বাইরে বরফ পড়ছে দেখেছ?
হ্যাঁ।
গায়ে বরফ মাখবে?
হ্যাঁ মাখব!
বাহু চমৎকার। আমাদের দেশে বরফ নেই, তবে বৃষ্টি আছে। বৎসরের প্রথম বৃষ্টি হলে আমরা বৃষ্টিতে ভিাজ, এতে গায়ের ঘামাচি নষ্ট হয়। বরফে কিছু নষ্ট হয় কি-না কে জানে!
তোমাদের দেশের বৃষ্টি কি তুষারপাতের চেয়েও সুন্দর?
লক্ষ গুণ সুন্দর। আমাদের দেশের প্রথম বৃষ্টিতে কী হয় জানো–এক ধরনের মাছ আছে–নাম হলো কৈ মাছ। এরা এত আনন্দিত হয় যে দলবেঁধে পানি ছেড়ে শুকনায় উঠে আসে।
কেন আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?
মোটেই ঠাট্টা করছি না। তোমাকে আমি দেশে নিয়ে গিয়ে নিজের চোখে দেখাব তখন তুমি…
তাহের কথা শেষ করল না, থেমে গেল। বিব্ৰত চোখে লিলিয়ানের দিকে তাকাল লিলিয়ানও তাকিয়ে আছে। লিলিয়ানের চোখে চাপা দ্যুতি।
ওদের বিয়ে হতে দশ দিন লাগল
ওদের বিয়ে হতে দশ দিন লাগল। বিয়ের লাইসেন্স বের করা এদেশে অনেক যন্ত্রণা। অনেক টেস্ট-ফেস্ট করতে হয়। ডাক্তাররা আগে নিশ্চিত হয়ে নেন এই দম্পতির সন্তান বংশগত কোনো রোগের শিকার হবে না। তারপরই সার্টিফিকেট দেন। সেই সাটিফিকেট দেখিয়ে লাইসেন্সের জন্য দরখাস্ত করতে হয়।
বিয়ের পরপব লিলিয়ান ডা. ভাবমানের সঙ্গে দেখা করতে গেল। ডা. ভারমান চশমার ফাঁক দিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, মিস থেকে মিসেস হয়েছ?
হ্যাঁ। কী কবে বুঝলেন? আমার কপালে তো লেখা নেই মিসেস।
অবশ্যই লেখা আছে। সেই লেখা সবাই পড়তে পারে না। আমি পারি। তুমি কি ঐ ছেলেটিকেই বিয়ে করেছ?