লিলিয়ান উঠে দাঁড়াল। ফিরে গেল আপার্টমেন্টে। প্রায় এক ঘণ্টার মতো চুপচাপ বিছানায় শুয়ে রইল। তারপর উঠে হাতে মুখে পানি ছিটাল। সে তার সবচে সুন্দর পোশাকটা পরল। অনেক সময় নিয়ে চুল আঁচড়াল। তার সম্বল অল্প কিছু ডলাবেল সব কটা সঙ্গে নিয়ে বেরুল। সে তাহেরকে খুঁজে বের করবে। এই শহরের মেডিকেল স্কুলের একজন বিদেশী ছাত্রের ঠিকানা বের করা কঠিন হবার কথা না। তবে লিলিয়ান প্রথমে গেল। ডাউন টাউনের এক ফুলের দোকানে। দশ ডলার দিয়ে সে পঁচিশটা চমৎকার গোলাপ কিনল। আধ ফোঁটা গোলাপ! আগুনের মতো টকটকে রঙ। চিরকাল ছেলেরাই মেয়েদের জন্য ফুল কিনেছে। মাঝে-মধ্যে নিয়মেব হেরফের হলে কিছু যায় আসে না।
কলিং বেল টেপার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। তাহের খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, এসো লিলিয়ান। তার কথা বলার ভঙ্গি থেকে মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে সে লিলিয়ানের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
লিলিয়ান বলল, আমি যে এখানে আসব তা কি আপনি জানতেন?
তাহের বলল, জানব কী করে–আগে তো বলো নি।
আমাকে দেখে অবাক হন নি?
আমি এত সহজে অবাক হই না। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে বাবা রিকশা থেকে পড়ে গেলেন। নেমে গিয়ে দেখি মরে পড়ে আছেন। সেই থেকে অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
লিলিয়ানের চোখে-মুখে হকচকিত ভাব। তার ফর্সা কপাল ঘামছে। হাতের গোলাপগুলি নিয়েও সে বিব্রত। তাহের বলল, ফুলগুলি কি আমার জন্য?
হুঁ।
দাও আমার হাতে। তুমি বসে।
না।
দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এসেছ?
লিলিয়ান কী বলবে বুঝতে পারছে না। সত্যি তো সে কী জন্য এসেছে? কেনই বা এসেছে? সে তাকাল চারদিকে। অবিবাহিত পুরুষের ঘর। একপলকেই বোঝা যায়। টেবিলে বা দেয়ালে কোনো তরুণীর ছবি নেই। এটা একটা বড় ব্যাপার। বিছানার কাছে পিন আপ পত্রিকা নেই। লিলিয়ান ক্ষীণ গলায় বলল, আমি এখন চলে যাব।
চলে যাবে ভালো কথা–চলে যাও। হঠাৎ করে একগাদা ফুল নিয়ে এসে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে চলে যাওয়া ভালো।
আপনাকে বিব্রত করার জন্য আমি দুঃখিত।
আমি মোটেও বিব্রত হই নি। বিস্মিত হচ্ছি। অন্যদের বিস্ময় যেমন চোখে-মুখে ফুটে উঠে আমার বেলায় তা হয় না বলেই তোমার কাছে মনে হচ্ছে। আমি পুরো ব্যাপারটা খুব সহজভাবে নিচ্ছি। আসলে তা না। আমার ঠিকানা কোথায় পেলে?
জোগাড় করেছি।
কেন?
লিলিয়ান চুপ করে রইল। তাহেরের মনে হলো এই মেয়ে আর কোনো প্রশ্নের জবাব দেবে না। মেয়েটিকে সহজ করার কোনো পথও সে খুঁজে পাচ্ছে না। কী বললে সে সহজ হবে?
লিলিয়ান, তুমি কি পেট্রিফায়েড ফরেস্টটা দেখতে চাও? ঐদিন আমি যাই নি। তুমি যেতে চাইলে আজ যেতে পারি। সন্ধ্যায্য সন্ধায় চলে আসতে পাবীব।
আমি আমার আপাটমেন্টে ফিরে যাব।
বেশ তো ফিরে যাবে। আমি তোমাকে পৌঁছে দেব।
আপনাকে পৌঁছে দিতে হবে না।
তুমি লক্ষ কর নি বোধহয়–বাইরে খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। এই ঠাণ্ডায তুমি এমন পাতলা কাপড় পরে কী করে এসেছি সেও এক রহস্য। তুমি আমার সঙ্গে যেতে না চাইলে একাই যাবে–আমার একটা ওভারকেট আছে, সেটা গাযে চাপিয়ে চলে যেতে পারবে। না-কি আমার ওভারকেটও গায়ে দেবে না?
লিলিয়ান বসল। সে যে বসেছে তাতে সে নিজেও অবাক হয়েছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নে ঘটছে। সে নিজের ইচ্ছেতে কিছু করছে না। যা তাকে করতে বলা হচ্ছে তাই সে করছে। পুবে ঘটনা অন্য কেউ ঘটাচ্ছে। সে অন্য কেউটা কে?
লিলিয়ান।
হুঁ।
কফি খাবে?
হুঁ।
শুনে খুশি হলাম। আমি কফি তৈরি করছি। তুমি সহজ এবং স্বাভাবিক হতে চেষ্টা কর। তারপর তোমার কাছে কয়েকটা জিনিস জেনে নেব। যা যা জানতে চাই তাও বলে নিচ্ছি–এক, হঠাৎ তুমি একগাদা ফুল নিয়ে আমার কাছে কেন এসেছ? দুই, আজ যে আমার জন্মদিন তা-কি তুমি জানো? যদি জানো তাহলে কীভাবে জানো?
লিলিয়ান বিস্মিত হয়ে বলল, আজ। আপনার জন্মদিন?
তাহের বলল, আমি দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব পেয়ে গেছি। আজ যে আমার জন্মদিন তা তুমি জানো না। এখন বাকি রইল প্রথম প্রশ্ন। তুমি প্রশ্নটির জবাব নিয়ে ভাবতে থাক। আমি একটু গ্রোসরি শপে যাব। ঘরে কফি, চিনি, ক্রিম কিছুই নেই।
আমি কি আপনার এখান থেকে একটা টেলিফোন করতে পারি?
হ্যাঁ পার।
একটা লং ডিসটেন্স কল করব।
একটা কেন, দশটা কর। তুমি আমার এখানে আসায় আমি নিজে যে কী পরিমাণ খুশি হয়েছি তা কোনোদিন তুমি বুঝবে না। প্রথম দেখাতেই ভালোবাসা–এই জাতীয় কিছু কথা সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এই জাতীয় বায়বীয় কথা আমি কখনো বিশ্বাস করতাম না। তোমাকে ওল্ড ফেইথফুল লেকের কাছে দেখে প্রথম মনে হলোসাহিত্যের এই কথাটা মিথ্যা না। মেয়েদের পেছনে ঘোরা আমার স্বভাব নয়। তারপবেও আমি খুঁজে খুঁজে তোমার আপার্টমেন্ট বের করেছি। ঐদিন তোমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে দেখা হলো। তোমার বোধহয় ধারণা পুরো ব্যাপারটা কাকতালীয়। আসলে তা না। আমি প্রায়ই তোমাদের মেমোরিয়াল ইউনিয়নে বসে থাকতাম। এই আশায় যে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। দেখা হলেই বলব, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম… । কবে। কোথায় কোন রুমে তোমার ক্লাস তাও আমি জানি–প্ৰমাণ দেব?
লিলিয়ান তাকিয়ে আছে, কিছু বলছে না। তাহের আগের মতোই সহজ স্বাভাবিক ভুঞ্জিলিল, আজ ছিল তোমার টার্স পেপার জমা দেয়ার শেষ দিন। আমি কি ঠিক বলেছি?