লিলিয়ান যার কাছে গেল তাঁর নাম ভারমান। ডা. এঙ্গেলস ভারমান। ভদ্রলোক ভারিক্কি ধরনের বেঁটেখাট মানুষ। তাঁর মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ। চুল-দাড়ি সবই পাকা। ফর্স গায়ের রঙের সঙ্গে চুলের রঙ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঝুলে আছে নাকের উপর। ভদ্রলোক তাকালেন চশমার ফ্রেমের উপর দিয়ে। লিলিয়ানের মনে হলো–ভদ্রলোকের চোখ সুন্দর। তিনি তাকাচ্ছেন মমতা নিয়ে। ডাক্তাররা যখন রোগীর দিকে তাকান তখন রোগটাকে দেখার চেষ্টা করেন, মানুষটাকে নয়। এই ডাক্তার মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করছেন।
লিলিয়ান বলল, গুড মর্নিং ডা. এঙ্গেলস ভারমান।
গুড মর্নিং লিটল মিস।
আমার নাম লিলিয়ান।
গুড মর্নিং লিটল মিস লিলিয়ান।
গুড মর্নিং স্যার।
বলো তো লিলিয়ান, তুমি কেমন আছ?
আমি খুব ভালো নেই।
শুনে খুশি হলাম। সারাক্ষণ ভালো থাকা কোনো কাজের কথা না। তোমরা যদি সারাক্ষণ ভালো থাক তাহলে আমরা কী করব? তোমার সমস্যা কী তা এখন বলো। সহজভাবে বলো। খোলাখুলি বলো।
আমার ঘুম হচ্ছে না।
এটা কোনো সমস্যাই না। ঘুম না হলে এক লক্ষ ধরনের ঘুমের ওষুধ আছে। আর কী সমস্যা?
ঘুমুলেই দুঃস্বপ্ন দেখি।
তুমি তো ভালো আছ, ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখ। আমি দেখি জেগে জেগে। চাবদিকে যা দেখছি সবই দুঃস্বপ্ন। গতকাল কী হয়েছে শোন–সাবওয়ে দিয়ে আসছি, আমার চোখের সামনে একজন মহিলার ব্যােগ এক কালো ছোকরা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাল। এতগুলি লোক আমরা, কেউ কোনো কথা বললাম না। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। এটা কি বড় ধরনের দুঃস্বপ্ন না?
আপনিও কিছু বলেন নি?
না। আমি হচ্ছি অবজাবভার, আমি বসে বসে দেখেছি।
লিলিয়ান বলল, অন্যরাও হয়তো আপনার মতো কোনো অজুহাত তৈরি কবে বসে ছিল।
ডা. এঙ্গেলস ভাবমান হাসতে হাসতে বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমার কোনো সমস্যা থাকার কথা না। সমস্যা হয় কম বুদ্ধির মানুষদের। এরা কিছু বুঝতে চায় না। কিন্তু তুমি বুঝবে। যুক্তি দিয়ে বোঝালে বুঝবে। এখন সুন্দর করে তোমার সমস্যা বলো। না-কি বলার আগে কফি খেয়ে নেবে?
কফি খাব।
ঐ টেবিলে কফি মেকার আছে। তোমার জন্য আন এবং আমার জন্য আন। কফির কাঁপে চুমুক দিতে দিতে তোমার সমস্যার কথা বলো। আমার বদঅভ্যাস হচ্ছে, আমি চশমার ফাঁক দিয়ে তাকাই। আশা করি এতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আমার চোখ খুব সুন্দর। ঠিক বলি নি?
জ্বি, ঠিক বলেছেন।
লিলিয়ান খুব গুছিয়ে তার সমস্যার কথা বলল। ডা. ভারমান কোনো প্রশ্ন করলেন না। চুপচাপ শুনে গেলেন। এক ফাকে উঠে গিয়ে আবার কফির পেয়ালা ভর্তি করে আনলেন। লিলিয়ান কথা শেষ কববার পর ডা. ভারমান মুখ খুললেন। তিনি নরম গলায় বললেন, তোমার পরিবারে লোক সংখ্যা কত?
অনেক। আমাদের যৌথ পরিবার। আমার দুচাচা এবং বাবা… ..এরা তিন ভাই একসঙ্গে থাকেন।
একত্রে রান্না হয়?
হ্যাঁ, এক সঙ্গে রান্না হয়। তবে আমাদের পজার চাচা কিছুদিন পরপর রাগ করে বলেন এখন থেকে তিনি আলাদা রান্নাবান্না করবেন। কারো সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। দুএকদিন আলাদা রান্না হয়, তাবপর আবার আগের জায়গায় ফিরে আসেন।
তোমাদের চাচাদের মধ্যে কি খুব মিল?
মোটেও মিল নেই। সারাক্ষণ তাঁরা ঝগড়া করছেন, কিন্তু তারপরেও একজন অন্যজনদের ছাড়া থাকতে পাবেন না। আমার মনে হয় ঝগড়া করার জন্যই তাদের একসঙ্গে থাকা প্রয়োজন। ব্যাপারটা বেশ মজার।
তুমিই প্রথম বাইরে পড়তে এসেছ?
জ্বি।
তুমি যখন বিদেশে রওনা হলে তখন তোমার পরিবারের সদস্যরা কী করল? সবাই খুব কাদল। আমার পজার চাচা পুরো একদিন এক রাত না খেয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে ছিলেন। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে খাওয়ানো হয়।
ডা. ভারমান পাইপ ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমার সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে তোমার পরিবার। তুমি এমন এক ক্লোজ পরিবার থেকে এসেছি যে পরিবারের সদস্যরা ভালোবাসার কঠিন জালে তোমাকে আটকে রেখেছে। তুমি জাল ছিড়তে চাচ্ছ–পারছি না।
আপনি ভুল বললেন–আমি জাল ছিঁড়তে চাচ্ছি না।
তুমি চাচ্ছ কিন্তু তোমার মন তাতে সায় দিচ্ছে না। তোমার মনে একই সঙ্গে দুটি বিপরীত ধারা কাজ করছে। একটি ধারা তোমাকে জাল কেটে বেরিয়ে আসতে বলছে, অন্যটি তা করতে দিচ্ছে না। এতে মনে প্ৰচণ্ড চাপ পড়ছে।
এর সঙ্গে আমার দুঃস্বপ্নের সম্পর্ক কী? আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি অন্য একজনকে নিয়ে।
সম্পর্ক আছে… । ঐ ছেলেটিকে দেখেই তোমার জাল কেটে বেরিয়ে আসবার কথা মনে হলো। তোমার মনের একটি অংশ তাতে সায় দিল না। সৃষ্টি হলো প্রচণ্ড চাপের। দুঃস্বপ্নগুলি চাপের ফল, আর কিছুই না। ছেলেটিকে তোমার খুব ভালো লেগে গেছেতুমি তা স্বীকার করতে চাচ্ছি না।
ছেলেটিকে ভালো লাগার কিছু নেই।
আমার ধারণা আছে। তুমি তোমার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাকে সবচে ভালোবাসো?
পজার চাচাকে।
চরিত্রের কোন কোন মিল আছে?
ভালো করে চিন্তা কর। আমার ধারণা মিল আছে।
পজার চাচা অকারণে হো-হো করে হাসেন। ঐ ছেলেটিও হাসে।
আর?
এইসব নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগছে না।
আমি যে তোমার সমস্যাটা ধরিয়ে দিয়েছি তা-কি বুঝতে পেরেছ?
লিলিয়ান জবাব দিল না। ডা. ভারমান হাসলেন। লিলিয়ান বলল, আমাকে আপনি কী করতে বলেন?
উপদেশ চাচ্ছি?
হ্যাঁ।
আমি তোমাকে কোনো উপদেশ দেব না। তুমি কী করবে না করবে তা তোমার ব্যাপার। আমি সমস্যা ধরিয়ে দিয়েছি। সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তোমার। কারণ সমস্যাটা তোমার, আমার নয়।