লিলিয়ান বলল, আর আসতে হবে না। আমি যাচ্ছি।
তাহের বলল, আবার দেখা হবে। ভালো থাক–রাত জেগে জেগে তুমি যে উচ্চ শ্রেণীর মানব সন্তান তা প্ৰমাণ করতে থাক। হা হা হা। ভালো কথা, তুমি কি আমার টেলিফোন নাম্বার রাখবে? রাতে দুঃস্বপ্ন দেখলে টেলিফোন করতে পার।
আমি অন্যের টেলিফোন নাম্বার রাখি না।
অন্যের টেলিফোন নাম্বারই তো রাখতে হয়। নিজেরটা তো মনেই থাকে। হা হা হা।
আমি যাচ্ছি।
লিলিয়ান দ্রুত করিডোরে চলে এলো। সে এমনিতেই দ্রুত হাঁটে, আজ আরো দ্রুত হাঁটছে। মেমোরিয়েল ইউনিয়নের বাইরে এসে হাঁপ ছাড়ল। পেছনে ফিরে তাকাল। তাহেরকে দেখা যাচ্ছে না। নাছোড়বান্দা হয়ে সে যে পেছনে পেছনে আসে নি–এতেই লিলিয়ান আনন্দিত।
লিলিয়ান তার আপার্টমেন্টে ফিরল না। কাঁধে ব্যাগ বুলিয়ে হাঁটতে বের হলো। আজ সারাদিন সে হাঁটবে। হেঁটে হেঁটে এমন ক্লান্ত হবে যে বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমুতে যাবার আগে হাট শাওয়ার নেবে। এক গ্লাস আগুন গরম দুধ খাবে। বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে রাখবে। তার ঘুমের সমস্যা আছে। এক রাত ঘুম না হলে পর পর কয়েক রাত ঘুম হয় না।
বেশিক্ষণ হাঁটতে হলো না। অল্প হেঁটেই লিলিয়ান ক্লান্ত হয়ে পড়ল। হলগুলিতে ঘুরতে এখন আর ভালো লাগছে না। ইচ্ছা করছে আপার্টমেন্টে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়তে। এখন বিছানায় যাওয়াটা হবে বিপদজনক। খানিকক্ষণ ঘুম হবে, কিন্তু রাতটা কাটবে অঘুমো। লিলিয়ান স্যান্ডউইচ কিনল। পার্কে বসে একা একা খেল। একা একা খাওয়া খুব কষ্টের। খাবার সময় একজন কেউ পাশে থাকা দরকার। যে প্রয়োজনেঅপ্ৰয়োজনে কথা বলবে। হাসবে। লিলিয়ানের এমন কেউ নেই। কোনোদিন কি হবে? প্রিয় একজন কি থাকবে পাশে? কে হবে সেই মানুষটি? চার্চের পাদ্রি মাথায় হলি ওয়াটার ছিটিয়ে, বুকে ক্রশ স্পর্শ করে বলবেন–
তোমাদের দুজনকে আমি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করলাম। মৃত্যু এসে তোমাদের বিচ্ছিন্ন না করা পর্যন্ত একজন থাকবে অন্যোব পাশে, সুখে দুঃখে, আনন্দে বেদনায়। Till death do you part.
লিলিয়ানের চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে পার্কের অপরূপ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। মন শান্ত হচ্ছে না। সে একধরনের হাহাকার বোধ করছে–মনে হচ্ছে এই অপরূপ দৃশ্য একা দেখাব নয়। দুজনে মিলে দেখার।
লিলিয়ান আপার্টমেন্টে ফিরুল সন্ধ্যা মিলাবার পর। ক্লাস্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়ছে। মনে হচ্ছে এক সেকেন্ডও সে জেগে থাকতে পারবে না। হট শাওয়াব নেয়া, গরম দুধ খাওয়া, বিছানার চাদর বদলানো কিছুই তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে দাবজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। গাঢ় গভীর ঘুম। যে ঘুমের সময় মানুষ মানুষ থাকে না, পাথরের মতো হয়ে যায়। গভীব ঘুমের স্বপ্নগুলি অন্যরকম হয়। স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না। বাস্তবের কাছাকাছি চলে যায়। হালকা ঘুমের স্বপ্নগুলি হয়। হালকা, অস্পষ্ট কিছু লজিক বিহীন এলোমেলো ছবি। গাঢ় ঘুমের স্বপ্নস্পষ্ট, যুক্তিনির্ভর।
আজ লিলিয়ান দেখল গাঢ় ঘুমের স্বপ্ন। স্বপ্নে সে এবং তাহের দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছে। তাহের ঘুমুচ্ছে, সে জেগে আছে। ঘুমের মধ্যে তাহের অফুট শব্দ করল। লিলিয়ান হাত রাখল। তাহেরের গায়ে। হাত ভেজা ভেজা লাগছে। সে চোখের সামনে হাত মেলে ধরল। হাত রক্তে লাল। সে চেঁচিয়ে উঠল। লিলিয়ানের ঘুম ভাঙল নিজের চিৎকারে। বাকি রাত সে ঘুমুল না। জেগে বসে রইল। ভোরবেলা টেলিফোন করল মাকে।
কেমন আছ মা?
আমি ভালো আছি। তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? তোর কী হয়েছে?
কদিন ধরে আমি খুব দুঃস্বপ্ন দেখছি।
কী দুঃস্বপ্ন?
ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন। একটা বিদেশী ছেলেকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন।
এ ছেলের সঙ্গে কি তোর পরিচয় আছে?
না। দুদিন কথা হয়েছে।
কী রকম কথা?
সাধারণ কথা মা। তেমন কিছু না।
ছেলেটার মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যা দেখে তুই ভয় পেয়েছিস।
তেমন কিছু নেই মা। ভালো ছেলে।
দুদিনের আলাপে কী করে বুঝলি ভালো ছেলে?
লিলিয়ান জবাব দিল না। তার মা কয়েকবার বললেন, হ্যালো হ্যালো–লিলিয়ান নতে পাচ্ছিস? আমি তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না–হ্যালো হ্যালো।
লিলিয়ানের সবচে ছোটবোন রওনি কাঁদছে। রান্নাঘরে মা নিশ্চয়ই কল ছেড়ে রেখেছে–পানি পড়ার শব্দ আসছে।
হ্যালো, লিলিয়ান। হ্যালো… ..টেলিফোনটায় কী হলো কিছু শুনতে পারছি না।
লিলিয়ান বলল, মা রওনি কাঁদছে। তুমি ওকে দেখ–আমি টেলিফোন রাখলাম…
না না। টেলিফোন রাখিস না। তুই আমার কথা শোন মা… ..তুই একজন ভালো ডাক্তার দেখা। টাকা। যা লাগে লাগুক… ..আমি যেভাবেই হোক ডলার পাঠাব। কিছু দিন পর পর তুই এমন দুঃস্বপ্ন দেখিস। এটা তো ভালো কথা না।
টেলিফোন বাখলাম মা।
না না না…।
লিলিয়ান টেলিফোন রাখল না। কানে লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এখনো রওনির কান্না শোনা যাচ্ছে। বাথরুমের ট্যাপ দিয়ে পানি পড়াবা শব্দ আসছে, কেউ একজন বোধহয় এসেছে তাদের বাড়িতে, কলিঃ বেল টিপছে… ..ক্রমাগত বেল বাজছে। লিলিয়ানের মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে যাচ্ছেন, হ্যালো লিলিয়ান হ্যালো। কী হলো টেলিফোনটায়–কোনো কথা শুনতে পাচ্ছি না। অপারেটর হ্যালো অপারেটর…
লিলিয়ান মার কথা অগ্রাহ্য করল না। কোনো দিন করেও না। সে একজন সাইকিয়াট্রিস্টেব সঙ্গে কথা বলতে গেল। ইউনিভার্সিটিব সাইকিযাট্রিষ্ট। এরা বলে স্টুডেন্ট কাউন্সিলার। ছাত্র-ছাত্রীদের নানান ধরনে? সমস্যা নিয়ে এঁরা কথা বলেন। এক সময় ছাত্ৰ-ছাত্রীদেব সমস্যা ছিল পড়াশোনা কেন্দ্ৰক–কোর্স ভালো লাগছে না, গ্রেড খারাপ হচ্ছে এই জাতীয়। এখনকার সমস্যা বেশির ভাগই মানসিক। যে কারণে স্টুডেন্ট কাউন্সিলারদের মধ্যে অন্তৰ্গত একজন থাকেন সাইকিয়াট্রিষ্ট।