সে একতলায় নেমে এসেছে। তার সামনেই এ বাড়ির ভাঙা প্রাচীর। ফিসফিস কথা শোনা যাচ্ছে। নিচেও কি কেউ অপেক্ষ ধরছে তার জন্যে? না-কি ওরাই নেমে এসেছে নিচে? দোতলা থেকে টর্চের আলো ফেলল। সিঁড়িতে। আলো এদিক-ওদিক যাচ্ছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে লিলিয়ানকে। আর একটু হলেই সে অ্যালো পড়ত লিলিয়ানের মুখে। লিলিয়ান ক্লান্ত গলায় ফিসফিস করে বলল, আমাকে সাহায্য করুন। আমাকে সাহায্য করুন, Please help me.
কার কাছে সে সাহায্য চেয়েছে? উত্তেজিত বিভ্রান্ত মস্তিষ্কের কাছে, না-কি যে অশবীবী নারী তার হাত ধরেছিল তার কাছে। লিলিয়ান জানে না। সে জানতে ও চায় ন। প্রয়োজন হলে সে চোখ বন্ধ করে থাকবে। অশরীরী নারীমূর্তি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাক। লিলিয়ান আবারও বলল, আপনি কোথায়? আপনি আমাকে সাহায্য করুন।
আর ঠিক তখন সে নারীমূর্তিকে দেখতে পেল। ভাঙা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্ৰকাণ্ড শিরীষ গাছের আড়ালে সে দাঁড়িয়ে। সে হাত ইশারায় লিলিয়ানকে ডাকল। লিলিয়ান মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেল।
নারীমূর্তি সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আগে আগে যাচ্ছে। পেছনে পেছনে এগুচ্ছে লিলিয়ান। পাঁচিলের বাইরে এসেই নারীমূর্তি ছুটতে শুরু করল। সে লিলিয়ানকে কিছুই বলে নি। তবু লিলিয়ানের মনে হলো তাকে যেন এই অশরীরী মূর্তি বলছে–ভয় পেও না। তুমি আমার পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাক।
আমরাগান ছাড়িয়ে, খোলা মাঠ, আবার খানিক ঝোপঝাড়, চাষা ক্ষেত। নারীমূর্তি দ্রুত ছুটছে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। লিলিয়ান কাতর গলায় বলল, পারছি না। আমি পারছি না–একটু থামুন, Please একটু থামুন। নারীমূর্তি থামছে না। ছুটছে, আরো দ্রুত ছুটছে।
তারা এক সময় চলে এলো নদীর তীরে। আর তখনই মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ স্পষ্ট হলো। ঝলমল করে উঠল। নদী ও নদীর ওপাশের বনভূমি। নারীমূর্তি থমকে দাঁড়িয়েছে। হাত ইশারায় নদীর তীরে পড়ে থাকা কী একটা যেন দেখাচ্ছে। লিলিয়ান সেদিকে তাকাচ্ছে না। সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে নারীমূর্তির দিকে।
কী সুন্দর। মায়াময় একটি মুখ। লম্বা বিনুনী করা চুল। শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে। লিলিয়ান বলল, আপনি কে? আপনি কি আমার কল্পনা না-কি সত্যি কিছু?
নারীমূর্তি হাসল। কী সুন্দর সে হাসি। লিলিয়ান হাসির শব্দও শুনল।
আপনি কি বলবেন না। আপনি কে?
ছায়ামূর্তি না-সূচক মাথা নাড়ল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ছুটতে শুরু করল। লিলিয়ান চেঁচিয়ে বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
ছায়ামূর্তি ছুটতে ছুটতে কী যেন বলল, বাতাসের শব্দে তা শোনা গেল না।
লিলিয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আশেপাশে তাকালেই দেখতে পেত নদীর তীরে চিৎ হয়ে যে মানুষটি শুয়ে আছে সে তাহের। এখনো তার দেহে প্ৰাণ আছে, সে বেঁচে যাবে, সে নিশ্চয়ই বেঁচে যাবে।
জ্যোৎস্না প্লাবিত জলরাশি, তার ধার ঘেসে ছুটে যাচ্ছে এক নারীমূর্তি। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে। রিনারিন করে বাজছে হাতের চুড়ি।
পনের বছর পর
পনের বছর পর লিলিয়ান আবার তাহেরকে নিয়ে ইন্দারঘাটে এসেছে। তাদের সঙ্গে দুটি ফুটফুটে মেয়ে। এগার বছরের সারা, সাত বছরের রিয়া। দুজনই হয়েছে মার মতো, শুধু চোখ পেয়েছে বাবার। বড় বড় কালো চোখ। মার নীল চোখ কেউই পায় নি। দুজনই খুব হাসিখুশি মেয়ে, কিন্তু এদের চোখের দিকে তাকালে মনে হয়–চোখ ভর্তি জল। এক্ষুণি বুঝি কাঁদবে।
তাদের আসা উপলক্ষে বাড়িঘর ঠিক করা হয়েছে। বাড়ির চারপাশের বাগান পরিষ্কার করা হয়েছে। মেয়ে দুটি মহানন্দে বাগানে ছোটাছুটি করছে। রিয়া ছুটতে গিয়ে উল্টে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। হাঁটুর চামড়া ছিলে গেছে। কিন্তু রিয়া হাঁটু চেপে ধরে হাসছে। যেন এই বাগানবাড়িতে ব্যথা পাওয়াও এক আনন্দজনক অভিজ্ঞতা।
তাহের নিজেও বাগানে। সে খুব ব্যস্ত। আমগাছের ডালে দোলনা টানানোর চেষ্টা করছে। ডাল উঁচু। চেয়ারে দাঁড়িয়ে নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। বড় মেয়ে সারা বাবাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এলো। সে গম্ভীর গলায় বলল, বাবা শোন, তুমি যদি দুদিন পর বলো, বেড়ানো শেষ হয়েছে এখন আমেরিকা ফিরে যাব। তাহলে কিন্তু হবে না। আমরা খুব রাগ করব।
তাহলে আমাকে কী করতে হবে?
এখানে থাকতে হবে।
কতদিন?
For eternity.
তাহের হো-হো শব্দে হাসছে। হাসির শব্দে লিলিয়ান এসে দোতলার বারান্দায় দাঁড়াল। তাহের উঁচু গলায় বলল, এই যে বিদেশিনী! দয়া করে মগভর্তি কাঁপাচিনো কফি বানিয়ে নিচে এসে আমাকে সাহায্য কর।
এখন কফি বানানো যাবে না। সরঞ্জাম নেই।
কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। কফি বানাতে হবে।
ছোট মেয়ে রিয়া চেঁচিয়ে বলল, বাবার জন্যে কফি বানাতেই হবে।
লিলিয়ান রান্নাঘরের দিকে গেল না। সে ঢুকল আয়নাঘরে। দরজা বন্ধ করে দিল। অন্ধকার হয়ে গেল আয়নাঘন। সে গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস কবে বলল, আপনাকে দেখানোর জন্যে আমি আমার বাচ্চা দুটিকে নিয়ে এসেছি। আপনি কি দেখেছেন তাদের?
কেউ জবাব দিল না।
লিলিয়ান বলল, আপনি কি তাদের একটু আদর করে দেবেন না?
নীববতা ভঙ্গ হলো না। আয়নাঘরের স্তব্ধতা ভাঙল না। লিলিয়ানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। পনের বছর আগে এক ভয়ঙ্কর জটিল সময়ে কেউ একজন তার হাত ধরে বলার চেষ্টা করেছিল–কোনো ভয় নেই। সেই দুঃসময় আজ আর তার নেই। জীবন তার মঙ্গলময় বিশাল বাহু মেলে লিলিয়ানকে জড়িয়ে ধরেছে। আজ আর আশ্বাসের বাণী শোনার তার প্রয়োজন নেই।